মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০

আধুনিকতা
অনলাইন ডেস্ক

(গত সংখ্যার পর)

যেতে যেতে ভ্যান রঞ্জনদের বাড়ির উঠানে গিয়ে থামলো। দূর থেকে মা দেখতে পেয়ে দৌড়ে ছুটে এলো; আর ‘বাবা কেমন আছিস?’ বলে রঞ্জনকে জড়িয়ে ধরলো। অনেকদিন পর ছেলেকে পেয়ে রঞ্জনের মা মহাখুশি হয়ে গেলো। তারপর মেয়েটিকে দেখে হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, এই মেয়েটি কে আবার?

রঞ্জন বললো, তার নাম শিউলী। আমরা বিয়ে করেছি। সে তোমাদের বউমা।

তারপর শিউলীর দিকে তাকিয়ে বললো, এই হলো আমার মা বাবা; মানে ফাদার ও মাদার।

শিউলী গ্রামের কুৎসিত চেহারা আর রঞ্জনের মাকে বিশেষ গ্রাম্য কায়দায় সাধারণ শাড়ি পরা দেখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার তাকালো। তারপর রঞ্জনের বাবা রঙিন লুঙিন আর ময়লা গেঞ্জি পরা দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। রঞ্জন শিউলীকে প্রণাম করার ইশারা করায় বুঝতে পারলো না। কিছুক্ষণ পর শিউলী বললো, হাই মম, হাই ডেড।

রঞ্জনের মা বাবা হা করে তাকিয়ে রইলো। তারা বুঝতে পারলো না কী বলেছে।

রঞ্জনের মা : তো তুমি বিয়ে করেছ, আমাদের জানিয়েছ? এছাড়া বউ বাড়িতে আসবে শাড়ি পইরা। আর সে এসব কী পইরা আইছে রে বাবা। এটা কেমন বউ হইলো।

শিউলী: এক্সকিউজ মি ডেড। এটাই এখন ফ্যাশন। এটাকে বলে প্লাজো। এখন মানুষ এসবই পরে।

রঞ্জনের মা বাবা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর রঞ্জনের মা বললো, যাও বউকে ঘরে নিয়া গিয়া শাড়ি পরতে বলো। গ্রামের মানুষক এসব দেখলে হৈ চৈ পড়ে যাবে। মানুষ হাসাহাসি করবো।

রঞ্জন : তোমাদের বউমা হলো ভদ্র পরিবারের শহরের আধুনিক শিক্ষিত মেয়ে। আর আমিও শিক্ষিত মানুষ। সুতরাং আমাদের জীবনটাই এমন।

রঞ্জনের বাবা বললো, তোরে এই বউরে গ্রামে কেন আনতে বলেছে?

রঞ্জন : তোমরা তো বাবা বুঝতে পারলে না, আমার বউ হচ্ছে ফেসবুক সেলিব্রেটি, টিকটাক সেলিব্রেটি। বিরাট ধনী লোকের মেয়ে। আর তোমরা এ সব কী বলছ।

তোমাদের কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এমন বউ এখানে এনেছি এটা তো এই গ্রামের ভাগ্য। তোমাদের আর আমাদের ভাগ্য।

রঞ্জনের মা : আরে হইছে হইছে, এখন বউরে ঘরের ভেতরে নিয়া যাও।

রঞ্জন আর শিউলি ঘরে ঢুকে গেলো।

এদিকে রঞ্জনের মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। পরে রঞ্জনের মা রঞ্জনের বাবার দিকে বললো, এসব কী কইলো মেয়েটি? বাবারে কইলো ডেড, আর আমারে কি জানি কইলো মেয়ে?

রঞ্জনের বাবা : মনে হয় তোমারে মম কইছে।

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রঞ্জনের মা বললো, হায় হায় এ কেমন মেয়েরে বাবা?

রঞ্জনের বাবা খাটের ওপর বসতে বসতে বললো, আমার তো মাথা ঘুরতাছে।

রঞ্জনের মা : ছেলেটি কেমন বউ আনলো? আমাদের একটু জানাইলো না। ছেলেটা আমাদের কি সম্মান করলো। এটা মানছি যে, ছেলেটা লেখাপড়া করেছে। তাই বলে আমাদের সম্মান পর্যন্ত করলো না। তাছাড়া মেয়েটার মধ্যে কোনো ভদ্রতা পর্যন্ত নাই। কোনো প্রণাম করলো না। হাই হাই করে কী সব বললো!

রঞ্জনের বাবা : এসব কথা তোমার ছেলেকে জিজ্ঞাসা কর গিয়া। হাই হাই করা বউ নিয়া ঘরে ঢুকছে। তার পেছনে এতো টাকা খরচ করলাম। আর সে কিনা এমন সর্বনাশ করলো!

