শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

ইখলাস : ইবাদত কবুলের অন্যতম শর্ত
মুফতি মাওলানা মোঃ জাফর আলী

আল্লাহ তাআলা মানুষ ও জীন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য। আল্লাহর বান্দা হিসেবে আমাদের অন্যতম দায়িত্ব হলো তাঁর বন্দেগী করা।

ইবাদত কবুলের একান্ত আশায় মানুষ অনেক কষ্ট-সাধনা করে ইবাদত পালন করে থাকে। কিছু মানুষ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ইবাদত করে। লোক দেখানো অথবা শোনানোর প্রবণতা থাকার ফলে ইবাদত গ্রহণযোগ্যতা পায় না। ইবাদত কবুল না হওয়ার যে সকল কারণ রয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হলো ইখলাসের অনুপস্থিতি।

ইখলাস মানে একনিষ্ঠতা, লোক দেখানো অথবা শোনানোর ইচ্ছা ব্যতীত কোন কাজ করা। পারিভাষিকভাবে, একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে কাউকে দেখানো অথবা শোনানোর ইচ্ছা ব্যতীত কোন কাজ করার নাম ইখলাস।

মানব জীবনের সকল পর্যায়ে ইখলাসের গুরুত্ব অপরিসীম। ইবাদত কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত এটি। ইবাদত গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য হাদীস শরীফে দু‘টি শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ ইখলাস ও তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য ব্যতীত কোন ইবাদত কবুল করবেন না। (সুনান নাসায়ী, হাদীস ন. ৩১৪০) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা রিয়ামুক্ত খালেস ইবাদত চান। যে ইবাদতে রিয়া রয়েছে তা কবুল হবে না।

কুরআনুল কারীমে ইখলাসের সাথে ইবাদত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, আর ঐসব লোককে তো এ আদেশ দেওয়া হয়েছে যেন তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহরই ইবাদত করে, শুধু তাঁরই উপর বিশ্বাস রাখে এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত দেয়। আর এটাই হচ্ছে সরল সহজ ধর্ম। (সূরা বাইয়্যেনাহ, আয়াত নং ৫)

ইখলাস আম্বিয়ায়ে কিরাম (আ.)-এর সুন্নাহ। সকল নবী-রাসূল (আ.) ইখলাসের সাথে ইবাদত পালন করতেন। আল্লাহ তাআলা ইখলাসের সাথে ইবাদত করার তাগিদ দিয়েছেন। যেমন, সূরা যুমারের ১১ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, (হে নবী!) আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমি আদিষ্ট হয়েছি আমি যেন তাঁরই সন্তুষ্টি কামনা করে তাঁরই ইবাদত করি।

ইবাদতের ক্ষেত্রে কোন প্রকার রিয়ার সংমিশ্রণ ঘটানো যাবে না। ইবাদত পালন ও কবুলের ব্যাপারে গর্ব-অহংকার করা যাবে না। প্রদর্শনেচ্ছা বাদ দিয়ে খালেছ নিয়তে ইবাদত করতে হবে। হাদীস শরীফে এসেছে, নিশ্চয় আমলসমূহের ছাওয়াব নিয়তের উপর নির্ভরশীল। (সহীহ বুখারী, হাদীস ন. ১৯০৭) নিয়ত ও অন্তরের একনিষ্ঠতার উপর ভিত্তি করে ইবাদত কবুল হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের শরীর ও আকৃতির দিকে দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের কলবের (অন্তর) দিকে দেখেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৬৪) আন্তরিকতা ও ইখলাসের সাথে ইবাদত করলে পূর্ণ সাওয়াব পাওয়া যেতে পারে।

ইখলাস ব্যতীত যত কষ্টকর ইবাদত করা হোক না কেন, তা কবুল হবে না। আল্লাহ তাআলা ইখলাস বিহীন ইবাদতের বিনিময় প্রদান করবেন না। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে প্রশ্ন করা হলো, এমন ব্যক্তি সম্পর্কে যিনি জিহাদ করেন বীরত্ব দেখানোর জন্য, যিনি জিহাদ করেন আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে এবং লোক দেখানোর জন্য।

কোন্ ব্যক্তির জিহাদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হবে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কালিমা তথা দ্বীনকে সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে জিহাদ করেন, তিনিই আল্লাহর সন্তুষ্টিতে জিহাদ করেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস ন. ১২৩) জীবন বাজি রাখার মাধ্যমে জিহাদ করেও বিনিময় পাওয়া যাবে না, যদি না তাতে ইখলাসের সমন্বয় না ঘটে। ইখলাস বিহীন ইবাদত প-শ্রমে পরিণত হবে।

