প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
মৃত্যু একটি কষ্টদায়ক ব্যাপার। সকলে স্বভাবতই এটাকে কঠিন মনে করে থাকে। হজরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা বলেন, ‘আমাদের সকলেই মৃত্যুকে অপছন্দনীয় মনে করে। কিন্তু বিবেকের তাগিদ অনুসারে এটাকে কঠিন মনে করা উচিত নয়। তবে এটা যেন কঠিন রূপে আত্মপ্রকাশ না করে অতি সহজে রূপ নিয়ে আগমন করে, সেজন্য নেক কাজের পাবন্দি করা এবং গুনাহের কাজ হতে বিশেষ সতর্কতার সহিত বেঁচে থাকা অপরিহার্য, আর মৃত্যুর স্বরণ এই ব্যাপারে বিশেষ সহায়ক।’ শুভ মৃত্যু হল ঈমানের সহিত মৃত্যুবরণ করা। মুমিন ব্যক্তির এটাই পরম কাম্য। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ্ তা’আলা যখন কোন বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন তাকে মাধুর্য দান করেন। সাহাবীগণ এই মন্তব্যের তাৎপর্য জানতে চাইলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ্ তাকে সচ্চরিত্র এবং সৎকাজের ক্ষমতা দান করেন, আর সে মৃত্যু এসে পড়ার পূর্বেই নেকী সঞ্চয় করে নেয় এবং তার মধুর ব্যবহারে সকলেই তার প্রতি সন্তুষ্ট ও প্রীত থাকে। হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন আল্লাহ্ কোনও বান্দাকে নেকবখত করতে চাইলে, তার মৃত্যুর এক বছর পূর্বেই তিনি (আল্লাহ্) একজন ফেরেশতাকে তার নিকট পাঠিয়ে দেন, আর সেই ফেরেশতা তার দোষ-ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা করেন এবং তাকে নেক-আমলের দিকে উৎসাহিত করেন। এইভাবে নেক-আমল করতে করতে সে দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহণ করে, তখন লোকেরা তার সম্পর্কে বলাবলি করে যে, অমুক ব্যক্তি নেককার অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। এইরূপ ব্যক্তির নিকট যখন ‘মালাকুল-মউত’ এসে উপস্থিত হন, তখন আল্লাহ্ তা’আলা আখেরাতে তার জন্য নির্ধারিত স্থানটি দেখিয়া দেন, আর সে তার নেক আমলের প্রতিদানে যেসব নেয়ামত লাভ করবে, তার সবই দুনিয়াতে থাকা অবস্থায় দেখিয়ে নেয়।এসব অফুরন্ত নেয়ামত দেখে তার রূহ্ অনন্ত রাজ্যে গমনের জন্য আনন্দে অধীর হয়ে উঠে। সে তখন আল্লাহ্র সান্নিধ্যে গমন করাকে পরম কাম্য মনে করে আর আল্লাহ্ তা'আলাও তার সাক্ষাৎকে পছন্দ করেন। এই অবস্থায় মৃত্যুর ফেরেশতা তার রুহ্ কবয করেন। অপরদিকে আল্লাহ্ তা'আলা যাকে হতভাগ্য করতে চান, তার মৃত্যুর একবছর আগে তার নিকট শয়তানকে পাঠিয়ে দেন। তখন থেকে শয়তান তাকে নানাভাবে গোমরাহ্ করার কাজে লিপ্ত হয়। ফলে লোকটি শেষ পর্যন্ত অশুভ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে এবং লোকেরাও তার সম্পর্কে বলাবলি করে যে অমুক লোক মন্দ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। এইরূপ ব্যক্তিকেও মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে আখেরাতের স্থান দেখিয়ে দেওয়া হয়। এটা দেখে তার আত্মা ভয়ে দেহের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকে