সোমবার, ০৪ আগস্ট, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৩৯

হৃদয়বতী

মিজানুর রহমান রানা
হৃদয়বতী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

পঁাচ.

হোটেলের ব্যালকনিতে অনন্যা ও ইরফানকে দঁাড়িয়ে থাকতে দেখে রুবিনা ও তাসফিয়া কাছে এলো। এ সময় সচকিত হয়ে উঠলো ইরফান। সে প্রশ্ন করলো, ‘বুঝতে পারছি না। আপনারা আসলেই যাবেন কোথায়?’ ব্যালকনির নীরবতা ভেঙ্গে ইরফান অনন্যাকে জিজ্ঞাসা করলো।

অনন্যা বললো, ‘আমরা নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করেছি। পথের শেষ কোথায় তা’ জানি না।’

‘তাহলে নিশ্চয় আপনাদের মনে কোনো কষ্ট আছে? যার কারণে আপনারা নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করেছেন। বলুন সেই কাহিনী।’

অনন্যা কিছুক্ষণ ইরফানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, ‘আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে আপনাকে আমি চিনি। আপনার কণ্ঠস্বরটা আমি বহুদিন যাবত শুনেছি।’

হেসে উঠলো ইরফান। তারপর বললো, ‘আপনাদেরকে একটা গল্প বলি। দেখুন এই গল্পের সাথে আমাদের জীবনের কোনো সাদৃশ্য আছে কিনা?’

তাসফিয়া খুব উৎফুল্ল হলো, তারপর বললো, ভাইয়া বলুন, বলুন। দেখি আপনার গল্পটা কেমন?

‘গল্পটা একজন মানুষের জীবনের পাওয়া না পাওয়া ও হতাশার গল্প। শুনবেন?’

‘হ্যঁা ভাইয়া। শুনতে চাই। সময়টা তো কেটে যাবে।’

ইরফান বলতে শুরু করলো, ‘মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন। যিনি তঁার প্রেমিকার চিঠি আর ছবি বুক পকেটে রেখে কাটিয়ে দিলেন সারা জীবন। অবশেষে ৮৬ বছর বয়সে গতকাল চলে গেলেন পৃথিবী থেকে নিরুদ্দেশের পথে।’

‘নাম কি ওনার?’ প্রশ্ন করলো অনন্যা।

‘বলবো, বলবো। আগে কাহিনীটা শেষ করি। তঁার নাম তানেসউদ্দিন আহমেদ। মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তবে তঁার প্রেমের গল্প ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। আজব এক প্রেমকাহিনী।’

‘আসলে আমরা তো প্রেম কাহিনী শুনতে চাইনি, বলতে চেয়েছিলাম আপনার কণ্ঠস্বরটা কেমন যেনো চেনা চেনা মনে হচ্ছে--এই আরকি’।

অনন্যা মাঝপথে ইরফানের গল্পে ব্যাঘাত ঘটালো। হাত উঁচিয়ে অনন্যাকে থামিয়ে ইরফান বলতে শুরু করে, ‘বিষয়টা খুব সহজ নয়। তাই বলছি। ওনার জীবনটাই কেটে গেছে একটি কণ্ঠস্বরকে চেনা চেনা মনে হবার কারণে।’

‘তাই নাকি?’ উৎফুল্ল হলো তাসফিয়া। ‘আচ্ছা ভাইয়া, তাহলে বলুন, সেই গল্পা শুনতে চাই।’

‘শোনো যার জন্যে আজীবন চিরকুমার থেকেছেন তানেসউদ্দিন, সেই হচ্ছে তঁার ফুফাতো বোন জোহরা। যার সঙ্গে প্রেম ছিলো তানেসের। এই প্রেমের পেছনে ছিলো আরো একটি প্রেম।’

‘কী বলেন?’ আশ্চর্য হলো অনন্যা। ‘প্রেমের পেছনে প্রেম!’

