প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০
(গত সংখ্যার পর ॥ শেষ পর্ব)
মেয়েটা বোধহয় পথ ভুল করে এখানে চলে এসেছে। বললো মারুফ। তাছাড়া এত রাতে কোন গেরস্থ বাড়ির মেয়ে এখানেই আসবে কেন। আবার পায়ে আঘাতের চিহ্ন দেখ। ইকবাল লক্ষ্য করে দেখলো আসলেই মেয়েটার পায়ে বড় সড় আঘাতের চিহ্ন। হাতেও আঘাত পেয়েছে রক্ত ঝড়ছে। চল গিয়ে দেখি ব্যাপারটা। কোন বিপদে পড়ে আসসে নাকি এখানে। ইকবাল হাত চেপে ধরে। ফিস ফিস করে বলে, চুপ খবরদার। এখানেই দাঁড়া, দেখলি না আগের বার একটা লোক কিভাবে আমাদের সামনে উধাও হয়ে গেল। হয়তো অতিরিক্ত উত্তেজনার কারণে ওটা আমাদের চোখের ভুল ছিলো। মোটেই না মারুফ। যা ছিল স্পষ্ট চোখের সামনে ঘটেছে। কোন মস্তিষ্ক তৈরি কল্পনা নয়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখি ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়।
ওদের কথার মাঝখানেই হঠাৎ কোথা থেকে যেন সেই আগের ধুতি পরা লোকটা ফিরে আসে। কালো মত শুকনা একটা লোক। ওরা লক্ষ্য করে লোক টার মাথার চুল বেশ পাতলা কাঁচা পাকা চুল আর কপাল জুড়ে দগদগে ঘা। লোকটার বা পায়েও অনেকটা জুড়ে ঘা। উন্মাদের মত নাচতে থাকে লোকটা আর মুখে অদ্ভুত শব্দ করে।
মেয়েটা এতক্ষণ হাঁটুতে মুখ গুজে কাঁদছিলো। হঠাৎ মাথা উঠিয়ে হাসতে থাকে। সে এক কলিজা ঠাণ্ডা করে দেয়া বিভৎস হাসি, যা হয়তো ওরা কোনদিনও ভুলবে না। তারা লক্ষ্য লাল রক্তে দাঁতগুলো রঙিন হয়ে আছে মেয়েটার। ঠোটের কোনা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মাঝ বয়সী মেয়েটিও উঠে নাচ শুরু করে।
লোকটি আর মেয়েটি হাত তুলে নাচতে নাচতে আচমকা লাফিয়ে উঠে ভাঙ্গা গরুর গাড়িটার ছইয়েরউপর। অথচ একটু আগেও এই গরুর গাড়িটা এখানে ছিলো না। তারপর সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে যায়। যেন বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে তারা।
ইকবাল আর মারুফ গাব গাছটার আড়ালে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। এতক্ষণে যা দেখেছে তাতে ওদের শরীরের রক্ত পানি হয়ে গিয়েছে। ওরা নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে। কোথাও একটা পেঁচা বিকট স্বরে ডেকে উঠে। একটা হালকা বাতাস বয়ে যায় পুরো বকুলতলাজুড়ে। অনেক্ষণ পর ইকবাল কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে, দে দে দেখলি ব্যাপারটা। ওরা কা... কারা হতে পারে রে।
মারুফের মুখে কোন সারাশব্দ নেই। ইকবাল মারুফের কানের কাছে এসে ফিস ফিস করে বলে, ভাই বেঁচে থাকলে তোর ফুপুর বাড়ি আবারও যাওয়া যাবে। বুঝতে পারছিস কী হচ্ছে এখানে। চল পিছনে হাঁটা ধর। অনেক্ষণ পড় ঢোক গিলে মারুফ বলে, ঠিক বলছিস চল।
ইকবালের হাত ধরে এক পা দু পা করে পিছাতে থাকে মারুফ। প্রায় আধ ঘণ্টা হাঁটার পর আবারও আবিষ্কার করে তারা সেই লাল ইটের মাটি। এক সারি সাজানো ইটভাঙ্গা পালকি গরুর গাড়ি বকুল গাছ। মারুফ মাথা ধরে বসে পড়ে একটা আর্তনাদ করে। পাগলের মত চিৎকার করতে থাকে। আবার... আবারও! সেই, সেই বকুলগাছ! সেই রাস্তা! কী হচ্ছে এসব? কী চায় আমাদের কাছে?