আর সে মৃত্যু বরণকে অবাঞ্ছিত মনে করে থাকে। এমতাবস্থায় ‘মালাকুল মাউত’অতি নিষ্ঠুরভাবে তার রূহ্ কবজ করেন। হজরত ওহায়েব ইবনুল ওয়ারদ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন আল্লাহ্ তা'আলা যদি কোন বান্দার প্রতি রহম করতে চান, তাহলে তিনি তাকে রোগ-শোক, বিপদণ্ডআপদ, অন্নকষ্ট ও অভাব-অনটনে পতিত করেন, যেন তার গুনাহের কাফ্ফারা হয়ে যায়। এটার পরও যদি তার কিছু গুনাহ অবশিষ্ট থাকে, তাহলে তাকে মৃত্যু-মুহূর্তে কষ্টে পতিত করেন। ফলে, সদ্য-ভূমিষ্ট শিশুর মতো সম্পূর্ণ নিষ্পাপ হয়ে সে আল্লাহ্ তা'আলার দরবারে প্রত্যাবর্তন করেন। অপরদিকে আল্লাহ্ যাহাকে শাস্তি প্রদান করতে চান, তার সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘যে সমস্ত নেক কাজ সে করে, তার বদলে আমি তাকে শারীরিক সুস্থতা, আর্থিক সচ্ছলতা ও ধন-জনের প্রাচুর্য দান করি এবং তার ঘরে সুখ-শান্তি স্থাপন করে দেই। তার পরও যদি তার কোনও নেকির বদলা পাওয়া বাকী থাকে, তাহলে আমি মৃত্যুকে তার জন্য সহজ করে দিই। এইভাবে সে যখন আমার দরবারে ফিরে আসে, তখন কোনও নেকী থাকে না,যার উছিলায় সে দোজখ হতে রক্ষা পেতে পারে। হজরত যায়েদ ইবনে আসলাম রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু হতে বর্ণিত, যদি কোন মুমিন ব্যক্তির গুনাহ অবশিষ্ট থাকে,যা তার নেক-আমলের বদলে মুছে যায় নি, তাহলে মৃত্যু-যন্ত্রণা সেই গুনাহ মুছে দিয়ে তাকে বেহেশতে পৌঁছিয়ে দেয়। আর যখন কোনও কাফের কোন নেক কাজ করে, তখন তার জন্য মৃত্যুকে ‘গুনাহ দেওয়া হয়, যেন দুনিয়াতেই তার নেক কাজের প্রতিদান দেওয়া যায় এবং দোযখে তার ঠিকানা নির্ধারিত হয়। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছেন হুজুর! মৃত্যুর কষ্ট কীরূপ? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন 'কন্টকযুক্ত একটি বৃক্ষ-শাখাকে রেশমি কাপড়ের সাথে পেছিয়ে টানলে যেমন কাপড়ের তানা-বানাগুলি ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে আঁশে পরিণত হয়ে যায়, মৃত্যুর যন্ত্রনাও ঠিক তেমনই। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকটে উপস্থিত থেকে তোমরা তাকে কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ’ পাঠ করে শুনাবে এবং তাকে বেহেশতের খোশ্ খবর জানাবে। কেননা, এই সময়টি এতই সংকটময় যে, বড় বড় জ্ঞানী এবং বিচক্ষণ লোকও তখন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তদুপরি শয়তান তখন তার ঈমান নষ্ট করার ফিকিরে লিপ্ত থাকে। আমি পাক-জাতের নামে কসম করে বলতেছি, মালাকুল-মউতকে দেখা এক হাজার বার তরবারির ঘা খাওয়ার চাইতেও বেশী কষ্টদায়ক।' (কানযুল ইরফান-৬১) হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে খাঁটি মুমিন না বানিয়ে কবরে নিও না এবং আমাদের উত্তম মৃত্যু দান করিও।
লেখক : (মুহাদ্দিস) দাসাদী ডি.এস.আই.এস. স্নাতকোত্তর কামিল (এম.এ), মাদ্রাসা, চাঁদপুর। ০১৭২৩৩৯১৭১৯