বহু অর্থ-কড়ি খরচ করে ইবাদত করা হলেও রিয়ার কারণে তা বাতিল হয়ে যেতে পারে। আবার স্বল্প খরচের ইবাদতে ইখলাসের কারণে গ্রহণযোগ্যতা লাভ হতে পারে। মানুষের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ইবাদতও আল্লাহ তাআলা কবুল করে নিবেন, যদি তাতে তাঁর সন্তুষ্টি ও ইখলাস থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয় তুমি যে কোন দান করে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করলে তোমাকে এর বিনিময় দেওয়া হবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যা দিচ্ছ এরও প্রতিদান দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ন. ৫৬)

ইখলাসসহ ইবাদত অথবা যে কোন কাজ করলে শয়তান ধোঁকা দিতে পারে না। পক্ষান্তরে ইখলাসবিহীন কাজে সহজেই শয়তান ধোঁকা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বর্ণিত আছে, বনী ইসরাঈলের এক আবেদ (ইবাদতকারী) সংবাদ পেল, তাঁর পার্শ্ববর্তী গোত্র গাছের পূজা করছে। আবেদ একটি কুড়াল নিয়ে সেই গাছটি কর্তন করার জন্য রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে অভিশপ্ত ইবলিস (শয়তান) বৃদ্ধ শায়খের সূরতে তাঁর সাথে সাক্ষাত করলো। ইবলিস আবেদের গমনের ইচ্ছা জানার পর উভয়ে তর্কে লিপ্ত হলো; এক পর্যায়ে তারা ধস্তাধস্তিতে লিপ্ত হলো। আবেদ ইবলিসকে পরাস্ত করে ফেললেন।

ইবলিস এবার ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করলো, সে আবেদকে প্রস্তাব দিলো, তুমি গাছটি কর্তন করা থেকে বিরত থাকলে তোমাকে প্রতি দিন দু‘দিনার দেওয়া হবে। আবেদ তাতে রাজি হয়ে গেল। ইবলিস দু‘দিন দিনার দেওয়ার পর তৃতীয় দিন বন্ধ করে দিল। আবেদ ক্রোধান্বিত হয়ে আবার গাছটি কাটার উদ্দেশ্যে বের হলে, ইবলিস গতিরোধ করে দাঁড়ালো। পূর্বের ন্যায় উভয়ে তর্কে লিপ্ত হয়ে আবেদকে ইবলিস মাটিতে ফেলে দিল।

আবেদ লোকটি আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, এটা কীভাবে সম্ভব হলো? অথচ প্রথমবার আমি তোমাকে পরাস্ত করেছিলাম! ইবলিস বললো, প্রথমবার তুমি ইখলাসের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য গাছটি কাটতে রওয়ানা দিয়েছিলে। ফলে নিয়ত ও ইখলাসের কারণে তোমাকে আল্লাহ তাআলা সহায়তা দিয়ে বিজয় দান করেছিলেন। আর দ্বিতীয়বার তুমি দিনার না পাওয়ার কারণে গাছটি কাটতে রওয়ানা হয়েছিলে; আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বের হওনি। ফলে তিনি তোমাকে সহায়তা করেননি। আমি তোমার উপর বিজয় লাভ করেছি।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বর্তমানে নামাজ, রোজা, হজ্জ ও যাকাতসহ অনেক ইবাদতে সেলফি‘র মাধ্যমে লোক দেখানোর প্রতিযোগিতা চলছে। ইবাদত ইখলাসের সাথে পালন করা হচ্ছে না।

লোক দেখানো অথবা লোকের বাহবা পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইবাদত করা হচ্ছে! এটা প্রকাশ্য রিয়ার অন্তর্ভুক্ত, যা শিরকে আসগর (ছোট শিরক) হিসেবে গণ্য। ফলে ইবাদত করেও মানুষের মাঝে কাঙ্খিত পরিবর্তন আসছে না। ইবাদত পালনকারী সৃষ্টির অনিষ্ট ও পরের হক নষ্ট করতে সামান্যও কুণ্ঠিত হয় না।

মিথ্যা, পরনিন্দা, প্রতারণা, রাহাজানি, খুনসহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েমকারী লোকটিও নিজেকে ‘হাজী সাহেব’ ও ‘দানবীর’ হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জিত হয় না। অথচ এ ধরনের লোকের ইবাদত আল্লাহ তাআলার দরবারে কতটুকু গৃহীত হবে তা নিজের আমলের মাধ্যমে নিজেই অনুধাবন করতে পারে। তাই সকল প্রকার রিয়া থেকে মুক্ত হয়ে ইখলাসের সাথে ইবাদত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করা মুমিনের একান্ত কর্তব্য।

লেখক: প্রভাষক (আরবি), রামপুর আদর্শ আলিম মাদরাসা,

চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়