শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা গণফোরামের কর্মী সমাবেশ
  •   নিষেধাজ্ঞার প্রথম দিনে ফরিদগঞ্জে অবাধে ইলিশ বিক্রি
  •   পিকনিকে যাওয়া শিক্ষার্থীর মরদেহ মেঘনায় ভেসে উঠলো দুদিন পর
  •   নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি না করার শপথ করিয়েছেন এমএ হান্নান
  •   বিকেলে ইলিশ জব্দ ও জরিমানা

প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

প্রিয়ম্বদা দেবী : রবিরাগে ওকাকুরার শ্বেতকমল

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
প্রিয়ম্বদা দেবী : রবিরাগে ওকাকুরার শ্বেতকমল

বাংলা সাহিত্যে নারী কবির সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়।

পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের যেখানে মানুষ হিসেবে গণ্য হতে লড়াই করতে হয়েছে ঢের, সেখানে কবি কিংবা সাহিত্যিক হিসেবে নারীকে তার মেধার মূল্যায়ন পেতে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে অনেক, এ কথা নিঃসন্দেহে চোখ বন্ধ করেই বলা যায়। কিশোরগঞ্জের পাতুয়ারি ( পাটোয়ারি) গ্রামে ফুলেশ্বরী নদীর তীরে দ্বিজ বংশীর মেয়ে চন্দ্রাবতী (১৫৫০-১৬০০) ছিলেন মধ্যযুগে প্রথম বাঙালি নারী কবি, যাঁর রচনায় মুগ্ধ হয়েছিলো তৎকালীন লেখক সমাজ। চন্দ্রাবতীর উত্তরসূরি অনেকে এলেও যোগ্যতায় নিজেদেরকে এগিয়ে রাখতে পেরেছিলেন কবি কামিনী রায় এবং কবি প্রিয়ম্বদা বন্দ্যোপাধ্যায়। কবি কামিনী রায়ের পথ তত বন্ধুর না হলেও অকাল বৈধব্যের শুভ্রতার দণ্ড নিয়ে কবি প্রিয়ম্বদাকে লড়তে হয়েছে ঢের। মা প্রসন্নময়ী যেমন অকাল বৈধব্যের ছোবলে আহত, তেমনি কন্যাও তার অনুবর্তিনী। যৌবনের সূচনায় যে আঘাতে একজন নারী পর্যুদস্ত হওয়ার কথা, কেবলমাত্র সাহিত্যের প্রতি আপন অনুরাগকে জীবনযুদ্ধে সারথি হিসেবে পেয়ে তিনি লড়ে গেছেন দাপটের সাথে নিয়তির কুরুক্ষেত্রে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠিক দশ বছর পরে ১৮৭১ সালের ১৬ নভেম্বর যশোহরের আলো-বায়ু-জল গায়ে মেখে মাতুলালয়ে জন্ম কবি প্রিয়ম্বদা দেবীর। বাল্যনাম গিরিবালা বাগচীকে ছাপিয়ে কৃষ্ণ বাগচী এবং প্রসন্নময়ীর কন্যা সময় ও নিয়তিকে জয় করে হয়ে উঠলেন প্রিয়ম্বদা দেবী। এ হয়ে ওঠা কেবলমাত্র নামে নয় বরং কর্মে ও কীর্তিতে পরিপূর্ণভাবে হয়ে ওঠা। প্রিয় কথা বলা কিংবা প্রিয় ভাষণ শোনানোর মতো দক্ষতা ও গুণ নিয়েই কবি প্রিয়ম্বদা দেবী নেমেছেন সাহিত্যের সরোবরে অবগাহনে। সমালোচকদের বিরুদ্ধ স্রোতকে উপেক্ষা করে 'রেণু' কাব্যগ্রন্থ দিয়েই প্রিয়ম্বদা জানান দিলেন, সাহিত্যের ধ্বজা নিয়ে তিনি আসছেন জয় করতে, জাগিয়ে তুলতে এবং মৃতপ্রায় আত্মপ্রাণে জীবন দিতে। দুই চোখের দুই তারা স্বামী তারানাথ আর পুত্র তারা কুমারকে অকালে হারিয়ে আঁধার দেখলেও অন্তরের অরুণ তাকে পথ দেখিয়েছিলো বেঁচে থাকার।

ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব লাভ করে নিজেকে ও কবিগুরুকে ধন্য করা কবি রবীন্দ্র বলয়কে উপেক্ষা করতে না পারলেও নিজের জাত চেনাতে চেষ্টা করেছিলেন স্বতন্ত্রভাবে।

