শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

ইসলামে বিবেকের স্বরূপ
মুফতি মুহাঃ আবু বকর বিন ফারুক

বিবেক-বুদ্ধি মহান আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে এক অফুরন্ত নেয়ামত।

মানুষ বুদ্ধিমান বা বিবেকসম্পন্ন প্রাণী।অন্যান্য প্রাণীর সাথে তার মূল পার্থক্যই হল তার জ্ঞানের ব্যবহার।যদি জ্ঞান দিয়ে মানুষকে সজ্জিত করা না হত তা হলে অন্যান্য প্রাণীর সাথে তার কোন পার্থক্যই থাকত না।অন্যান্য প্রাণী যেমন খাদ্য গ্রহণ করে ও বংশ বৃদ্ধি করে,একইভাবে মানুষেরও এর থেকে বেশি কিছু করার থাকত না।

লক্ষণীয় বিষয় যে,অন্যান্য ধর্মের বিপরীতে ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির ব্যবহারে এত অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির ব্যবহারে যে বিপুল সংখ্যক নির্দেশনা ইসলাম ধর্মে পাওয়া যায় তা অন্য কোন ধর্মে পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে কেবল সত্যধর্মের পক্ষেই জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ সম্ভব। কেননা, সত্যে উপনীত হওয়ার মূল প্রক্রিয়াটি হচ্ছে জ্ঞানগত চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানো।

যারা বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগায় না,কোনরূপ চিন্তা করে না,গবেষণা করে না তাদেরকে কুরআনে মূক,বধির,অন্ধ ইত্যাদি অভিধায় তিরস্কৃত করা হয়েছে - আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন - অর্থাৎ আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম জীব সেই বধির ও মূক যারা কিছুই উপলব্ধি করে না।

কোরআনুল কারিমে আরও বলা হয়েছে : অর্থাৎ -আর যে ব্যক্তি এখানে অন্ধ সে আখিরাতেও অন্ধ এবং অধিকতর পথভ্রষ্ট।

এমনকি তাদের পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলা হয়েছে: আল্লাহ তা'আলা আরো বলেন, অর্থাৎ- তাদের হৃদয় আছে,কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না,তাদের চোখ আছে,তা দিয়ে দেখে না এবং তাদের কান আছে,তা দিয়ে শোনে না,এরাই পশুর ন্যায়,বরং তারা তার চেয়েও নিকৃষ্ট।তারাই গাফেল।

কোরআনুল কারিমের সূরা মূলকের ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে- তারা আরও বলবে: যদি আমরা শুনতাম অথবা বুদ্ধি খাটাতাম, তবে আমরা জাহান্নামবাসীদের মধ্যে থাকতাম না।

