প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
আঁধার রাতে বাড়ির পশ্চিম বিলের পানিতে নাও চলার শব্দ শুনতে পেল শীতল। একটু আগেই তিন মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে ঘরের বাইরে বের হলো সে। চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বুঝতে পারলো, নৌকাটা পশ্চিমের পুকুরের হিজল গাছের তলে এসে থেমেছে। সাদা পাঞ্জাবি আর টুপি পরা কয়েকজন লোক ধীরে ধীরে কথাবার্তা বলে, হিজল গাছের সাথে কী যেন একটা বেঁধে চলে গেল সিগগিরই। নৌকাটি অগোচরে গেলেই, পায়ের জুতা খুলে কাঁদা জলে হেঁটে হিজল তলে এলো শীতল। হাতের ডিম করা হারিকেনের আলোটা একটু বাড়িয়ে ধরলো হিজল গাছের দিকে।
হায় আল্লাহ! এ যে প্রাণহীন এক যুবকের শরীর হিজলের ডালে উল্টো করে ঝুলিয়ে বাঁধা। হারিকেনের আলো কমিয়ে ঘরে ফিরলো শীতল। দুই ছেলে ঘুমাচ্ছে চৌকিতে। মাটির বিছানায় ঘুমন্ত মেয়েদের মুখ দেখে, পাশের কক্ষের মাটির বিছানায় স্ত্রীর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো সে।
ভোর না হতেই টুনি বাবাকে ডাকলো। নির্ঘুম শীতল, হারিকেন হাতে নিয়ে সুপারি গাছের পাতার বেড়া বেষ্টিত জায়গায় টুনিকে বসিয়ে হারিকেন নিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে রইল। খানিক পরে, ঘরের কোলে রাখা মটকি থেকে পানি নিয়ে পায়ে ঢালতে ঢালতে টুনি ওর বাবার কাছ থেকে জানতে চাইলো-
-বাবা, মাইজাবুবু কইলো, আমাগো দেশে নাকি যুদ্ধ লাগছে, যুদ্ধ কী বাবা?
মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শীতল বলল, টুনি মা, তোর মায়ের শরীর খারাপ। এখন কথা কইলে মায়ের ঘুম ভাইঙ্গা যাইবো। রাত পোহালেই সব তোরে বুঝিয়ে বলমু। এখন শুয়ে যা।
শীতলের চোখে ঘুম নেই। এপাশ ওপাশ করতে করতে ফজরের আজান পড়লো। মসজিদ যেতে হাঁটুর উপর পর্যন্ত পানি বলে শীতল ছেলেদের নিয়ে ঘরেই নামাজ পড়লো। মেয়েরাও মায়ের সাথে নামাজ পড়ে নিলো।
এই কয়দিন যাবত শীতলের নাওটি ভেঙ্গে পড়ে আছে। বাংলাবাজারে নিয়া ঠিক করার কথা। পাকিস্তানিরা ঘাঁটি গেড়েছে শুনে, আজ কয়দিন ভয়ে কেউ মোহরা দেয় না সেদিকে। ঘরে খোরাক আছে অল্প। দেশের এহেন পরিস্থিতিতে ঠিক মতো এবারের ফসল করা হয়না। নুন, তেল, মিঠাই, চিড়া ফুরিয়ে গেছে। বাজার থেকে যে আনতে যাবে তার উপায় নাই। দোকানিরা সময়মতো দোকান খুলতে পারছেন না। বাড়ির অন্যরা ফসলে কিছুটা সময় দেওয়ার জন্য কিছু ধান পাওয়াতে কয়েকদিন চলবে। এরপর সকলের খোরাক শেষ হয়ে যাবে। ঐদিকে লুকিয়ে লুকিয়ে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে পাক বাহিনীদের সাথে লড়াই করা ছেলেদের জন্য খাবার আর ঔষধ গুলো পৌঁছিয়ে দিতে হবে। এত চিন্তার মধ্যে টুনি আবার এসে জিজ্ঞেস করল, বাবা যুদ্ধ কী কইলানা তো?
ভোরের আলো কিছুটা ফুটতেই, শীতল তিন মেয়েকে হিজল গাছের নিচে নিয়ে গেল। আঙ্গুল দিয়ে গাছের সাথে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে বাঁধা মানুষের শরীরটাকে দেখিয়ে বলল, এইভাবে দেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য, পাক হায়েনাদের কাছে প্রান বিসর্জন দেওয়াকেই মুক্তিযুদ্ধ বলে রে মা!