রবীন্দ্রনাথের সমীহ লাভ করা কবি প্রিয়ম্বদার কবিতা রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকায় ছাপানোর জন্যে মনোনীত করেন। এমনকি ভুল করে 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় তাঁর নিজের নামে প্রিয়ম্বদার কবিতা যেমন ছাপা হয়ে যায় তেমনি তাঁর নিজ কাব্য সংকলন 'লেখন' গ্রন্থেও কবিগুরু প্রিয়ম্বদার পাঁচটি কবিতা ছাপিয়ে ফেলেন। আসলে দুজনের কবিতার ভাষায় তফাৎ তেমন ছিলো না বলা যায়।

প্রিয়ম্বদার কবিতা স্বভাবে কোমল, সুরে গীতল এবং অনুভূতিতে বিরহপ্রবণ। তার কবিতা প্রসাদগুণসম্পন্ন। অর্থাৎ অর্থপূর্ণ পাঠ ধারণ করে। সহজ-সরল। অনর্থ জঞ্জাল নেই, মানে করতে অর্থের পিছনে ছুটতে হয় না। অমল সবল কিন্তু কোমল কমলের মতই স্নিগ্ধ।

দীর্ঘ কবিতা তার বেশি নেই বললেই চলে। অধিকাংশ কবিতাই নাতিদীর্ঘ। চৌপদী কিছু কবিতা তার আছে, যেগুলো রবীন্দ্রনাথের লেখা বলে ভ্রম হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের 'স্ফুলিঙ্গ' এবং প্রিয়ম্বদার 'পত্রলেখা' কাব্যগ্রন্থ দুটি দুই কবির লেখা বলে বুঝতে পারা কষ্টকর। ১৯৩৫ সালে প্রিয়ম্বদা চির প্রয়াণে গেলে তার চার বছর পর ১৯৩৯ সালে 'চম্পা পাটল' নামে তার সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যার ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। অকাল বৈধব্যের পর একমাত্র পুত্রহারা যে মা কবি হয়ে নিজেকে বিকশিত করে তোলেন, তার কবিতার শক্তিমত্তা কতোটুকু হলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ প্রিয়ম্বদার মরণোত্তর কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা লিখতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়। নিজেকে নিয়তির হাতে সঁপে দিয়ে অন্দরবালা হয়ে বসে না থাকায় তার জননী প্রসন্নময়ীকে যেমন লড়তে হয়েছিল বিরুদ্ধ স্রোতের সাথে, তেমনি প্রিয়ম্বদাকেও লড়তে হয়নি কম, বরং তারচে' আরও বেশি। ১৩০৭ বঙ্গাব্দে যোগেন্দ্র চন্দ্র ‘কৌতুক কণা’ নামে একটি কৌতুক নকশা সংকলন প্রকাশ করেন, যাতে ‘শ্রীমতী প্রিয়ম্বদা দেবী’ নামে একটি রচনা ছিলো। যদিও লেখাটির মধ্যে প্রিয়ম্বদার জীবন-কাহিনির মিল ছিল না মোটেই। বরং মিল ছিল তার মা প্রসন্নময়ীর জীবনের সাথে। রবীন্দ্রনাথের সাথে তার সুসম্পর্ক অনেকের চোখের বিষ হয়ে যাওয়ায় তাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় বিবাহের গুজবও রটাতে তাদের সময় লাগেনি। এ নিয়ে এককাঠি সরেস ছিলেন দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, যিনি ‘আনন্দ বিদায়’ প্রহসনের নামে বিষয়টিকে মঞ্চে তুলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত এ গুজব থামাতে স্বয়ং কবিগুরুকে প্রতিবাদ লিপি লিখে পাঠাতে হয়েছিল ১৩১৭ সনের ৫ শ্রাবণ ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ‘দি বেঙ্গলী’র সহকারী সম্পাদক পদ্মিনী মোহন নিয়োগীর কাছে। অথচ প্রিয়ম্বদা দেবী ১৯১২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানি শিল্পী ও ঐতিহাসিক ওকাকুরা কাকুজোকে প্রণয়ের ফলস্বরূপ পরিণয়ের মাধ্যমে পতিত্বে বরণ করে নিয়েছিলেন একাকিত্বের বন্দিশালা হতে মুক্তি পেতে। কিন্তু অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়। ব্রাইটস রোগ নামক কিডনি বৈকল্যে ওকাকুরা মৃত্যুবরণ করেন ১৯১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর।