রঞ্জনের মা : ছেলেটা তো সর্বনাশের মতো কাম করছে। গ্রামের ছেলে হয়ে তার শহরের মেয়ে বিয়ে করা মোটেও উচিত হয়নি।

রঞ্জনের বাবা : এটা কি কইতাছো?

রঞ্জনের মা : ঠিকই কইতাছি। শহরের মেয়েরা গ্রামের পরিবেশে থাকতে চায় না, গ্রামে থেকে সংসার করতে চায় না। ওরা সংসার বুঝে না। ওরা গ্রামে পিকনিক করতে। গ্রামের মানুষদের দেখতে আসে কিছুদিনের জন্যে। গ্রামে থেকে শহরের মেয়েরা করতে চায় না। গ্রাম তাদের ভালো লাগে না। গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না। আমাগো উত্তর পাড়ার ঘটনা তো তুমি জানই। শেষ পর্যন্ত মেয়েটা অজুহাত দেখাইয়া ডিভোর্স দিয়া চইলা গেছে। মেয়েটা শ্বশুর-শাশুড়িকে সম্মান পর্যন্ত করতো না। অশিক্ষিত বলে অবহেলা আর অপমান করতো।

রঞ্জনের বাবা : কি সব বলছো। এই মেয়েটা তো ভালো। তুমি শুনেনি, রঞ্জন বলেছে মেয়েটা ভদ্র ও আধুনিক শিক্ষিত মেয়ে। আমারে কইলো ডেড, আর তোমারে কউলো মম।

রঞ্জনের মা : সাথে ছেলেটাও যেন কেমন হয়ে গেছে। আচ্ছা, বলতো আধুনিক শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা কি এমনই হয়?

রঞ্জনের বাবা : মেয়েটা ভদ্র পরিবারের মেয়ে। তোমার ছেলেতো তাই কইলো।

রঞ্জনের মা : যদি তাই হয়, তাহলে অভদ্র লোকের মেয়ে জানি আরো কেমন হয়!

রঞ্জনের বাবা : আসলে তোমার ছেলেটা একেবারে বোকা। শহরে থেকে কলেজে লেখাপড়া করলো। আর সে আমাদের এতো বড় প্রতিদান দিলো। আমাদের একটু জানানোর প্রয়োজনও মনে করলো না। আচ্ছা, কও তো তোমার ছেলে এই মেয়ে নিয়া কয়দিন সংসার করতে পারবো?

রঞ্জনের মা : আমারো মতিগতি ভালো মনে হচ্ছে না। বউ আমাদের একেবারেই পছন্দ হয় নাই। এখন তুমি গিয়া কও এই বউ ফেরত দিয়ে দিতে।

রঞ্জনের বাবা : বাহ্! এটা কি দোকানের মাল নাকি যে কিনে নিয়ে আসলাম; আর পছন্দ হইলো না, বদল করে নিয়া আসবো।

রঞ্জনের মা : এটা কেমন বউ। শাড়ি পড়ে না, কেমন কেমন জামা কাপড় পড়ে। চুলগুলো লাল লাল। কথাবার্তায় বেটা বেটা ভাব।

শিউলী ঘরের মধ্যে পায়চারী করছিল। তার কাছে গ্রামের পরিবেশ আর এই ঘরে থাকা একেবারে পছন্দ হচ্ছে না। জলের মাছ যেমন ডাঙায় রেখে দিলে লাফালাফি করে, তেমনি তার মনটাও লাফালাফি করছিল। তার ইচ্ছে করছিল একেবারে দৌড়ে ছুটে পালায়। ফিসফিস করে শিউলী বলছিল, ডিজগাস্টিং! এমন নোংরা পরিবেশে আমি কেমন করে থাকবো? এখানে মানুষ থাকে নাকি। চারিদিকে কেমন নোংরা নোংরা।

এমন সময় রঞ্জন ঘরে ঢুকলো। তখন শিউলী বললো, এই যে মশাই। তুমি আমাকে এ রকম পরিবেশে কেন নিয়ে আসছ? তুমি জান না আমি এ ধরনের পরিবেশ একেবারে পছন্দ করি না। তুমি জান না, আমি শিক্ষিত পরিবারের শিক্ষিত আর ভদ্র মেয়ে। আমি এ রকম নোংরা পরিবেশে কিভাবে থাকবো?

রঞ্জন : এখানে নোংরা কি দেখলা? গ্রামের পরিবেশই তো এমন!