‘হ্যঁা। যুদ্ধকালীন সময়ে তঁার এক নারী সহযোদ্ধা ছিলো। যুদ্ধ করতে করতে দুজনে কখন যে একে অপরের কাছাকাছি চলে এসেছিলো, তঁারা টেরই পাননি। কিন্তু যুদ্ধ শেষের আগে সেই নারী সহযোদ্ধা, যার নাম ছিলো মোনালিসা, পাক শত্রুদের একটি বুলেটে জীবন চলে যায় তঁার। যুদ্ধ শেষে বুকভরা হতাশা, কষ্ট আর বেদনা নিয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে আসেন। ততোদিনে তঁার ফুফাতো বোন বড়ো হয়েছে। একদিন তার সাথে দেখা। তানেসউদ্দিনের মনে হলো এই সেই মোনালিসা, যার কণ্ঠস্বর জোহরার মতোই।’

‘ওরে বাবা।’ রুবিনা অবাক কণ্ঠে বললো। ‘কী করছেন ইরফান ভাই?’

‘হ্যঁা, বিষয়টা এমনই। সেই কণ্ঠস্বর একই রকম হওয়ার কারণে তানেসউদ্দিন দ্বিতীয়বার প্রেমের টানে জোহরার সঙ্গে দেখা করার জন্যে প্রায়ই সন্ধ্যায় মেঘনা নদী পার হতে হতো নৌকায় করে। দেখা করে আবার নৌকায়ই ফিরতেন তিনি। একদিন তাদের সন্ধ্যায় দেখা হওয়ার কথা। আগে থেকেই জোহরাকে খবর দেওয়া হয়েছিলো। সন্ধ্যায় মেঘনা নদীর ওপারে জোহরা অপেক্ষা করছিলেন। এদিকে পারাপারের জন্যে নেই কোনো নৌকা। কীভাবে ওপারে যাবেন তানেস?

উপায় না পেয়ে উত্তাল জোয়ারের মধ্যে সঁাতার কেটে মেঘনা নদী পার হয়েছিলেন তিনি। এই পাগলামির কারণে জোহরার বকাও খেয়েছিলেন তিনি। তাতে কী, এতে দিনে দিনে তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছিলো। শয্যাশায়ী বাবার পাশে বসে জোহরা তরুণ তানেসকে কথা দিয়েছিলেন, কোনোদিনও ছেড়ে যাবেন না। এভাবেই চলছিলো তাদের সময়গুলো। কিন্তু একদিন খবর এলো, জোহরা আর তার বাবাকে দুষ্কৃতকারীরা গুলি করে হত্যা করেছে। এই খবর শুনে তানেস অনেকটা হতাশ হয়েছিলেন। ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তাই জোহরার স্মৃতি অঁাকড়ে বেঁচে থাকতে শুরু করেন।

গত ৫৪ বছর যাবৎ প্রেমিকার স্মৃতি অঁাকড়ে বেঁচেছিলেন তিনি। তারপর গত ১৭ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। এই হচ্ছে কণ্ঠস্বরের কাহিনী। বুঝতে পারলে কিছু?’

‘না, আসলে আমি বুঝতে পারিনি। কাহিনীটা বেশ কষ্টদায়ক। মোনালিসা ও জোহরার কণ্ঠস্বরের মিল থাকায় ওনাদের মধ্যে আবার প্রেম হয় এটা বুঝলাম। কিন্তু আমি যে বলেছি, আপনার কণ্ঠস্বরটা আমার চেনা চেনা মনে হচ্ছে, এটার বিষয়টা তো বুঝলাম না। আমি কি কখনো আপনাকে দেখেছি, কথা বলেছি?’ প্রশ্ন করলো অনন্যা।

‘সব কথার উত্তর সহজেই মিলে না। কিছু কিছু উত্তর সময় নিজেই দিয়ে দেয়। আর এর জন্যে ধৈর্য ধারণ করতে হয়। মানবজীবনের অনেক উত্থান পতনের সাথে জড়িয়ে থাকে কিছু কিছু টুকরো টুকরো গল্প। সেটাকে এক ফ্রেমে গেঁথে তারপরই রচিত হয় উপন্যাস, নাটক, সিনেমা। কিন্তু কাহিনীটা একদিনের নয়। বহুদিনের। এই বিশ্ব একদিনে গড়ে উঠেনি। সময় নিয়ে লক্ষ-কোটি বছর। তাই তোমার প্রশ্নের উত্তরটা জমা থাক এখানেই। উত্তরটা পেয়ে যাবে যথাসময়ে।’

ইরফান রহস্যময় কথাগুলো বলে সাগরের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।

অনন্যা, রুবিনা, তাসফিয়া এ কথাগুলো শুনে যেনো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না।

(চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়