শীতলের দু চোখ পানিতে ভিজে গেল। একমাত্র শীতল জানে, গত মাস দুয়েক আগে এই ছেলেটি রামপুর এলাকা থেকে স্বেচ্ছায় তার মুক্তি বাহিনীর দলে নাম দিয়েছিল। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে লড়েছে এই দুই মাস। নির্মমভাবে হত্যা করেছে হায়েনারা। বাবা আর তিন মেয়ে মিলে জলকাদা মাটির উপর কলার সবুজ পাতা বিছিয়ে, গাছ থেকে নামিয়ে শুইয়ে দিল ছেলেটির শরীর। ততক্ষণে এলাকার অনেক মানুষ এসে জড়ো হয়েছে হিজল গাছের তলে। এলাকায় শীতলেরর কথাই শেষ কথা। সে সকলকে বলল, এই লাশ দাফন-কাফন হবে মুসলিম নিয়মে। সকলে মিলে লাশ কাফন করে বুক অব্দি পানি পেরিয়ে মসজিদে নিয়ে জানাজা পড়ে কবর দিল শীতলের বাড়ির কবরস্থানে।
সাফি কয়েক মাস ধরে বাপের বাড়ি যেতে পারছেনা, মায়ের শরীর খারাপ জেনেও। স্বামী, বিজুকে বলেই ফেলল, একবার যদি দেখতেন, পথের বিপদ কমেছে কিনা।
বিজু বাড়ির কয়েকজন ছেলেসহ নাও নিয়ে দক্ষিণের বিলে এগোলো। খালের বিভিন্ন স্থানে নৌকা থামিয়ে জানতে পারল, বালিয়া থেকে হরিণা পর্যন্ত পশ্চিমারা দখল করে রেখেছে। সেখানকার কোন মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। মুক্তিবাহিনী খোঁজার নাম করে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে শুরু করেছে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হত্যাকাণ্ডসহ অমানবিক নির্যাতন।
বিজু ফিরে এসে দেখলো, সাফি দক্ষিণের নারকেল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য। দক্ষিণের নাও কিছুতেই ভাসানো যাবে না। হায়েনারা হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, মেয়েদের শরীরেও আছে শকুনি নজর।
সাফির চোখে জল দেখে বিজু বলল, ও বাড়িতে তোমার আরো পাঁচজন ভাইবোন আছে। তোমার বাবা, মায়ের খুব যত্ন করে। কেঁদোনা, আল্লাহকে ডাকো।
বিজু স্কুল থেকে ফিরে এসে বলল, বাবা আমার ক্লাসের লক্ষ্মী তিন দিন হইলো স্কুলে আইলো না। তুমি তো ওর বাপরে চিনো, দেখলে জাইনো তো ওর অসুখ হইলো কি না?
শীতল বাড়ির ছেলেদের বিমলের বাড়ি পাঠিয়ে জানতে পারলো, বিমল মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার খবরটা জলিল জানতে পেরে গেছে। জলিল তার দলের কয়েকজনকে নিয়ে বিমলের বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়েছে। বিমলের বোবা বোনটার শরীরে খারাপভাবে হাত দিয়েছে। সেই রাতেই বিমল, স্ত্রীর কান্না কাটিতে ঘরে তালা দিয়ে বাড়ি ঘর সব ছেড়ে রামপুরের পিছনের খালে নাও ভাসিয়ে কোথায় গিয়েছে কেউ বলতে পারবে না।
পরদিন জলিলের লোক গিয়ে বিমলের ঘরের তালা ভেঙে বাড়ির দলিল পত্র, গয়না, অর্থ কড়ি যা ছিল সব নিয়ে ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
জলিলের বউয়ের পরনে ইন্ডিয়ান শাড়ি দেখে টুনির মা জানতে চাইল, এই শাড়ি তুই কই পাইলি?