ইকবাল দৌড়ে এসে মারুফকে ধরে। ভয় পেলে চলবে না মারুফ। আমরা দুর্বল হলেই বরং বিপদে পড়বো। আমরা চেষ্টা করতেই থাকবো। এক সময় না এক সময় এই ধাধা থেকে বের হবই। তারপর এমন করে প্রায় ৬/৭ বার ওরা চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিবারই ওরা আগের জায়গায় ফিরে আসে। একসময় ইকবালের হাতে ধরা হারিকেনটুকুর তেল ফুরিয়ে আসে। হারিকেনটা নিভে যায়। সেই সাথে ল্যাম্পপোস্টের আলোটুকু কমে আসতে থাকে। ধপ করে বসে পড়ে দুজনে বকুল গাছতলায়। ইকবাল কাঁপা গলায় বলে, পকেট ম্যাচ আর লোহার টুকরাটা বের করে জ্বালিয়ে রাখ। কিচ্ছু হবে না। আমাকে ধরে রাখ শক্ত করে। মারুফ পকেট থেকে ম্যাচ বের করে লোহার টুকরো পুড়াতে থাকে। চারদিক থেকে অনেকগুলো হাসির শব্দ ভেসে আসতে থাকে। যেন আশপাশে অনেক মানুষ লুকিয়ে আছে ওঁৎ পেতে। একটু পড়েই ঝাঁপিয়ে পড়বে। শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা করে দেয়া সে ভয়ংকর হাসি। হাসির শব্দগুলো ধীরে ধীরে কাছে আসতে থাকে। প্রচণ্ড ঘামতে থাকে ওরা দুই বন্ধু।
খুব সকালে ইকবাল চোখ মেলে দেখে রহিমনগর কবরস্থানে আছে ওরা। পাশের মসজিদ থেকে আজানের শব্দ আসছে। সকালের আলো এখনো ফুটেনি। ইকবাল উঠে দাঁড়াতে শক্তি পায় না। জ্ঞান হারায় আবার। টানা সাতদিন জ্বরে ভুগে ইকবাল। মারুফ মাথায় হালকা ব্যথা পেয়েছে। সাতদিন পর ইকবালের গ্রাম থেকে মুনির চাচা আসেন দেখা করতে। আর এসেই জানান মারুফের ফুপু ছয় মাস আগেই মারা গিয়েছে কলেরায়। আর মারুফের আব্বা সেই খবর মারুফকে জানানো প্রয়োজন মনে করেননি।
ঠিক আসরের পর পর ইকবালের ঘরটায় চেয়ার পেতে বসেন। মারুফ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
অনেক বড় বাঁচা বেচেছো সেদিন তোমরা দুইজনে।
বকুলতলার রাস্তাটায় একটা শত বছরের পুরানো মরা বকুলগাছ ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। আর ওখানে কোন রাস্তা নেই। ঝোপঝাড় জঙ্গল আছে শুধু। আর তার ভিতরই অনেক সুড়ু মাটির পথ যেটা বকুলতলার দিকে যায়।
রাতে কেন দিনেও মানুষ বকুলতলার ধারে কাছে ঘেঁষে না। রাতের বেলা কেউ বেল পুকুরের রাস্তা ধরলে ওখানে এ রকম রাস্তা দেখানো হয়। আর একবার সেই পথে পা রাখলে সারারাত এভাবে পথ ভুল হতেই থাকে। অনেকের মৃত্যুও হয়েছে এভাবে। তাই রাতে কেউ বেলপুকুরের রাস্তা ধরে না। রহিমনগরের বাজারের পথেই যায়। হ্যাঁ, অনেক অনেক বছর আগে সেখানে একটা গ্রাম ছিলো। এক ঘর দুলে বাগদি রা থাকতো। ইকবাল মারুফ কারো মুখে একটা কথা জোগায় না। দুজনে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে। মুনির চাচা উঠে দাঁড়ান। আমি চললাম, তোমরা দুজন সাবধানে থেকো। সামনে তোমাদের আরও বিপদ আছে। তবে ভয় নেই।
ইকবাল আমি তোমার বোন সুরাইয়াকে নিয়ে একটু ডাক্তারের কাছে যাবো। আর হ্যাঁ, আজ কফিলের জন্যই বেঁচে আছো। তবে সতর্ক থেকো। বলেই বেড়িয়ে পড়েন মুনির চাচা।
ইকবাল মারুফ দুজনেই বারান্দায় আসে। মারুফ বলে, তাহলে আমাকে চিঠিকে পাঠিয়েছিলো। মুনির চাচাই কী করে জানলো আর আমরা কবরস্থানেই বা কিভাবে গিয়েছিলাম। ভরাট গলায় ইকবাল বলে উঠলো, কফিল রেখে এসেছিলো। মারুফ লক্ষ্য করে চোখ মুখের ভাষা বদলে গিয়েছে ইকবালের। শক্ত করে রেলিং ধরে রেখেছে ইকবাল।
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে। মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে। পাশের আম গাছটায় ঝুপ করে কী যেন পড়ার শব্দ হয়। আম গাছের সবগুলো কাক আতংকে চিৎকার করতে দৌড়ে পালায়।