প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
৮ রাকাত নয়, সহীহ হাদিসের ভিত্তিতে তারাবির নামাজ ২০ রাকাত
রামাদান মাসের রাতে ইশার নামাজের পর এবং বিতর নামাজের আগে দুই দুই রাকাত করে ১০ সালামে যে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা হয়, একে তারাবি নামাজ বলা হয়। আরবি ‘তারাবিহ’ শব্দটির মূল ধাতু ‘রাহাতুন’ অর্থ আরাম বা বিশ্রাম করা। বিশেষ করে প্রতি চার রাকাত পর একটু বসে বিশ্রাম করতে হয় এবং দোয়া ও তসবিহ পাঠ করতে হয়। এ জন্য এই নামাজকে ‘সালাতুত তারাবিহ’ বা তারাবি নামাজ বলা হয়।
রামাদান মাসের নির্দিষ্ট নামাজ হচ্ছে সালাতুত তারাবিহ। তারাবি নামাজ জামাতে পড়া (মহিলাদের বাসায় পড়তে হবে) ও সম্পূর্ণ কোরআন শরিফ একবার খতম করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজে তারাবির নামাজ পড়েছেন এবং সাহাবায়ে কিরামকেও পড়ার জন্য আদেশ দিয়েছেন। তারাবির নামাজের রাকাতের বিষয়ে বিভিন্ন সংখ্যা পাওয়া যায়। তবে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ও সর্বজন সমর্থিত হলো ২০ রাকাত।
তারাবীহর নামাজ ৮ রাকায়াত মনে করাটাই বেদায়াত। আর ৮ রাকায়াত মনে করে এর উপর আমল করা হলো বেদায়াতের উপর আমল করা। ১৪০০ বছর পর পথভ্রষ্ট ব্যক্তির ফতোয়ার উপর ভিত্তি করে ৮ রাকায়াত তারাবীহর সূচনা ঘটে মুসলিম উম্মাহ কিছুর মধ্যে। যখন এই বেদায়াত আমলের দলিল বুখারী থেকে দেয়া হয় তখন অবশ্যই এর বিরোধিতা ব্যাপকভাবে হওয়া চাই। সাধারণ মানুষ যেন গুটি কয়েক লোকের কথার দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অবস্থান থেকে ছিটকে না পড়ে।
২০ রাকাত তারাবি নামাজের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে পুণ্য লাভের আশায় রামাদানের রাতে তারাবি নামাজ আদায় করে, তাঁর অতীতকৃত পাপগুলো ক্ষমা করা হয়।" (বুখারি ও মুসলিম)।
মাহে রামাদানে রোজা, তারাবি নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদতের দরুণ আল্লাহ তাআলা রোজাদার ব্যক্তির আগের সব গুনাহ মাফ করে দেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে পুণ্য লাভের আশায় রোজা রাখে, তারাবি নামাজ পড়ে এবং কদরের রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত করে, তাঁর জীবনের পূর্বের সব গুনাহ মাফ করা হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (দঃ) সর্বদা তারাবি নামাজ জামাতে পড়েননি। কারণ, নবীজি (সাঃ) মনে করেছিলেন যে যদি তিনি সর্বদা জামাতে তারাবি নামাজ আদায় করেন, তাহলে তাঁর উম্মতের উপর এটি ফরজ হয়ে যেতে পারে। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আরো ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা রামাদানের রোজাগুলো ফরজ করেছেন এবং এর রাতে তারাবি নামাজের জন্য দণ্ডায়মান হওয়াকে অশেষ পুণ্যের কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।’
আল্লাহ আমাদের তারাবির নামাজের অপরিসীম ফজিলত এবং জামাতে খতম তারাবি আদায়ের মাধ্যমে অধিক পুণ্য লাভের তাওফিক দান করুন! আমিন!!