শিউলী: তুমি এসব কি বলছো, এটা তো টিনের ঘর। এখানে আমি থাকবো কিভাবে? এখানে আমাকে মানায় বলতো? এখানো কোনো এসি নাই, ফ্যান নাই।

রঞ্জন : আরে, এটা তো টিনের ঘর। এখানে আমি এসি লাগাবো কিভাবে? তুমি জানালা দেখছো না, জানালা দিয়ে প্রকৃতির বাতাস হু হু করে ঢোকে। এর চেয়ে আর কী ভালো আশা করতে পারো বলতো! এখানে গ্রামের বিশুদ্ধ বাতাস পাওয়া যায়। এসি ফেল হয়ে যায়।

শিউলী: তুমিও এসব বলছ? তুমি আমার পরিস্থিতি বুঝতে পারছ তো? আর আমি বা তোমাকে কী বলবো? আমার কিছু বলার নেই।

এরপর শিউলী ধপাস করে খাটের ওপর বসে পড়লো মনমরা হয়ে। শিউলীর কাছে একেবারে কিছুই ভালো লাগছে না।

পরের দিন সকালে শিউলী মাথায় চিরুনি দিতে দিতে বললো, আমি কিন্তু সকালে ভাত খেতে পারবো না। আমার কফি লাগবে, ডিম ভাজি লাগবে, পরোটা লাগবে।

রঞ্জন : গ্রামের মধ্যে এসব চা কফি নাস্তা আমি কোথায় পাবো? এখানে এসব পাওয়া যায় না।

শিউলী: সেটা আমি কী জানি? আচ্ছা, তোমার মা আছে না! তোমার মাকে বলতে পারো আমার জন্যে পরোটা বানিয়ে দিতে!

রঞ্জন : তোমার জন্যে নাস্তা বানাতে তোমার শাশুড়িতে বলতে পারি আমি? এটা কি বলা ঠিক হবে?

শিউলী: মাকে কেন এটা বলা যাবে না? তাছাড়া তাকে এসব বললে সমস্যা কী?

রঞ্জন : ঠিক আছে তুমি কোনো সমস্যা করো না, আমি ব্যবস্থা করছি!

এরপর রঞ্জন ঘর থেকে বের হয়ে তার মাকে গিয়ে বললো, মা, তোমাদের বউ চা নাস্তা ছাড়া কিছু খায় না সকালে। তার জন্যে পরোটা আর চা অথবা কফি বানিয়ে দিও।

রঞ্জনের মা হতবাক হয়ে গেলো ছেলের মুখে এসব কথা শুনে। ভাবলো, ছেলেটা কী শিক্ষা পেয়েছে? এছাড়া তারই বা এত বড় সাহস হয় কিভাবে আমাকে এভাবে কথাটা বলতে? তারপর রঞ্জনের মা বললো, আমি তোমার বউয়ের জন্যে নাস্তা বানাবো? এই কথা তুমি আমাকে বলতে পারলা?

রঞ্জন : আরে মা সে তো সাধারণ মেয়ে না। তাছাড়া তার মতো মেয়ে এই গ্রামে আছে নাকি। এটা তো তোমাদের বোঝা উচিত।

রঞ্জনের মা : বরং তোমার বউকে সকালে উঠে সবার জন্যে নাস্তা তৈরি করতে বলো। সবার আগে ঘুম থেকে উঠে উঠোন বাড়ি ঝাড়ু দিবে আর কলসিতে ভরে পানি আনবে। তারপর রান্নাঘরে ঢুকে নাস্তা তৈরি করবে। এটা একটা বউয়ের জন্যে বড় দায়িত্ব। সংসার এভাবেই শুরু করতে হয়। তোমারই বা এত বড় সাহস হলো কিভাবে আমাকে তোমার বউয়ের জন্যে নাস্তা তৈরি করার কথা বলা?

রঞ্জন : সে তো গ্রামের অন্য মেয়েদের মতো নয়। এটা বুঝতে পারছ না কেন?

রঞ্জনের মা : এটা তুমি বুঝ না। তোমাকে কে বলেছে শহরের মেয়ে বিয়ে করতে? এসব মেয়ে নিয়ে গ্রামের পরিবেশে সংসার করা যায়? আমাদের পাশের বাড়ির সংসারটা এভাবে ভেঙে গেছে সেটা তুমি জান না। তুমি তো লেখাপড়া করে শিক্ষিত হয়েছ, আধুনিক শিক্ষিত হয়েছো। তোমার তো এসব বোঝা উচিত। ওরা শহরের পরিবেশে বড় হয়ে গ্রামে থাকতে পারে? ঠিকতে পারে? তুমি কি বুঝে তাকে বিয়ে করেছো? আমরা গ্রামের মানুষ। ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি, শিখে আসছি, ঘরের বউরা সকালে ঘুম থেকে উঠে উঠোন বাড়ি ঝাড়ু দেয়। তারপর সংসারের অন্যান্য সমস্ত কাজ করে কলসি নিয়ে জল আনে। রান্নাঘরের রান্নাবাড়ি করে। সংসারের সমস্ত কাজ করে। আর এই মেয়েটা কি তোমার সংসারের এসব কাজ করবে? বউ হয়ে আমরা আমাদের শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা যত্ন করেছি। এটাই নিয়ম। আর এখন তোমার বউয়ের সেবা যত্ন করবো? তার জন্যে নাস্তা বানাবো, তাই না? (চলবে)

[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায়]

* পাঠক ফোরামে লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়