বিবেক ও তার গুরুত্ব : বিবেকের গুরুত্ব বর্ণনা বলতে গেলে বিশেষ করে বিদ্যার মাহাত্ম্য অবগত হওয়ার পর বলতে হবে। কেননা, বিবেক হচ্ছে বিদ্যার উৎস। বিবেকের তুলনায় বিদ্যা এমন, যেমন বৃক্ষের তুলনায় ফল কিংবা সূর্যের তুলনায় তার আলো। সুতরাং যে বিষয়টি দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ অর্জনের উপায়, তা উত্তম হবে না কেন? চতুষ্পদ জন্তুর হিতাহিত জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও বিবেকের সম্মুখে মাথা নত করে। যে জন্তু যত বড় এবং বেশী ক্ষতিকর ও ভয়াল, সে জন্তু ও মানুষকে দেখে মাথা নত করে দেয় এবং ভয় পায়। কারণ, এতটুকু বােধশক্তি তার আছে যে, মানুষ তার উপর প্রভাব বিস্তার করবে। কেননা, সে কৌশল কেউ জানে না। এজন্যেই রাসূলে কারীম (সাঃ) বলেন, বৃদ্ধ লোক তার সম্প্রদায়ের মাঝে এমন, যেমন নবী তার সম্প্রদায়ের মাঝে। এটা অঢেল অর্থ - সম্পদ, দীর্ঘ ও স্থূল দেহ এবং অধিক শক্তিমত্তার কারণে নয় বরং অধিক অভিজ্ঞতার কারণে, যা বিবেকের ফসল। এ কারণেই তুর্কী, কুর্দী ও আরব জাতিকে দেখা যায়, তারা মূর্খতায় চতুষ্পদ জন্তুদের প্রায় কাছাকাছি হলেও মজ্জাগতভাবে বৃদ্ধদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। এ কারণেই জনৈক শত্রু যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে হত্যা করতে চাইল এবং তার দৃষ্টি তার রাসূলের নুরানী চেহারার উপর গিয়ে পড়ল তখন সে কাপতে লাগলো। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সম্রোজ্জ্বল ললাটে বিরাজমান নূরে নবুওয়াত শত্রুর দৃষ্টিতে ঝলসে উঠল। মোটকথা, বিবেকের প্রাধান্য দেদীপ্যমান বিষয়। কিন্তু এর গুরুত্ব সম্পর্কে যেসব আয়াত ও হাদীস বর্ণিত হয়েছে, এখানে সেগুলো আলোচনা করাই আমাদের উদ্দেশ্য। আল্লাহ তা'আলা বিবেককে নূর বলে অভিহিত করে বলেন, অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর নূর (আলো)। আল্লাহপাক বিবেক থেকে উদ্ভূত ইলমকে আত্মা ওহী ও হায়াত বলে অভিহিত করেছেন।

তাই আল্লাহ বলেন, আর এমনিভাবে আমি আমার নির্দেশক্রমে আপনার নিকট রূহ প্রেরণ করেছি।

আল্লাহ তা'আলা আরও বলেন, ‘যে মৃত ছিল, পরে আমি তার জীবন দান করেছি এবং নূর দিয়েছি, যার ফলে সে মানুষের মধ্যে চলাফেরা করে।আল্লাহ তা'আলা যেসকল জায়গায় ‘ নূর ও জুলুমাত ' উল্লেখ করেছেন, সেখানে অর্থ ইলম ও মূর্খতা বলা হয়েছে।যেমন কোরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসেন।

নবী করিম (সাঃ) বলেন, ওহে লোকেরা ! আল্লাহকে জান এবং একে অপরকে বিবেকের উপদেশ দাও। এতে বৈধ ও অবৈধ বিষয়সমূহ জানতে পারবে।জেনে রাখ, বিবেক তোমাদেরকে তোমাদের মাবুদের কাছে মর্যাদা দান করবে।জেনে রাখ, সে-ই বুদ্ধিমান যে আল্লাহর আনুগত্য করে, যদিও সে দেখতে বিশ্রী এবং মান - মর্যাদায় কম হয়। আর অজ্ঞ সে ব্যক্তি, যে আল্লাহর নাফরমানী করে। তার চেয়ে শূকর ও বানর অধিক বুদ্ধিমান। দুনিয়া অন্বেষণকারী তোমাকে সম্মান দেখালে তুমি বিভ্রান্ত হয়ো না, তাহলে মহাক্ষতি হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা সর্বপ্রথম বিবেক সৃষ্টি করেছেন। এরপর তাকে বলেছেন, সম্মুখে এস। সে সম্মুখে এলে বলা হল, পৃষ্ঠ প্রদর্শন কর। সে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল। এরপর আল্লাহ বললেন, আমার ইজ্জত ও প্রভাবের কসম, আমি তোমার তুলনায় অধিক সম্মানিত কোন কিছুই সৃষ্টি করিনি। আমি তোমার মাধ্যমেই সম্মান কেড়ে নেব, আবার তোমার মাধ্যমেই সম্মান দেব, তোমার উদ্দেশ্যেই কল্যাণ দেব এবং তোমার উদ্দেশ্যেই অকল্যাণ দেব।

হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সামনে জনৈক ব্যক্তির মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করা হলে তিনি বললেন, লোকটির বিবেক কেমন? লোকেরা বলল, আমরা ইবাদত ও বিভিন্ন প্রকার সত্ত্বাজের ব্যাপারে তার অধ্যবসায়ের কথা আপনার হুজুরে উল্লেখ করছি, আর আপনি জানতে চাইছেন তার বিবেকের অবস্থা, কেন? তিনি বললেন, বিবেকহীন লোক অজ্ঞতার কারণে পাপীর চেয়ে বেশী পাপ করে থাকে। কিয়ামতে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যশীল হওয়ার স্তর বিবেক মোতাবেক উচ্চতর হবে। হযরত ওমর (রাঃ)-এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, মানুষের উপার্জনের মধ্যে বিবেক - বুদ্ধির সমতুল্য আর কোন কিছু নেই। বিবেক মানুষকে হিদায়াতের দিকে পথ দেখায় এবং ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। বিবেক পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ঈমান পূর্ণ হয় না এবং দ্বীন সঠিক হয় না। এক হাদীসে আছে, “মানুষ তার উত্তম চরিত্রের দ্বারা রোযাদার ও রাত জাগরণকারীর স্তরে উন্নীত হয়। কারও বিবেক পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত সচ্চরিত্রতা পরিপূর্ণ হয় না। বিবেক পূর্ণ হলে ঈমান পূর্ণ হয়, আল্লাহর আনুগত্য নছীব হয় এবং সে তার শত্রু শয়তানের নাফরমান হয়ে যায়।

আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, প্রত্যেকটি বস্তুর একটি ভরসা আছে। ঈমানদারের ভরসা বিবেক। অতএব তার ইবাদত তার বিবেক মোতাবেকই হবে। দোযখে বাস করে কাফিররা বলবে।কোরআনের ভাষায় - “আমরা যদি শুনতাম কিংবা বিবেক বিবেচনা করতাম, তাহলে জাহান্নামীদের মধ্যে গণ্য হতাম না। "বর্ণিত আছে, হযরত ওমর (রা:) তামীম দারীকে জিজ্ঞেস করলেন তোমার মধ্যে নেতা কোন বিষয়টি? সে বলল, বিবেক। হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, তুমি সঠিক বলেছ। আমি এ প্রশ্নই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -কে করলে তিনিও এ উত্তরই দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, আমি জিব্রাঈল (আঃ) -কে প্রশ্ন করলাম, সরদারী কি? তিনি বললেন, বিবেক। বারা ইবনে আযিব (রাঃ) বর্ণনা করেন, একদিন লোকেরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -কে অত্যধিক পরিমাণ প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, হে লোকরা, প্রতিটি বস্তুরই একটি বাহন আছে, মানুষের বাহন বিবেক। তোমাদের মধ্যে তার যুক্তিই উত্তম, যার বিবেক বেশী। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ওহুদ যুদ্ধ থেকে ফেরার পর মানুষকে বলাবলি করতে শুনলেন যে, অমুক অমুকের চেয়ে বেশী বীরত্ব প্রদর্শন করেছে এবং যুদ্ধের পরীক্ষায় অমুক অমুকের চেয়ে অধিক কৃতকার্য হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, এসব বিষয় তোমরা কিছুই জানি না। লোকেরা আরজ করল, তা কিরূপে? তিনি বললেন, তারা ততটুকুই যুদ্ধ করেছে, যতটুকু বিবেক আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে দান করেছিলেন। তাদের জয় - পরাজয়ও তাদের বিবেক মতে হয়েছে। তাদের মধ্যে যারা শহীদ হয়েছে, তাদের স্তর বিভিন্ন রকম হয়েছে। কিয়ামতের দিন তারা তাদের বিবেক ও নিয়ত অনুসারে সম্মান লাভ করবে। বারা ইবনে আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ফেরেশতাগণ তাদের বিবেক দ্বারা আল্লাহ তা'আলার ইবাদতে চেষ্টা করেছেন এবং মানুষের মধ্যে ঈমানদাররা তাদের বিবেকের মাধ্যমে চেষ্টা করছেন। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে, তার বিবেকও বেশী। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে নিবেদন করলাম, দুনিয়াতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হয় কোন বিষয়ের দ্বারা? তিনি বললেন, বিবেকের দ্বারা। আমি বললাম, পরকালে কোন বিষয়ের দ্বারা? তিনি বললেন, বিবেক দ্বারা। আমি আবার আরজ করলাম, তাহলে কি তাদের কর্মের বিনিময়ে প্রতিদান দেয়া হবে না? তিনি বললেন, আয়েশা, তারা কর্ম ততটুকু করবে, যতটুকু আল্লাহ তাদেরকে বিবেক দিয়ে দিবেন। অতএব বিবেক অনুসারেই কর্ম হবে এবং তার প্রাপ্য সেভাবে দেয়া হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, মুমিনদের মধ্যে আল্লাহ তা'আলার নিকট অধিক প্রিয় সে ব্যক্তি যে আল্লাহ তা'আলার আনুগত্যে অবিচল থাকে, তার বান্দাদের কল্যাণ কামনা করে, পূর্ণ বিবেকবান হয়ে নিজেকে উপদেশ প্রদান করে, চক্ষুষ্মান হয়ে বিবেক মোতাবেক আজীবন আমল করে এবং সাফল্য ও মুক্তি হাসিল করে। তিনি আরও বললেন, তোমাদের মধ্যে পরিপূর্ণ বিবেক সে ব্যক্তির, যে আল্লাহকে অধিক ভয় করে এবং বৈধ ও অবৈধ বিষয়সমূহে যার দৃষ্টি সর্বাধিক উত্তম হয়। যদিও নফল ইবাদত কম করে।