সহিহ হাদিসে তারাবির নামাজ
১. হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (দঃ) রমজান মাসে বিশ রাকাত এবং বিতির পড়তেন। {মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা -২/২৯৪, হাদীস নং- ৭৬৯২, মুসনাদে আব্দবিন হুমাইদণ্ড২১৮, আল মুজামুল কাবীর, হাদীস নং-১২১০২, মাজমাউজ যাওয়ায়েদ, হাদীস নং-১৭২, সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-৪৩৯১}
এবার দেখার বিষয় হলো, উম্মতের ঐকমত্যের আমল এর উপর আছে কি নেই? যদি দেখা যায় যে, উম্মতের আমল এর উপরই। তাহলে আমল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার দ্বারা উক্ত হাদীস সহীহ হয়ে যায়।
ওমর (রাঃ) এর আদেশ :
২. হযরত ইয়াহইয়া বিন সাঈদ থেকে বর্ণিত। নিশ্চয় ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ) এক ব্যক্তিকে বিশ রাকাত পড়ার হুকুম দিলেন। {মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-২/২৯৩}
হযরত ওমর (রাঃ)-এর শাসনামল
৩. হযরত সায়েব বলেনঃ হযরত ওমর (রাঃ) এর সময়কালে বিশ রাকাত তারাবীহ ছিল। {ফাতহুল বারী-৪/৪৩৬} যার সনদ বুখারীতে দুই স্থানে আছে।
৪. হযরত সায়েব বিন ইয়াজিদ (রাঃ) বলেনঃ আমরা হযরত ওমর (রাঃ) এর শাসনামলে বিশ রাকাত তারাবীহ ও বিতির পড়তাম। {সুনানে সুগরা লিল বায়হাকী, হাদীস নং-৮৩৩, মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদীস নং-১৪৪৩}। ইমাম নববী রহঃ, সুবকী রহঃ [শরহুল মিনহাজ], মোল্লা আলী কারী রহঃ [শরহুল মুয়াত্তা] ও সুয়ুতী রহঃ এ বর্ণনাকে সহীহ বলেছেন।
৫. মুহাম্মদ বিন কাব কুরজী বলেনঃ ওমর ফারুক (রাঃ) এর শাসনামলে লোকেরা রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবীহ ও তিন রাকাত বিতির পড়তেন।
৬. হযরত ইয়াজিদ বিন রূমান বলেনঃ লোকে হযরত ওমর (রাঃ) এর শাসনামলে বিশ রাকাত তারাবীহ এবং তিন রাকাত বিতির রমজান মাসে আদায় করতো। {মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদীস নং-১৪৪৩, মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং-৩৮০, সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-৪৩৯৪}
৭. হযরত হাসান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। হযরত ওমর (রাঃ) লোকদেরকে হযরত উবায় বিন কাব (রাঃ) এর কাছে একত্র করে দিলেন। আর তিনি লোকদের বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াতেন। {সুনানে আবু দাউদণ্ড১/২০২, সিয়ারু আলামিন নুবালা-১/৪০০}
৮. হযরত উবায় বিন কাব (রাঃ) বলেনঃ হযরত ওমর (রাঃ) আমাকে এই মর্মে আদেশ দিলেন যে, আমি যেন লোকদেরকে তারাবীহ পড়াই। তখন বিশ রাকাত পড়া হতো। {কানযুল উম্মাহ- ৮/২৬৪}। ইমাম বায়হাকী, আল্লামা বাজী, কাশতাল্লানী, ইবনে কুদামা, ইবনে হাজার মক্কী, তাহতাবী, ইবনে হুমাম, বাহরুর রায়েক প্রণেতা (রহঃ) প্রমুখগণ এ ব্যাপারে একমত হয়ে বলেন, হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) এর শাসনামলে বিশ রাকাত তারাবীহের উপরই সকলের সিদ্ধান্ত স্থির হয় এবং এভাবেই চলতে থাকে।
ইংরেজ আমলের পূর্বে কোনো একজন মুহাদ্দিস বা ফক্বীহ এটাকে অস্বীকার করেননি। আর সুন্নত হওয়ার জন্য সেটির নিরবচ্ছিন্ন হওয়া শর্ত। তাই এই বিশ রাকাত তারাবীহ সুন্নাতে ফারূকী হয়েছে। এ সেই ওমর (রাঃ), যার ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, যদি আমার পর কোনো নবী হতো তাহলে নবী হতো ওমর (রাঃ)।
তিনি আরো বলেছেন, দ্বীনের ব্যাপারে সবচে’ মজবুত হলেন ওমর (রাঃ)। রাসুল (দঃ) আরও বলেছেন, ওই সত্ত্বার কসম, যার আয়ত্বে আমার প্রাণ, শয়তান কখনো তোমার (ওমর (রাঃ) চলার পথে তোমার সঙ্গে মিলিত হয়নি। বরং তোমার রাস্তা ছেড়ে অন্য রাস্তায় চলে গেছে। মুসলিম শরীফ, ৭ম খণ্ড-হাদিস নম্বর-৬০২৫। সুবহানআল্লাহ।