জলিলের বউ চেটাং করে বলল, কেন আমার স্বামীর কী রোজগার নাই নাকি, যে আমি এই শাড়ি পরতে পারমু না।
টুনির মা জানে, এই শাড়ি লক্ষ্মীর মাকে তার মামা কলকাতা থেকে পাঠিয়েছিল। সারা গ্রামে একখান ইন্ডিয়ান শাড়ি ছিল, কেবল লক্ষ্মীর মায়ের।
টুনির মা বলল, দেখ, জলিলের বউ, তুই জলিলরে বুঝাইতে পারোস না, কেন সে দেশের মানুষের ক্ষতি করে? আল্লাহ তারে ছাড়ব না।
জলিলের বউ মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল।
জব্বারের বউ টুনির মাকে বলল, বড় ভাঁজ, জলিলের বড় ভাই তারে বহুত বুঝাইছে, সে কোন কথা শুনে না। বাড়তি কিছু কইতে গেলে বলে, নিজের ভালো চাইলে চুপ থাকেন।
কী করবো তার ভাই। জমজ হইছে, একসাথে বড় হইছে, দেখতে একই রকমের চোখণ্ডমুখ । কিন্তু তার মন বড় খারাপ। সে দেশের মানুষের ক্ষতি করনে পাকিস্তানির লগে হাত মিলাইছে।
টুনির মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘরে গেল।
রাতে জলিল ঘরে ফিরলে জব্বার তাকে খুব করে সাশায়। ফের যদি সে পাকিস্তানিদের সাথে দেখা করে, কিংবা তাদেরকে গ্রামের মুক্তিদের বাড়ির সন্ধান দেয়, তবে তার খারাপ হইবো।
জলিল ভাইয়ের মুখের উপর কথা ছুড়ে বলল, বিপদ হইলে আমার একার হইবো না, তোর ও হইবো যে।
জলিলের অত্যাচারের শিকার গ্রামের গরিব ও হিন্দু পরিবারগুলো। এছাড়াও যে বাড়িতে যুবতী মেয়ে আছে সেই সব বাড়ি তল্লাশি করে। পাকিস্তানিদের হাত থেকে রক্ষা পেতে মাটির নিচে গর্ত করে যুবতী মেয়েদের লুকিয়ে রাখে বাবা-মা। দেশিয় কুলাঙ্গারদের সহায়তায় সেখানে ও গিয়ে হানা দেয় পাক হায়েনারা।
পাকিস্তানিদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেতে শীতল, এই কয়মাসে এক এক করে বিভিন্ন গ্রামের ছেলেদের নিয়ে গড়ে তুলেছে মুক্তি বাহিনীর দল। অথচ, তার বাড়িতেই রয়েছে, ভয়ানক এক দেশদ্রোহী। এ যেন দুধ কলা দিয়ে পোষা এক ভয়ংকর কাল সাপ।
জলিলকে সকলে বুঝানোর পরে ও যখন সে কারো কথা শুনলো না, তখন তার অত্যাচারের হাত থেকে গ্রামের অসহায় মানুষকে রক্ষা করতে অন্য পদক্ষেপ নিলো শীতল। দেশের মুক্তি সেনা বাহিনীদের কাছে জলিলের দেশদ্রোহীতার খবর পৌঁছে দিলো সে।
গ্রামে মুক্তি সেনা বাহিনীদের নাও এসেছে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো সমস্ত কাজ পেলে জীবন বাঁচাতে পালাতে শুরু করলো। মুক্তি বাহিনীর ছেলেরা সবাইকে বলল,
পালানোর দরকার নাই। এরা আমাদের দেশের মুক্তি সেনা বাহিনী।
জব্বারের স্ত্রী গরম ভাত বেড়ে জব্বারকে ডাকলো খাওয়ার জন্য। জব্বার ভাত না খেয়ে, বাড়ির দক্ষিণের নারকেল গাছের নিচে দাঁড়ালো সেনাবাহিনীদের দেখতে। জব্বারের বাড়া ভাত খেয়ে নিলো জলিল।
সেনাবাহিনীরা নাও ভিড়িয়ে, দক্ষিণের বিলের শেষ মাথার উচু ঢিবির উপরে গিয়ে দাঁড়ালো। সেখান থেকে কোনা বরাবর জব্বারকে দেখতে পেলো সকলে। তাকে দেখা মাত্রই দূরের গ্রামের দুজন মুক্তি সেনা বাহিনীর সদস্য বলল,
স্যার, ঐ যে জলিল।
সাথে সাথে মিলিটারি প্রধান পিছন থেকে রাইফেল নিয়ে গুলি ছুড়লো জব্বারের বুক বরাবর। জব্বার কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই গুলিটা তার বুক ছিঁড়ে পিঠ বেদ করে বেরিয়ে গেল।
গুলির শব্দ শুনে এলাকার সকল মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। জব্বারের স্ত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে স্বামীর কাতরানো অবস্থা দেখে চিৎকার করে বলল,
হায় আল্লাহ একি হয়ে গেল ! জলিলের সব পাপের শাস্তি আমার স্বামীকেই পেতে হলো? আল্লাহ জলিলরে তুমি কোন দিন মাপ কইরোনা।
চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে জব্বারের বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা রক্ত মাখা কলিজা বুকের মধ্যে ঢুকানোর বৃথা চেষ্টা করতে থাকলো তার স্ত্রী।
এলাকার সকল মানুষ জব্বারের জন্য কান্নাকাটি করলো। ভাইয়ের এহেন অবস্থায়ও জলিল ঘর থেকে বের হয়নি। নিজেকে বাঁচানোর জন্য বড় চাদরে নাক মুখ ঢেকে, নাও নিয়ে বাড়ির পিছনের উত্তরের খাল দিয়ে পালিয়ে গেল সে।
শীতল মুক্তি সেনা বাহিনীর কাছে জব্বারকে ভুল সনাক্তের কারণ জানতে চাইলে তারা জবাবে বলল, তাদের জমজ দুই ভাইয়ের কথা গ্রামের মুক্তি বাহিনীর সদস্য ছাড়া অন্য কেউ জানতো না।
শীতল বলল, গ্রামের মুক্তি বাহিনীর সদস্য তো এই দলে ছিল?