বিবেকের স্বরূপ বিবেকের পরিচিতি ও স্বরুপ নিয়ে মতভেদ রয়েছে।

অধিকাংশ লোক লক্ষ্য রাখেনি, এ শব্দটি নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়। এরূপ বিভিন্ন অর্থবোধক শব্দের একক সংজ্ঞা অন্বেষণ করা ঠিক নয় বরং বিভিন্ন প্রকারের অবস্থা। পৃথক পৃথক ব্যক্ত করা আবশ্যক। প্রথম অর্থ, বিবেক এমন একটি গুণ, যাদ্বারা মানুষ চতুষ্পদ জন্তু থেকে ব্যতিক্রম হয়েছে। হারেস ইবনে আসাদ মুহাসেবী এ অর্থ করেছেন। বিবেকের সংজ্ঞায় তিনি বলেন, বিবেক এমন এক প্রকার শক্তি, যার মাধ্যমে মানুষ চিন্তাগত বিষয় উপলব্ধি করার যোগ্যতা হাসিল করে। এটা যেন একটা আলো, যা অন্তরে রাখা হয় এবং যা দ্বারা মানুষ উপলব্ধি করার উপযোগী হয়। যে ব্যক্তি এ সংজ্ঞা অস্বীকার করে এবং বিবেককে কেবল বাহ্যিক বিষয় জানার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে, সে ইনসাফ করে না। কারণ, যেব্যক্তি শাস্ত্র সম্পর্কে উদাসীন অথবা যেব্যক্তি ঘুমন্ত, তাদের উভয়কেই বিবেকবান বলা হয় অথচ শাস্ত্র তখন তাদের মধ্যে থাকে না। কেবল শক্তি ও যোগ্যতা থাকার কারণেই তাদেরকে বিবেকবান বলা হয়।