কবি প্রিয়ম্বদার কবিতার শক্তিমত্তা যাচাইয়ে ওকাকুরার 'দ্য বুক অব টি' গ্রন্থের প্রশংসার বিপরীতে তার লেখা দুটো পংক্তির উল্লেখ করা যাক। তিনি লিখেছেন,

'শুকান চায়ের পাতা কে জানিত তায়

সবুজ ফাগুন ছিল ভরা কবিতায়।'

পয়ার ছন্দে লেখা উপরোক্ত দুটি চরণে শুধুই কি চায়ের গুণগান গাওয়া হয়েছে, নাকি দুচরণের মধ্যে লুকায়িত আছে অব্যক্ত প্রণয়? চায়ের পাতা শুকিয়ে তাতে চা পানের কৌশল তৈরি হলেও এরই মাঝে যে সজীব যৌবনের দিনগুলো গেঁথে আছে, তা কি কেউ জানতো? আদতে এই ' দ্য বুক অব টি ' উপহারের মাঝেই যে ওকাকুরার প্রণয় এসে পৌঁছেছিল শ্বেতশুভ্র বস্ত্র পরিহিতা কোমল কমলের কতো স্নিগ্ধ প্রিয়ম্বদার কাছে। সেই উপহার পেয়ে তার অকাল বৈধব্যে শুকিয়ে পড়া জীবনেও যে সবুজ ফাগুনের উদ্গম হলো, সেই উচ্ছ্বাস কবি প্রিয়ম্বদা লুকিয়ে রাখতে পারেননি। চায়ের পেয়ালায় ভরে উঠলো তার নব বসন্তের উৎখনিত প্রেমের সুরভি। কিন্তু সেই প্রেম আর স্থায়ী হতে পারলো কোথায়! বেদনাগুলো উৎকৃষ্ট কবিতা হবে বলেই তার জীবন বিরহের অকূল পাথার হয়ে গেল নিমিষেই। ফলে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের 'কল্লোল' পত্রিকার পঞ্চম বর্ষ, নবম সংখ্যায় আমরা বসন্ত ব্যতিরেকে শীতের কুয়াশাকে পাই যা কেবল ধূসর বেদনায় ভরা, আনন্দের লাল-নীল বর্ণিলতা নেই। কবি কত প্রগাঢ় বিরহে বলেন,

'এল শীত, ঘিরে কুয়াশায়,

বরণের ব্যবসায়

পড়ে গেল ছাই,

ধূসরের অধিকার,লাল-নীল নাই আর,

ম্লান মুখে কাঁদে ধরা তাই!

সবুজের বসবাস ছিল যেথা বারোমাস

আজি সেই দেবদারু দীন,

খালি গায়ে হিম বায়ে কাঁপে সারাদিন!

নেড়া গাছ যেন ভাঙা খাঁচা,

পরান-পাখিটি কাঁচা

সবুজ পাখায়

উড়ে গেছে কোন দেশ, কুলায়ের অবশেষ

পড়ে শুধু করে হায়-হায় !'

যারা এ সময়ের প্রিয়ম্বদার মনের খবর জানেন, তারা বোঝেন, এ শীতের প্রতিটি শিশিরে ওকাকুরা জেগে আছে, জেগে আছে কুয়াশার অস্পষ্টতায় প্রিয়ম্বদার হৃদয়ে রক্তক্ষরণের বাষ্প।

জীবনে সুখের দেখা না পেয়ে বঞ্চিত হতে হতে কবি হয়ে ওঠা প্রিয়ম্বদা আক্ষেপে-বিলাপে হায় হায় করে ওঠেন তার কবিতায়,

'হায় সুখ যবে চলে যায়

দিন কাটে শুধু স্মৃতি লয়ে,

প্রিয়জন লইলে বিদায়

প্রাণ থাকে মৃতসম হয়ে।

সুখ শুধু এতটুকু অংশ জীবনের

প্রিয়জন সর্বস্ব তাহার

সুখ গেলে এ জীবনে তবু দিন কাটে

প্রিয় গেলে প্রাণে বাঁচা ভার।'

অবয়বে ওকাকুরা হারিয়ে গেলেও চেতনার ওকাকুরা রয়ে যায় নিঃশ্বাসে বিশ্বাসে। সেই নিঃশ্বাসে প্রিয়তমকে অনুভব করে কবি আবিষ্কার করে তার সত্যটুকু। তারই খুশিতে কিঞ্চিৎ কবি উল্লসিত হয়ে বলতে পারে,

'সব সুখ সব স্মৃতি করিয়া চেতন

অপূর্ব হিল্লোল-ভরে বহিছে পবন,

এতদিন প্রিয়তম অলক্ষিতে বুঝি

নিত্য সত্যটুকু মোর পাইয়াছ খুঁজি!'

