প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
আমার প্রথম ভ্রমণবিষয়ক গল্পের রচিত শিরোনাম ছিল ‘ভ্রমণে-ভ্রমর মেলে’। সেটি অপ্রকাশিত। ওই সময়ে লেখনীর জগতে অন্তরালে ছিলাম। দীর্ঘ একটি ভ্রমণ গল্প লিখি। গল্পে গল্পে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম জেলাভিত্তিক ঐতিহ্য। চাঁদপুরের ইলিশ, বগুড়ার দই, রাজশাহীর আম, আওলিয়ার শহর চট্টলা, ঢাকার আহসান মঞ্জিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙ্গামাটির নৃ-গোষ্ঠী এমন উল্লেখযোগ্য বিষয়। যা এখন জেলা ব্র্যান্ড হিসেবে সমাদৃত। রোমাঞ্চকর তৃষ্ণা মিটিয়ে ছিলাম লেখনীর রিসোর্টে।
অদেখাকে দেখার, অজানাকে জানার আগ্রহ মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। দেখা ও জানার জন্যে দিকে দিকে ছুটে বেড়াচ্ছে মানুষ। ঘর হইতে বাহির হইয়া দু নয়নে দেখার তৃষ্ণা মেটানো হলো ভ্রমণ। আনন্দ ভ্রমণ গল্পের ন্যায় নিরানন্দ ভ্রমণ কাহিনিও পীড়া দেয়। আমার ভ্রমণবিষয়ক গল্পটি নিরানন্দ রূপে ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে যায়। সাথে ছিল প্রথম রঙিন স্বপ্নের কবিতা গল্প। পরবর্তীতে একান্ত লেখায়ও ভাটা পরে যায়। লেখাগুলো ছিল আমার অমূল্য সম্পদ। টগবগে তারুণ্যের কচি হাতের লেখাগুলোর জন্য অন্তর্জ¡ালা বয়ে বেড়াতে হবে পড়ন্ত বেলা অবধি। অন্তরালে-অন্তরীণ হয়ে থাকতে নাহি চায়। সুযোগ পেয়ে বেড়িয়ে যায় জলের সাথে সন্ধি করে। বন্যায় তেড়ে আসা পানির কথা মনে পড়লে, মনে পড়ে যায় জলের তৃষ্ণা মেটানো ফাঁকি দিয়ে তলিয়ে যাওয়া আমার কবিতা গল্পদের। ভাবুক মনে সান্ত¡না খুঁজি হয়তো জলের ভুবনে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওড়া। সাগরকন্যার বুকে এবারে যাচ্ছি দলবেঁধে, যদি ধরা দেয় পুরোনো ভ্রমণের স্মৃতিরা।
দুই. কাজী নজরুল ইসলাম রচিত- থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে, কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বহুদিন ধরে ‘বহু ক্রোশ দূরে, বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে, দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা। কোন কিছু হাজারবার শোনার চেয়ে একবার দেখা ভালো। পবিত্র আল কোরআনে শিক্ষা অর্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে যাওয়ার বর্ণনা আছে। অর্থাৎ শিক্ষার সাথে সাথে ভ্রমণের তাগিদ অনুভব করা যায়। ভ্রমণ প্রতিটি মানুষের জীবনে অপরিহার্য উপরোক্ত পঙক্তিমালা থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়। বলা যেতে পারে, ভ্রমণ মৌলিক অধিকার পর্যায়ে। ভ্রমণ নিয়ে ইতিবাচক ও নীতিবাচক কথ্য-কাহিনি শোনা গেলেও ইতিবাচক বিষয়টি প্রণিধান যোগ্য। ইতিবাচক দিকটি সুস্পষ্টভাবে ধরা দেয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা সফর, পেশাজীবী, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের এবং পারিবারিক ভ্রমণ কাহিনিগুলোও চমকপ্রদ, শিক্ষণীয়, উজ্জীবিত করে। গুণ গুণ করে মুখস্থ পড়া একসময় স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। ভ্রমণকাহিনি দীর্ঘ বছর পরেও ধরা দেয় স্মৃতির মণিকোঠায়। গড় গড় করে তোতা পাখির ন্যায় বলা যায়, বর্ণনা করা যায় দর্শনীয় স্থানের কাহিনি।