দ্বিতীয় অর্থ এমন জ্ঞান, যা হিতাহিত জ্ঞানসম্পন্ন বালকের সত্তার মধ্যে পাওয়া যায়। যেমন, এ বিষয়ের জ্ঞান, দুই একের দ্বিগুণ এবং একই ব্যক্তির একই সময়ে দু’জায়গায় থাকা সম্ভব নয়। কোন কোন কালাম বিশেষজ্ঞ বলেন, বিবেক হচ্ছে কতক জীবন্ত ভন। যেমন সম্ভাব্য বিষয়সমূহের সম্ভব হওয়ার এবং অসম্ভাব্য বিষয়সমূহের অসম্ভাব্য হওয়ার জ্ঞান। এ ব্যাখাও সঠিক। কেননা, এসব জ্ঞান বর্তমান আছে এবং এগুলোকে বিবেক বলাও যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এর মধ্যে ক্ষতি হচ্ছে, পূর্বোল্লিখিত শক্তিকে অস্বীকর করা এবং বলা। এসব জীবন্ত জ্ঞান ব্যতীত বিবেক অন্য কিছু নয়।

তৃতীয় অর্থ এমন জ্ঞান, যা দৈনন্দিন অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও তার অভিজ্ঞতা থেকে হাসিল হয়। কেননা, যেব্যক্তি অভিজ্ঞতায় দক্ষ ও ওয়াকিফহাল, তাকেই বিধিগত বিবেকবান বলা হয়। পক্ষান্তরে যে অভিজ্ঞতার গুণে গুণান্বিত নয়, তাকে মূর্খ, অনভিজ্ঞ প্রভৃতি বলা হয়। মোটকথা, প্রথম প্রকার বিবেক সব কিছুর উৎসমূল। দ্বিতীয় প্রকার প্রথম প্রকারের শাখা। তৃতীয় প্রকারও দ্বিতীয় প্রকারের শাখা। কেননা, স্বভাবগত শক্তি ও দিব্ব জ্ঞান থেকে অভিজ্ঞতা হাসিল হয়।

আল্লাহ তাআলা বিবেকের চেয়ে বড় কোন বস্তু সৃষ্টি করেননি। মানুষ যখন বিভিন্ন প্রকার সৎ কাজের মাধ্যমে নৈকট্য হাসিল করে, তখন বিবেক দ্বারা নৈকট্য অর্জন করা উচিত আবু দারদার উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বাণীতেও তাই বুঝানো হয়েছে- তুমি অধিক বিবেকবান হও, যাতে আল্লাহ তায়ালার অধিক নৈকট্য লাভ করতে পার। আবু দারদা নিবেদন করলেন, আমার পিতা-মাতা আপনার উপর কুরবান হোক। আমার জন্য এটা কিরূপে সম্ভব হবে? তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলার নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ থেকে আত্মরক্ষা কর, তার ফরয কাজগুলো সম্পাদন কর এবং কাজ কর। এতে দুনিয়াতে তোমার মর্যাদা বাড়বে এবং এ জন্য আল্লাহর কাছে তোমার নৈকট্য হাসিল হবে।

সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেব (রাঃ) হতে বর্ণিত- হযরত ওমর, উবাই ইবনে কা'ব ও আবু হোরায়রা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর খেদমতে নিবেদন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ! সর্বাধিক আলিম কে? তিনি বললেন, বিবেকবান ব্যক্তি। পুনরায় প্রশ্ন করা হল, সর্বোত্তম ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, বিবেকবান ব্যক্তি। তারা আবার নিবেদন কররেন, যেব্যক্তি পূর্ণ মনুষ্যত্বের অধিকারী, বাহ্যত মিষ্টভাষী, দানবীর ও উচ্চ মর্যাদাশীল, সে - ই কি বিবেকবান নয়? তিনি বললেন, এগুলো তে জাগতিক বিষয়। আল্লাহর নিকট মুত্তাকীদের জন্য পরকাল ভাল। অতএব সে - ই বিবেকবন, যে খোদাভীরু, যদিও সে দুনিয়াতে লাঞ্ছিত হয়। কুরআন কারীম এসেছে- অর্থাৎ, “ যখন আপনার রব আদম সন্তানদের ঔরস থেকে তাদের সন্তান - সন্ততি বের করলেন এবং তাদেরকে তাদের ব্যাপারে এই মর্মে স্বীকৃতি আদায় করলেন, আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলল, অবশ্যই আপনি আমাদের রব। "

