প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
মন খারাপ। অফিসে যাব, হঠাৎ দেখি সাইকেলটা নষ্ট। তেলের দাম বাড়ার আগেই সাইকেলটা কিনেছিলাম! কাজটা নিশ্চয়ই পাড়ার ওই ছেলেছোকরাদের। নিত্যদিন ওদের মোটরসাইকেলের বিকট ‘বুমবুম, দ্রিমদ্রিম’ আওয়াজে কানে তালা লাগার দশা হয়। বুঝে আসে না— ওদের কী এমন তাড়া! ওরা চাকরি করে না। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার ব্যস্ততাও নাই। তবুও এত উচ্চ গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে কোথায় যায় ওরা?
ওপাড়ার মন্টু মিয়াকে দেখলাম ছোট্ট একটা সাইকেলে চড়ে অফিসে রওনা হয়েছে। পেছনে তার ছেলের কান্নার আওয়াজও কানে এলো। বাচ্চাটাকে তার মা সান্তজ্জনা দিচ্ছে, ‘কাঁদিস না খোকা, তেলের দাম কমে গেলেই তোর বাবা তোর সাইকেল ফেরত দিয়ে দিবে।’
দেরি হয়ে যাচ্ছে। রিকশা ডাকলাম। কিন্তু তারা একশ টাকার ভাড়া চাইছে দুশ’ টাকা। কেউ কেউ তো আরও সরেস। আড়াইশ’, তিন শ’ও হাঁকছে। অফিস হাঁটা দূরত্বে নয়। অগত্যা আমার সেই বিখ্যাত মোটরসাইকেলে চড়ে যাব বলেই ঠিক করলাম। নানা কারণে কয়েকদিন ধরে ফেলে রেখেছিলাম ওটাকে। ভাগ্যিস, দাম বাড়ার আগেই কিছু তেল কেনা ছিল।
অবশ্য দুশ্চিন্তা কিছুতেই যাচ্ছে না। আমার বাইকে আগে ৮৯ টাকার তেলে ৪০ কিলো যেত। কিন্তু এখন তো সেই ৪০ কিলো যেতে ১৩৪ টাকা লাগবে। এই বাড়তি টাকা কোত্থেকে আসবে? স্কুলজীবনে করা গণিত বইয়ের সেই অঙ্কটির কথা মনে পড়ল। চিনির ব্যবহার ২০% বাড়ায়, একটি পরিবার চিনির ব্যবহার শতকরা কত কমালে চিনি ব্যবহার বাবদ খরচ অপরিবর্তিত থাকবে? ভাবি— বাইক ব্যবহার বাবদ খরচ কীভাবে কমাব? অর্ধেক পথ বাইকে গিয়ে, বাকিটা পথ কি ঠেলে নিয়ে যাব?
নাকি সাইকেল ঠিক করে ওটাই চালাব? কিন্তু মন্টু মিয়ার কথা শুনে তাতেও দমে গেলাম। ‘ভাই, এ শহর সাইকেল চালানোর জন্য নিরাপদ নয়। কোনো আলাদা লেন নেই। কেউ সাইড দেয় না। উলটো গায়ের ওপর এসে পড়ে। সুবিধা কেবল একটাই— মাঝে-সাজে প্রবল জ্যামে সাইকেলটাকে ফুটপাতে তুলে দেওয়া যায়!’
২. কয়েকদিন ধরে আমার এই লক্করঝক্কর মোটরসাইকেলে চড়েই আসা-যাওয়া করছি। আগে পাড়ার ছোকরারা আমার গাড়িটাকে দেখলেই হাসাহাসি করত। আমার পাশ দিয়ে বাইক নিয়ে তাও মেরে সাই করে চলে যেত! এ ক’দিন ধরে দেখছি— ওরা পাড়ার দোকানে বিরস বদনে বসে থাকে। মোটরসাইকেলগুলোও নেই।
একদিন ওদের একজন বেশ নরম গলায় বলল, ‘ভাই, আপনার সাইকেলটা তো ফেলেই রেখেছেন! আমার কাছে বিক্রি করে দিন না।’
চমকে ওঠলাম। ‘তোমরা চালাবে সাইকেল!’