অন্য এলাকার দুজন মুক্তি সদস্য বলল, ঐ সময়ে তারা গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলতে গিয়েছিল।
মিলিটারি এবং মুক্তি সেনা বাহিনীরা শীতল, জব্বারের স্ত্রী, এবং এলাকার সকল মানুষের কাছে তাদের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলো। জলিলকে তার পাপের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করলো।
টুনি আর ওর ভাই বোনেরা তাদের জব্বার চাচার জন্য হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
জলিলের বউ কখনো ভাবেনি, তার স্বামীর কর্মফল তার ভাসুর এমন ভাবে পাবে। সে কখনো এমনটা চায় নি। সে তো কেবল নতুন শাড়ি, গয়নাই পড়তে চেয়েছিল। কোন মুখে বড় জাকে শান্তনা দিবে। যারা যারা জলিলের অপকর্মের কথা তাকে বলতো, তাদের সামনে মুখ দেখাবে কী করে। স্বামীর প্রতি আজ প্রচণ্ড ঘৃণা হচ্ছে তার। আজ মনে হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য চুপ করে না থেকে, স্বামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আরো আগে মরে যাওয়াই উচিত ছিল।
উপস্থিত সকল মানুষের ভিড়ে পিছনের সারিতে জলিলের বউকে দেখতে পেলো টুনি। উঠানের কোনায় গাড়া বাঁশটি অতি কষ্টে টেনে তুলে, সকলকে ঠেলে পিছনের সারিতে গিয়ে জলিলের বউয়ের মাথায় সজোরে একটা বাড়ি মারলো সে।
ওমা গো বলে ফাটা মাথায় হাত চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল জলিলের বউ।
টুনির মা দৌড়ে এসে বলল একি করলি তুই টুনি?
টুনি চোখের জল মুছে রেগে বলল, দেশের মানুষের ক্ষতি কারণে যে স্বামীকে সহায়তা করে সেও দেশের শত্রু। দেশের শত্রুর ঠিক মতো বাঁচার কোনো অধিকার নাই।
সকলে মিলে জব্বারের লাশ দাফন কাফন করলো। সেদিনের পর থেকে শীতলের দল আরো শক্তিশালী হয়ে লড়াই করতে থাকলো। এমনভাবে সারা দেশের প্রত্যেকটি মানুষের সহায়তায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের যুদ্ধে হারিয়ে জয় ছিনিয়ে আনলো এদেশের মানুষ। এদেশের মানুষের ক্ষতি করে, নয় মাস পর যুদ্ধে হার মেনে আত্মসমর্পণ করলো হায়েনারা। মাথা নিচু করে ফিরে গেলো পশ্চিম পাকিস্তানে।
ডিসেম্বর মাসের ষোলো তারিখ। বিজয়ের আনন্দে উল্লসিত বাংলাদেশর প্রতিটি মানুষ, ঘর-বাড়ি, পথ-ঘাট, হাট-বাজার, অফিস-আদালত।
গ্রামের বিলের পানি শুকিয়ে এসেছে। এই নয় মাস খেয়ে, না খেয়ে, পালিয়ে কোনো রকম জীবন কাটিয়েছে গ্রামের অসহায় মানুষ। এখন আর ভয় নাই। শীতলের বাড়িতে গ্রামের সকল মানুষ এসে জড়ো হলো। শীতল তার রেড়িওটি উঠানে নামিয়ে শব্দ বাড়িয়ে দিল। রেড়িওতে বিজয়ের গান শুনে আনন্দে আত্মহারা হলো গ্রাম বাসি।
বাজারে হাট বসেছে, মাঠে ফসল ফলাতে কৃষক মাথায় মাথাল পরেছে, মেয়ে, বউয়েরা শাড়ি, চুড়ি আলতা পায়ে, ঘুঘুর পরে মেঠোপথে হাঁটছে। পূর্ব পাকিস্তান আজ পরিপূর্ণ এক বাংলাদেশে রূপ নিয়েছে।