একাকিনী কবি দিনমান ভাবতো তার প্রণয়ের সুদিনগুলো। সারাক্ষণ তার মনে হতো, এখানে-ওখানে সর্বত্র প্রিয়তম তার পাশে পাশে আছে তার প্রিয়

'লেডি অব ফ্র্যাগ্রান্স'-এর সুগন্ধি প্রাণ ভরে নিতে। তার শ্বেতকমলের শুভ্রতাকে দুচোখ ভরে আপন করে পেতে। প্রিয়ম্বদার প্রণয়ে মুগ্ধ ওকাকুরাকে হেথায় হোথায় খুঁজতে খুঁজতে কবি শেষমেষ লিখে ফেলেন নিজের মনের অস্থিরতাকে কবিতায়,

'যখনি সুগন্ধ-শুভ্র উত্তরীয় পরে

তুমি এসে দেখা দাও আমার এ ঘরে

অমনি একত্রে আসি বসন্ত-শরৎ

অকস্মাৎ পূর্ণ করে আমার জগৎ।'

কবির বিরহের, প্রণয়ের কবিতাগুলো পড়লে আর বুঝতে অসুবিধা হয় না, পরিণত বয়সের অপরিণত প্রণয় তার মনেপ্রাণে কী প্রলয়ই না এনেছিল! সে প্রলয়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে মনের প্রাচীর। প্রিয় বিচ্ছেদে নিজেকে হতভাগ্য দাবি করে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন তার আত্ম বিলাপ,

'তুমি যতদিন ছিলে, আছিল জীবন

সুমঙ্গল একখানি গৃহের মতন।

সজ্জিত প্রভাত পুষ্পে সন্ধ্যা-দীপ-জ্বালা

প্রচ্ছায় প্রচ্ছন্ন, ধৌত আনন্দে নিরালা।

আজ তাহা রাজপথ, বাধাবন্ধহীন

পড়ে আছে অবারিত ধূলিতে বিলীন :

নাহিকো প্রতীক্ষা কারো, নাহি আয়োজন।'

সনেটে সিদ্ধহস্ত কবি চতুর্দশপদী মিত্রাক্ষরে তার অধিকাংশ কবিতা রচনা করেছেন। কখনো কখনো পয়ারে তিনি তার অনুভূতিকে এতো কোমলভাবে জনমনে ছড়িয়ে দিয়েছেন, মনে হয় কোনো মলয়ের মাধুর্য কানে এসে আলাপ করে গেলো। তিনি কেবল প্রণয়-বিরহ নিয়েই যে কবিতায় সরব ছিলেন তা নয়। তার কবিতায় মহাভারত, মহাভারতের মহা চরিত্র কর্ণ-এসবও জীবন পেয়েছে নতুন করে। পাগলপারা জ্যোৎস্নায় কবি বিমোহিত হয়ে নিজেকে ভেবেছেন বাঁধনহারা। তাকে 'আজি জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে'র আদলে বলতে শুনি,

'জ্যোৎস্না-যামিনী ধরণীতে আজ অমিয়া প্লাবন করে, ঘুমভাঙা মোর পরান-শিশুরে রাখিতে নারিনু ঘরে। দিবা-আলোকে ধৌত নয়ন আজি তার অনিমেষ অমরাবতীরে দেখেছে সে যেন, মর্ত্য-নিশার শেষ। দেখেছে নয়নে অলকানন্দার চির-আনন্দধারা,

পরশে যাহার নিমেষে জীবন সকল পিপাসাহারা।'

অকাল বিধবা নারী বলে বিরুদ্ধ স্রোতকে মাথায় নিয়ে যে কবি সাহসের ভেলা বেয়ে কূল পেতে চেষ্টা করেছেন, তার কবিতায় নারীরা যে সরব ও প্রতিবাদী হবে না এ কথা অভাবনীয়। নারীদের তিনি যথার্থই তার কবিতায় উপজীব্য করে এনেছেন, যাতে ভবিষ্যতের অনুগামীরা আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠতে পারে। তিনি তার সময়ের নারীদের উদ্দেশ্যে 'নারী-মঙ্গল' কবিতায় বলেছেন,

"নারী হয়ে যে রমণী, হায়, শুধু খেলার পুতুল হয়,

ব্যর্থ জন্ম তার, মাতা মোরা, দেবতার সুধার সঞ্চয় বক্ষে বহি দুহিতা আমরা, বিধাতার স্নেহরস-ধারা