‘আর বলবেন না, ভাই। মোটরসাইকেল তো আর পানিতে চলে না। কিন্তু এক পানি কেনার টাকা ছাড়া আর টাকা কই!’
‘কিন্তু এতদিন তেল কেনার টাকা কোথায় পেতে?’
ছেলেটা মিনমিনিয়ে বলল, ‘সে বাবার থেকে ম্যানেজ করে নিতাম। কিন্তু তারও তো সংসার খরচ বেড়েছে। তাই আমাদের হাত খরচে টান পড়েছে।’
আরেকজন বলল, ‘আপনার ওই পুরনো বাইকটা অনেক কম তেল খায়। আমাদেরগুলোর মতো এত তেল খেকো নয়। আপনি ওটা না চালালে আমিই কিনে নিতাম।’
আমি ফের চমকে ওঠি। যারা স্টাইলিশ মোটরসাইকেল ছাড়া অন্য কিছুতে চড়েও না, তারা কিনা আমার ওই ধ্বজাভাঙা বাইকটা চালাবে! লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল। বাইক, বাই-সাইকেল দুটোই বেচে দিলাম।
৩. বউ জানতে চাইল, ‘এখন অফিসে যাবে কী করে? পায়ে হেঁটে? কিন্তু বাজার-সদাই করার ক্ষেত্রে কোনো ঝামেলা করবে না— এই বলে দিলুম। তোমাকে তো প্রায়ই বলতে শুনি— রিকশা পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই বেশি বাজার করিনি!’
পরদিন পাড়ার গ্যারেজ থেকে একটা রিকশা ভাড়া করলাম। ওটা চালিয়েই অফিসে যাব। ফিরবও।
যাওয়ার সময় একজন ডাক দিল, ‘এই রিকশা, যাবে?’
একেই বলে ভাগ্য। তার গন্তব্য আমার অফিসের কাছেই। তাকে নিয়ে গেলাম। মনটা ফুরফুরে। অল্প টাকার রিকশা ভাড়ায় অফিসে গেলাম। উল্টা টাকাও মিলল। এভাবে প্রতিদিন আসা-যাওয়ার পথে ‘খ্যাপ’ নিলে মন্দ হবে না। রিকশা চালালে ডায়াবেটিসও শরীরে বাসা বাঁধতে পারবে না।
রিকশাটা অফিস চলাকালীন কাছাকাছি একটা গ্যারেজে থাকে। একদিন গ্যারেজের লোকটা বলল, ‘আপনার রিকশাটা তো আট ঘণ্টা পড়েই থাকে। ভাড়া দিতে পারেন কিন্তু।’
আমার মনের খুশি যেন ধরেই না। এ যে কইয়ের তেলে কই ভাজা।
রিকশা চালাই আর মনের সুখে গান গাই, ‘চলে আমার রিকশা হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়া...।’
একদিন তা শুনে বউ বলল, ‘ভালো কথা মনে করিয়েছ! হাওয়া মুভিটা দেখতে চলো একদিন!’
আমি মনে মনে হিসেব কষি— রিকশা চালিয়ে এ ক’দিনে এক্সট্রা যা আয় হলো, তা দিয়ে একদিনের শো’র খরচ হয়েই যাবে।
আমার অফিসে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। বলাবাহুল্য, বউয়ের কথামতো রিকশায় করেই বাজার-সদাই বাসায় আনছি। যদিও আগে ব্যাগভর্তি বাজার করলেও এখন বাজার হয় ব্যাগের অর্ধেক। টাকা অবশ্য সেই ‘একই পরিমাণ’ই খরচ হয়। গণিত বইয়ের সেই অঙ্কটা মুখস্ত করে ফেলেছি যে! দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় বাজার খরচ কত কমালে ব্যয় অপরিবর্তিত থাকবে?
মধ্যবিত্তর জীবনে অঙ্কটা ঘুরেফিরে বারবারই।