এখানে তাওহীদের তথা একত্ববাদের স্বীকারোক্তি নেয়ার অর্থ আধ্যাত্মিক স্বীকারোক্তি নেয়া, মৌখিক নয়। কেননা, মৌখিকভাবে কেউ স্বীকার করে এবং কেউ স্বীকার করে না। নিচের আয়াতেও তেমনি অর্থ বুঝানো হয়েছে।

কুরআনে এসেছে- অর্থাৎ, আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, কে তাদের সৃষ্টিকর্তা? তবে অবশ্যই তারা বলবে- আল্লাহ। কোরআনে আরও বলা হয়েছে - অর্থাৎ, আল্লাহ তালার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাই প্রত্যেক মানুষের স্বভাবজাত প্রকৃতি। কেননা, আল্লাহকে উপলব্ধি করার যোগ্যতা তার মধ্যে খুব বিদ্যমান। এজন্যই মানুষ দু'শ্রেণীতে বিভক্ত-

(১) যে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছে এবং আপন স্বভাবগত বিষয়টি ভুলে গেছে। সে কাফির।

(২) যে চিন্তা করেছে এবং আল্লাহর কথা স্মরণ করেছে।

যেমন : কোন সাক্ষী অলসতা হেতু ঘটনার কথা ভুলে যায়, তারপর স্মরণ হয়। এ কারণেই আল্লাহ তা'আলা স্মরণ করার কথা অনেক স্থানে বলেছেন। যেমন- লা আল্লাহুম ইয়াজ্জাক্কারুন (যাতে তারা স্মরণ করে) অল ইয়াজ্কুর উলুল আলবাব-(এবং যাতে বিবেকবান লোকেরা স্মরণ করে) কোরআনে আরো এসেছে - (এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামত স্মরণ কর এবং তাঁর সেই অঙ্গীকার স্মরণ কর, যা তিনি তোমাদের সাথে সম্পাদন করেছেন।) আল্লাহ তা'আলা আরও বলেন -(আর আমি কুরআনকে স্মরণ করার জন্যে সহজ করেছি। অতএব আছে কি কোন স্মরণকারী?) বর্ণিত প্রকারকে স্মরণ করা বলা অযাচিত নয়। কারণ, স্মরণ করা হচ্ছে, দু'প্রকার-

(১) যে বিষয় অন্তরে বিদ্যমান ছিল, পরে বিলুপ্ত হয়েছে, তা স্মরণ করা এবং

(২) মানুষের মন - মস্তিষ্কে আগত বিষয় স্মরণ করা।

যে ব্যক্তি বিবেকের আলো দ্বারা দেখে, তার সম্মুখে এসব দিব্য।

আর যে অনুসরণ শ্রবণের উপর নির্ভরশীল এবং কাশফু ও দেখার উপর নির্ভর করে না, তার জন্য অবশ্য এসব বিষয় দুর্বোধ্য। এ কারণেই তাকে এ প্রকার আয়াতে বিভ্রান্ত হতে দেখা যায়। সে স্মরণ করার অর্থ এবং মনের স্বীকৃতি ব্যাখ্যায় নানা ধরনের আজগুবি কথাবার্তা বলে। হাদীস ও আয়াতসমূহে তার ধারণায় প্রচুর মত বিরোধ মনে হতে থাকে। কখনও এটা এত প্রবল আকার ধারণ করে যে, সে এসব হাদীস ও আয়াতকে অবজ্ঞার চোখে দেখতে থাকে এবং এগুলোকে বাজে বলে মনে করতে শুরু করে।