মুক্ত করি বসুধার শুষ্ক বুকে, পতিত পাবনী পারা গোমুখীর মুখে, ভগ্নি মোরা, সোদরের ইহজগতের গ্রহতারকার আলোকের সাথী, অন্ধ শ্রান্ত মরতের নিত্য অন্ধকার করি দিয়া দূর, মুগ্ধ প্রেমনেত্রে জ্বালি অরুন্ধতী আলো,পত্নী মোরা মানবের, সংসারের কালি মুছে সদা' গৃহলক্ষ্মী, সাধক-সেবিকা, নম্র পূজারিণী ভক্ত জীবনের, অনাদি করুণাধারা অনন্ত বাহিনী। "

নারীকে জগতের আলো হয়ে উঠতে বলা কবি আলোকের ইতিহাসের মধ্যে নারী সমাজের জেগে ওঠার প্রেরণা খুঁজে পান। কিন্তু নিজেকে তিনি মেঘের জীবন দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন কবিতায়। কেননা, মেঘ তার উৎসের সাথে আবারও মিলার সুযোগ পায়। মেঘের মতো কবিও যদি তার প্রয়াত প্রেমিকের সাথে মিলতে পারতেন, তবে জীবনের বিরহগুলো হৃদয় কাননে কুসুমের সুরভি বিলাতো। কবি তাই বহু ব্যথা সয়ে মেঘের মনঘরে নিজের আকাঙ্ক্ষাকে জমা রেখে 'মেঘের মতন' কবিতায় বলেন,

'মেঘের মতন ভেসে যেতে সাধ,অসীম আকাশ 'পরে, কখনো শুভ্র, কখনো ধূসর, কখনো গেরুয়া পরে। বুকেতে আমার আঁকিয়া আদরে, অতুল বাসবধনু, মুখেতে মাখিয়া তপনের তপ্ত আলোর উজল রেণু- মেঘের মতন ভেসে যেতে সাধ নিখিল বাতাস বহি, পাগল সিন্ধুর বাষ্পের শ্বাস পরশিয়া রহি-রহি। অতলের তার মরম ব্যথার, বেদনা বুকেতে নিয়ে শীতল নয়ন সলিলে তাহার যাতনা জুডায়ে দিয়ে, মেঘের মতন ভেসে যেতে সাধ গৌরীশিখর-শিরে, সকল তাপের অন্তিম মুক্তি শেষের তুফান তীরে...'।

বড়দের কবিসত্তার পাশাপাশি প্রিয়ম্বদা একজন পূর্ণাঙ্গ শিশু সাহিত্যিকও বটে। শিশুদের জন্যে তার মৌলিক লেখা, অনুবাদ সব মিলিয়ে তাকে সর্বকালের এক লেখক হিসেবে চিরস্থায়ী করে রেখেছে। এমনকি চারণ কবি মুকুন্দ দাস তার একটা কবিতায় সুর দিয়ে তাকে গান হিসেবেও প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। কিন্তু দিনশেষে ওকাকুরার প্রেম, রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য, রৌপ্য পদকজয়ী বিদ্যাবেত্তা--এসব কিছু ছাপিয়ে তার বিরহ, তার বেদনা কানে গুঞ্জরিত হয়। বহতা বাতাসের গায়ে কান পাতলে মনে হয় আজও শোনা যায়, গুণাইগাছির বাগচী পরিবারের এক মেয়ে, যার অন্তরের বেদনার ধ্বনি গায়ে মেখে বাতাস ঋণী হয়ে রয়েছে চিরকাল। তারই আকুতি আমরা শুনতে পাই 'সুদূর' কবিতার :

'কত না যামিনী তোমারি লাগিয়া চোখে ঘুম নাই মোর, শূন্য-শয়নে একাকী জাগিয়া ঝরে নয়নের লোর

দয়িত সুদূর, ছাড়ি পরবাস, এসো এ বুকের কাছে, সহজে যেমন অতনু-বাতাস, জীবন জড়ায়ে আছে।'

তথ্যঋণ :

১. প্রিয়ম্বদা দেবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা, বারিদবরণ ঘোষ সম্পাদিত

২. সৃজনশিল্পী : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রিয়ম্বদা দেবী এবং ওকাকুরা কাকুজো, কৃষ্ণা রায়, আনন্দ বাজার, ০৯ জানুয়ারি ২০২২

৩. রবীন্দ্র-প্রিয়ম্বদা / ট্রাজিডি-কমেডি, আবদুশ শাকুর

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়