এছাড়া ওমর ইবনে খাত্তাবকে (রাঃ) রাসুল তত্ত্ব জ্ঞান সম্পন্ন বলেছেন। যার অর্থ- গোপন প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত। তত্ত্ব জ্ঞানকে আরবিতে ইলহাম বলা হয়। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামিন হযরত ওমরকে (রাঃ) এমন সুক্ষ্ম জ্ঞান দান করেছেন যে তিনি বিভিন্ন সময় যে মতামত ও সিদ্ধান্ত দিয়েছেন পরে তা সঠিক সিদ্ধান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রিয় নবীজি তাঁর পরে হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত ওমরের (রাঃ) অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
হুজাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলেছেন, আমার পরে তোমরা তাদের মধ্যে আবু বকর ও ওমরের অনুসরণ করবে। তিরমিজি,ষষ্ঠ খণ্ড-হাদিস নম্বর-৩৬০১।
হযরত ওমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) যার এতো মর্যাদা, যিনি এতো জ্ঞানের অধিকারী সেই ওমরই (রাঃ) তারাবির নামাজ বিশ রাকআত জামায়াতে পড়ার প্রচলন করেন। যদি বিশ রাকাত তারাবীহ নামাজ বিদআত হয়, তাহলে হযরত ওমর (রাঃ) সহ সে সময়কার সমস্ত আনসার ও মুহাজির সাহাবীগণের বিদআতি হওয়ার আবশ্যক হয়!!! নাউযুবিল্লাহ।
হযরত উসমান (রাঃ)-এর শাসনামল
হযরত সায়েব বিন ইয়াজিদ বলেন, হযরত ওমর (রাঃ)-এর শাসনামলে লোকেরা বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। আর হযরত উসমান (রাঃ)-এর শাসনামলে লম্বা কেরাতের কারণে লাঠির উপর ভর দিতেন। {বায়হাকী -৪/২৯৬}।
হযরত উসমান (রাঃ)-এর শাসনামলের কেউ বিশ রাকাত তারাবীহকে বিদআত বলেছে এমন একজন ব্যক্তিও পাওয়া যাবে না।
হযরত আলী (রাঃ)-এর শাসনামল
হযরত আবু আব্দুর রহমান সুলামী বলেন, হযরত আলী (রাঃ) রমজান মাসে কারীদের ডাকতেন। তারপর তাদের মাঝে একজনকে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াতে হুকুম দিতেন। আর বিতিরের জামাত হযরত আলী নিজেই পড়াতেন। {বায়হাকী-৪/৪৯৬}
হযরত আবুল হাসনা বলেন, হযরত আলী (রাঃ) এক ব্যক্তিকে বিশ রাকাত পড়াতে হুকুম দিয়েছেন। {সুনানে কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং-৪৮০৫, ৪৩৯৭, কানযুল উম্মাল, হাদীস নং-২৩৪৭৪}
এটাও মনে রাখতে হবে যে, এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হল যে, বিশ রাকাতওয়ালা নামাজের নাম তারাবীহ হযরত আলী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। কোনো খোলাফায়ে রাশেদীন বা কোনো সাহাবী আট রাকাতের সাথে তারাবীহ শব্দ উচ্চারণ করেননি। হাদীস ভাণ্ডারে এর কোনো প্রমাণ নেই।
হযরত জায়েদ বিন ওহাব বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) আমাদের তারাবীহ পড়িয়ে ফারিগ হতেন এমতাবস্থায় যে, তখনো রাত অনেক বাকি থাকতো, ইমাম আমাশ বলেন, তিনি বিশ রাকাত তারাবীহ আর তিন রাকাত বিতির পড়াতেন। {কিয়ামুল লাইল -১৫৭}।
জমহুর ও মশহুর সাহাবাগণ (রাঃ)
হযরত ইমাম আবু হানীফা রহঃ, হযরত ইবরাহীম [মৃত্যু-৯৬হিজরী] থেকে বর্ণনা করেন যে, নিশ্চয় লোকেরা [সাহাবী ও তাবেয়ীগণ] রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তো। {কিতাবুল আসার লিআবী ইউসুফ}
হযরত আব্দুল আজীজ বিন রফী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত উবায় বিন কাব (রাঃ) লোকদেরকে রমজান মাসে মদীনা মুনাওয়ারায় বিশ রাকাত তারাবীহ এবং তিন রাকাত বিতির নামাজ পড়াতেন। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-২/৩৯৩}
হযরত আতা [মৃত্যু-১১৪হিজরী] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি লোকদের [সাহাবী ও তাবেয়ীগণ] বিশ রাকাত তারাবীহ এবং তিন রাকাত বিতির পড়তে দেখেছি। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-২/৩৯৩}
তাবেঈদের মতে তারাবির নামাজ
হযরত সুয়াইদ বিন গাফালা যিনি বয়সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মাত্র তিন বছরের ছোট ছিলেন। তিনি ইমামতি করাতেন। হযরত আবুল হাজীব বলেন, হযরত সুয়াইদ বিন গাফালা রমজান মাসে আমাদের জামাতের সাথে পাঁচ তারবিহায় বিশ রাকাত নামাজ পড়াতেন। {বায়হাকী-২/৪৯}
হযরত আবুল বুখতারী রহঃ বলেনঃ তিনি রমজানে বিশ রাকাত ও তিন রাকাত বিতির পড়তেন। {মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-৭৬৮৬ (চলবে)।