সে সেই অন্ধ ব্যক্তির মত, যে কোন ঘরে প্রবেশ করে। ঘরে সকল আসবাবপত্র গুছানো রয়েছে। কিন্তু অন্ধ আসবাবপত্রের উপর ফসকে পড়ে বলে, এসব রাস্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয় না কেন? তাকে বলা হবে, আসবাবপত্র তো স্বস্থানেই গুছানো ছিল কিন্তু দোষ তোমার দৃষ্টি শক্তির।

তেমনি অন্তর্দৃষ্টির দোষের কারণে হাদীস ও আয়াতসমূহে বিরোধ দেখতে থাকে। অথচ তাতে বিরোধ কিছুই নেই, দোষ হচ্ছে বিবেকের। অন্তদৃষ্টির ক্ষতি চর্মচক্ষুর ক্ষতির তুলনায় অনেক বেশী।

কেননা, মন আরোহীর ন্যায় এবং দেহ যান স্বরূপ। বলাবাহুল্য, সওয়ারীর অন্ধ হওয়ায় হোড়ার অন্ধ হওয়ার তুলনায় বেশী ক্ষতিকর। অন্তর্দষ্টিকে চর্মচক্ষের সাথে সমন্বয় করার উদ্দেশ্যে। আল্লাহ তায়া লা বলেছেন, মা কাযীবাল ফুঅদু মা র আ অর্থ “ অন্তর যা দেখেছে, তা মিথ্যা দেখেনি।

কোরআনে অন্যত্র বলেছেন, অর্থাৎ এভাবেই আমি ইব্রাহীমকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব দেখিয়েছি।

এর বিপরীতকে আল্লাহ তা'আলা অন্ধত্ব বলেছেন, “অবশ্যই অন্ধ হয় না। কিন্তু বক্ষস্থিত অন্তর অন্ধ হয়।”

কোরআনুল কারীমে আল্লাহ তা'আলা বলেন, অর্থাৎ, এ দুনিয়াতে যে অন্ধ সে পরকালেও অন্ধ এবং অধিকতর গোমরাহ।

নবীদের জন্যে যেসব বিষয় জাহির হয়ে ছিল, সেগুলোর কিছু বাহ্যিক দৃষ্টির কারণে এবং কিছু অন্তদৃষ্টির ফলে প্রকাশ পেয়েছিল কিন্তু সবগুলোকে দেখাই বলা হয়েছে।

বিবেকের হ্রাস বৃদ্ধি : বিবেক হ্রাস বৃদ্ধি হতে পারে কিনা, এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে।

এ সম্পর্কে মূল বিষয় হচ্ছে, পূর্বোল্লিখিত দ্বিতীয় প্রকার বিবেক ব্যতীত সব বিবেকই হতে পারে। কেবলমাত্র বৈধ বিষয়সমূহের সম্ভবপর এবং অবৈধ বিষয়সমূহের অসম্ভব হওয়া এমন এক ইলম, যা হ্রাস বৃদ্ধি হতে পারে না। যেমন, যে ব্যক্তি জানবে যে, দুই একের চেয়ে বেশী, তদ্রুপ একথাও জানবে, একই বস্তু দুস্থানে থাকা অসম্ভব। কিন্তু অবশিষ্ট বিবেক বেশ - কম হতে পারে। যেমন- স্বভাবগত শক্তি এত বেশী হওয়া যে, খাহেশকে দূরে নিক্ষেপ করে দেয়। এতে মানুষ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এ পার্থক্য কখনও খাহেশের ব্যবধানের কারণে হয়। কেননা, বিবেকবান ব্যক্তি কখনও কোন কোন খাহেশ পরিত্যাগ করতে সক্ষম হয় এবং কোন কোনটি ত্যাগ করতে সক্ষম হয় না। যদিও তা ত্যাগ করা সম্ভব। যেমন যুবক ব্যক্তিকে ব্যাভিচারের দিকে আকৃষ্ট করে, কিন্তু তার ধর্ম জ্ঞান ও বিবেকের তাড়নায় ব্যভিচার পরিত্যাগ করে, তবে বৃদ্ধ হওয়ার পর বিবেক যখন পূর্ণতা লাভ করে, তখন তা ত্যাগ করতে সক্ষম হয়। আবার কখনও এ ব্যবধান এ জন্য হয় যে, ইলম দ্বারা খাহেশের ক্ষতি অবগত হওয়া যায়, তাতে পার্থক্য হয়। এ জন্যই কিছু ক্ষতিকর খাদ্য থেকে এড়িয়ে চলতে চিকিৎসক সক্ষম হয় কিন্তু তার সমান বিবেকবান অন্য এক ব্যক্তি তা থেকে বেঁচে থাকতে পারেন না। যদিও তার বিশ্বাস এ খাদ্য অনিষ্টকারী। কিন্তু চিকিৎসকের ইলম পূর্ণ বিধায় তার ভয়ও অধিক। এ ক্ষেত্রে ভয় তার খাহেশ উচ্ছেদ করার ব্যাপারে বিবেকের প্রহরী হয়ে যায়। তদ্রুপ মূর্খের তুলনায় আলিম ব্যক্তি গোনাহ ত্যাগ করতে বেশী সক্ষম।