বাপের বাড়ি যাওয়ার পথে কোনো বিপদ নেই জেনে সাফি খুব খুশি। স্বামী বিজুর সাথে বাপের বাড়িতে রওয়ানা হলো সে। শুনেছে, তার ছোট একটি ভাই হয়েছে। সে বাড়ি গেলেই তার নাম রাখা হবে। পথের বাজার থেকে মিষ্টি, বাতাসা আর নতুন জামা নিল ছোট ভাইয়ের জন্য। অনেক মাস পর বড় বোনকে পেয়ে ছোট ভাই বোনদের আনন্দের সীমা রইল না। বড় বোনকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হলো টুনি। সাফি তার ছোট ভাইয়ের নাম রাখলো বিজয়।
বিমল তার পরিবার নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো।
শীতল বিমলের বোবা বোনটার কথা জানতে চাইলে বিমল বলল-সেদিন বোনের জন্য বাড়ি-ঘর সব ছেড়ে ভারতের এক শিবিরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছি আমরা। সেখানে বিশুদ্ধ পানি আর খাবারের অভাবে বোনের কলেরা হয়েছিল। তার কদিনের মাথায় সে মারা গেল। মিলিটারিরা এসে তার লাশ নিয়ে গেল। বোনের শেষকৃত্য ও আমি দেখলাম না।
শীতল বিমলকে শান্তনা দিয়ে বলল, আজই গ্রামের ছেলেদের নিয়ে তার বাড়ি ঠিক করিয়ে দিবে।
মুক্তি বাহিনীর ছেলেরা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বাড়ি ফিরে এসেছে। যারা ফিরেনি তারা দেশের মানুষের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে গড়ে দিয়েছে সোনার বাংলাদেশ।
জলিল আর ফিরে নি। ফিরে আসা এক মুক্তি যোদ্ধা শীতলকে জানালো, শেষের দিকে জলিল এলাকার কোন খবরাখবর জানাতে পারেনি বলে পাকিস্তানিরা গুলি করে জলিলকে হত্যা করেছে।
মাস খানেক জলিলের বউ বিছানায় পড়ে ছিল মারাত্মক জ্বরে। এখন তার ঠিকানা ছেড়া কাপড়ে রাস্তায়, পথে, ঘাটে। জলিলের পতন চোখে না দেখা পর্যন্ত সে কিছুতেই বিশ্বাস করলো না। দৌড়ে সে হিজল গাছের কাছে গিয়ে লাফ দিয়ে হিজলের ডালে উঠে বসলো। গাছের একটি ডাল ভেঙে জলিলের সাদা পাঞ্জাবি আর টুপি পরিয়ে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে বেঁধে দিলো হিজলের ডালে। ততক্ষণে এলাকার অনেক মানুষ হিজল তলে এসে দাঁড়িয়েছে। লাফ দিয়ে গাছ থেকে নেমে দুই হাতে তালি দিয়ে সকলকে বলল,
জলিলের ফাঁসি হইছে। কমলাপুর শান্তি হইছে।
বিমলরা বাড়ি এসেছে শুনে জলিলের বউ ইন্ডিয়ান শাড়িটা নিয়ে দৌড়ে বিমলের বাড়ি গিয়ে তার বৌকে ছুড়ে দিয়ে আবার দৌড়ে ফিরে আসলো।
টুনি আর ওদের বাড়ির ছট ছোট ছেলে মেয়েরা লাল সবুজের পতাকা নিয়ে শুকনো বিলের মেঠো পথে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বলে আনন্দ মিছিল করতে থাকলো।
জলিলের বউ দৌড়ে এসে বাচ্চাদের হাত থেকে একটি পতাকা নিয়ে নেচে নেচে বলল-রাজাকারের ফাঁসি হইছে, কমলাপুরে শান্তি হইছে। পাক হায়েনার পতন হইছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হইছে।
বাচ্চারা ও পাগলির সাথে তাল মিলিয়ে স্লোগান দিলো। তাদের সাথে দলে দলে যুক্ত হলো এলাকার সকল মানুষ।
অদূরে দাঁড়িয়ে বিজয়ের হাসি হাসলো শীতল।