পৃথিবী হচ্ছে একটি বই। যারা ভ্রমণ করেন না তারা একটি পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ থাকেন মাত্র! এই জন্য জ্ঞানীজন-গুণীজন-সারল্যজন ভ্রমণের প্রতি আকৃষ্ট থাকেন বেশি। নিজ নিজ সময় সুযোগ-সুবিধায় ভ্রমণ করে মনের ঘণ্টা বাজায় দিক দিগন্তে।
মানুষ-পরিবেশ ও পরিবহন এই তিনের সমন্বয়ে ভ্রমণ আরামদায়ক হয়। সমমনাদের সাথে ভ্রমণের মজাই আলাদা। ভ্রমণ নিয়ে আগ্রহ নেই- এমন মানুষ বিরল। ভ্রমণ কাহিনির স্মৃতি কথা আওড়াতে তৃপ্তি বোধ করেন অভিযাত্রীরা। ভ্রমণ স্মৃতিতে আত্মার সুখ অনুভূত হয়। এখানেই ভ্রমণের স্বার্থকতা। জীবনের প্রথম দেখা, হঠাৎ দেখা এক একটি মনোরম স্থান দৃশ্য ঐতিহাসিক ধর্মীয় দর্শনীয় নিদর্শন দেখে দেখে ভ্রমণপিপাসুদের জ্ঞানের গভীরতায় পরিবর্তন আসে মনোজগতে। কর্মচাঞ্চল্যে গতিশীলতা আনে নতুন উদ্যোমে। অবকাশ যাপনে চোখ মন ও দেহের আনন্দ প্রতিক্রিয়ার উচ্ছ্বল প্রাণখোলা হাসি মনোজগতের টনিক।
উল্লেখ, ভ্রমণ এমন একটি বিষয় যেখানে অর্থ উপার্জনে মনোনিবেশ করে না। বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় ভ্রমণ লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর পিরামিড গল্পে ধনসম্পদে আকৃষ্ট না হয়ে পিরামিডের রহস্য জানার আকাঙ্ক্ষা প্রবলভাবে প্রকাশ পায়।
তিন. কবি লেখকদের কলম স্বপ্নের সীমা নেই। পর্যটকদের নেই মানচিত্র। নয়নভরে সুখানুভূতি পেতে চায় সৃষ্টির অফার সৌন্দর্যের। সাহিত্য দর্পণে ভ্রমণের সম্পর্ক সুখর-রোমান্টিক ও রোমাঞ্চকর। কবিতার চেয়ে ভ্রমণ গল্পে প্রাধান্য বেশি। বরাবর সাহিত্যজনরা ভ্রমণপিপাসু। চাঁদপুর সাহিত্য সমাজে সম্মিলিতভাবে ভ্রমণের আয়োজন এই প্রথম। শিল্প সংস্কৃতি সৌহার্দ্যরে চাঁদপুর সাহিত্যের রক্তকণিকা বর্ণিল। বর্ণাঢ। রবীন্দ্রনাথের স্নেহাশীষ চাঁদপুরের সন্তান বলে গণ্য বিনয় মুখোপাধ্যায় (যাযাবর)কে ক্রিকেট সাহিত্যের জনক বলা হয়। যাযাবরের উত্তরসূরি চাঁদপুর সাহিত্য সমাজ প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন করে সাহিত্যে ক্রিকেটের বন্ধন জাগ্রত করে। জাতীয় পর্যায়ে সাহিত্য নিয়ে গর্বিত আলোচিত চাঁদপুর জেলা। বিশেষ করে, চাঁদপুর সাহিত্য ইতিহাসে স্মরণীয় লিপি হয়ে থাকবে ২০২৩ সাল। জেলা সাহিত্য সম্মেলন, জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন, সাহিত্য প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ এবং বিভিন্ন পার্বণ উৎসবউদযাপন, ভ্রমণ- সব মিলিয়ে কলম ব্যস্ততায় সাহিত্যসমাজ। ব্যস্ততা ও প্রাত্যহিক জীবনের অবসাদ থেকে আত্মমনোরঞ্জনে সজীবতা গায়ে মাখানো হবে ভ্রমণে। ভ্রমণে পরে শৈল্পিক ছোঁয়ায় অভিমানি ঝর্নায় স্নাত হবে কবিতা গল্প। নিরাপদে যেন ফিরি, ইলিশের বাড়ি। চাঁদপুরের সাহিত্যিক ও সুহৃদদের উষ্ণ অভিনন্দন।