প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
কোনো ভাষার শুদ্ধ লিখন, পঠন এবং বলন পদ্ধতিকেই ব্যাকরণ বলে। মানবজীবন পরিচালনার জন্য স্রষ্টা প্রদত্ব কিছু নিয়মকানুন জীবনকে শুদ্ধ থেকে পরিশুদ্ধ করে। যারা এ নিয়মকানুন মেনে জীবন পরিচালনা করে তাদেরকে স্রষ্টা সফল জীবনের ঘোষণা দিয়েছেন। সূরা আ'লার ১৪নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, যারা নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে তারাই সফলতা অর্জন করেছে। হাদিস শরীফে রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে আর তার কাছে পর্যাপ্ত রিজিক এসেছে এবং সে তার উপর তুষ্ট থাকার তৌফিক অর্জন হয়েছে ঐ ব্যক্তি সফলতা অর্জন করেছে। (তিরমিজিঃ ২৩৪৮)
জীবনব্যবস্থার এ ব্যাকরণকে সূরা আলে ইমরানের ১৯নং আয়াতে 'ইসলাম' নামে নামকরণ করে ইরশাদ হয়েছে, "নিশ্চয়ই ইসলাম আল্লাহ তা’য়ালার নিকট মনোনিত একটি জীবনব্যবস্থা ।" সূরা মায়েদার ৩নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, আজ আমি ইসলামকে তোমাদের জীবনব্যবস্থা হিসেবে পূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম, শুধু তাই নয়; ইসলামকে তোমাদের জন্য দীন হিসেবে পছন্দ করলাম।
দীন নামক এ জীবনব্যবস্থার সংবিধান হলো কুরআনুল কারিম। সূরা আলে ইমরান ঃ ১০২নং আয়াতে গোটা মানবজাতির উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’য়ালা আদেশ করেছেন ঃ তোমরা আল্লাহর রশিকে দৃঢ়তার সাথে আকড়ে ধরো, খবরদার! তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না।
মানবজীবনের প্রতিটি স্তরকেই কুরআন প্রত্যক্ষ ও পরক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে । শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে নিয়ন্ত্রণে ইরশাদ হয়েছে ঃ সে দিন তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে মুখে মোহর লাগিয়ে দেওয়া হবে। আর হাত কথা বলবে এবং পা সাক্ষ্য দিবে। (সূরা ইয়াছিন ঃ ৬৫)
পরিবার গঠন, ধর্ষণ ও ইভটিজিং প্রতিরোধে সূরা নূরের ৩২নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছেঃ তোমরা তোমাদের অধীনস্তদের বিবাহ সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও। এতে যদি তোমরা অভাবগ্রস্ত হও তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে নিজ দয়ায় অভাবমুক্ত করে দিবেন; জেনে রেখো,আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।
সামাজিকিকরণে সূরা লোকমানের ১৯নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে ঃ কথা বলার সময় তোমরা কণ্ঠ স্বরকে নিচু করো, নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর। সূরা বাকারার ৮৩নং আয়াতে বলা হয়েছে ঃ মানুষের সাথে সুন্দর ও উত্তম তথা প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলো। সূরা বনি ইসরাঈলের ৩৬নং আয়াতে বলা হয়েছে ঃ যে বিষয়ে তোমাদের জ্ঞান নেই, সে সম্পর্কে জ্ঞানহীন অসাড় কথা বল না। একই সূরার ৩৭নং আয়াতে আরও বলা হয়েছে ঃ দম্ভভরে বা অহংকারে পদচারণা করো না। নিশ্চয় তুমি তো ভূ-পৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না। রাসূল (সাঃ) কে মডেল পেশ করে সূরা হিজরের ৮৮নং আয়াতে আল্লাহ আরও বলেন, আপনি ওই বস্তুর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাবেন না, যা আমি তাদের মধ্যে কয়েক প্রকার লোককে ভোগ করার জন্য দিয়েছি, তাদের জন্য চিন্তিত হবেন না এবং ঈমানদারদের জন্য স্বীয় বাহু নত করুন।
সামাজিক মূল্যবোধ নিয়ন্ত্রণে সূরা হুজরাতের ৯-১২নং আয়াতে ইরশাদ করেন ঃ যদি মুমিনদের দুই দল বিবাদে লিপ্ত হয়, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের ওপর চড়াও হয়, তবে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিপক্ষাবলম্বন করবে; যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি ফিরে আসে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়ানুগ পন্থায় মীমাংসা করে দিবে এবং ইনছাফ করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনছাফকারীদেরকে পছন্দ করেন। সাদাকালো, উঁচুনিচু ধনিনির্ধনের ভেদাভেদ ভুলিয়ে আল্লাহ বলেন ঃ মুমিনগণ, কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এরকম কাজ থেকে তওবা না করে তারাই জালেম। আরও বলেন ঃ মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয়ই কতক ধারণা গোনাহ। আর গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়াকে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু।
সূরা বাকারার ২৮৫নং আয়াতে আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করে সুদকে হারাম করেছেন এবং ২৮৮ ও ২৮৯নং আয়াতে বলেছেন ঃ তোমরা যদি মুমিনের সাইনবোর্ড পেতে চাও তাহলে সুদকে পরিহার কর। আর যদি তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নাও।
রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কেও কুরআন সূরা মায়েদার ৪৪নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে ঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার করে না, তারা পরিপূর্ণ কাফির। তারা জালিম, তারা পাপাচার!
এদের শাস্তি সম্পর্কেও আল্লাহ বলেছেন ঃ যারা কুফরী করে তাদের জন্য আছে জাহান্নামের আগুন। তাদের মৃত্যুর আদেশ দেওয়া হবে না যে, তারা মরবে এবং তাদের জন্য জাহান্নামের শাস্তিও লাঘব করা হবে না। এভাবে আমি প্রত্যেক অকৃতজ্ঞকে শাস্তি দিয়ে থাকি। সেখানে তারা আর্তনাদ করে বলবে ঃ হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে নিস্কৃতি দিন, আমরা সৎ কাজ করব, পূর্বে যা করতাম তা আর করব না। আল্লাহ বলবেন ঃ আমি কি তোমাদেরকে এত দীর্ঘ জীবন দান করিনি যে, তখনতো সতর্ক হতে চাইলে সতর্ক হতে পারতে? তোমাদের নিকটতো সতর্ককারীরাও এসেছিল। সুতরাং শাস্তি আস্বাদন কর; জালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই। এভাবেই ইসলাম করআনিক কানুন প্রয়োগ করে মানবজীবনের প্রতিটাস্তরকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। তাই আসুন জীবনকে তার সঠিক নিয়মে পরিচালিত করি আর মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জন করি।
লেখক : খতিব, রেলওয়ে কাঁচা কলোনী জামে মসজিদ, চাঁদপুর।