কেননা, সে গোনাহের ক্ষতি সম্পর্কে ভালভাবেই পরিজ্ঞাত। সুতরাং ইলমের কারণে পার্থক্য হলে এ ধরনের ইলমকেও আমরা বিবেক বলেছি এ কারণে যে, ইলম স্বাভাবিক শক্তি বাড়ায়। অতএব এ ইলমের ব্যবধান হুবহু বিবেকের ব্যবধান কখনও এ পার্থক্য শুধু বিবেকশক্তির ব্যবধানের কারণে হয়ে থাকে এ শক্তি অধিক হলে খাহেশকে বেশী উচ্ছেদ করবে।

বিবেকের তৃতীয় প্রকার অভিজ্ঞতাও বেশ - কম হয়। কোন কোন লোক খুব দ্রুত বিষয়বস্তু আয়ত্ত করে ফেলে এবং তাদের অভিমতও প্রায়ই সঠিক হয়। আর কোন কোন লোক এরূপ হয় না। সুতরাং এ প্রকার বিবেকের ব্যবধান অনস্বীকার্য। প্রথম প্রকার যা মূল। কেননা, এটা একটা আলোর ন্যায়, যা অন্তরের উপর ঝলমল করতে থাকে। হিতাহিত জ্ঞানের বয়স থেকে এর সূচনা হয়। এরপর থেকে তা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। অবশেষে প্রায় -চল্লিশ বছর বয়স হলে পূর্ণ হয়ে যায়। যেমন, প্রভাত রশ্মি শুরুতে এমন গোপন থাকে যে, তা জানা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং সূর্যোদয়ে তা পূর্ণতা লাভ করে। সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ তা'আলার সুন্নতি হচ্ছে, তিনি বারে বারে সৃষ্টি করেন। সে মতে বালকের মধ্যে বালেগ হওয়ার সময় যৌনশক্তি একযোগে প্রকাশ পায় না বরং অল্প অল্প করে প্রকাশ হতে থাকে। সুতরাং যেব্যক্তি এই স্বাভাবিক শক্তির মধ্যে বেশ - কম হওয়াকে অস্বীকার করে, সে যেন বিবেকের আওতায় বাইরে অবস্থান করে। আর যে লোক মনে করে, গ্রাম্য লোকের হয়ে থাকে, সে ব্যক্তি গেঁয়াে থেকেও বর্বর। এ শক্তিতে ব্যবধান না হলে মানুষ জ্ঞান - বিজ্ঞান আয়ত্তের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রূপ কেন হত এবং কেউ এত স্বল্প মেধাবী কেন হত যে, অনেক বুঝলে বুঝতে পারবে না? আবার কেউ এত প্রখর মেধাবী কেন হত যে, একটু ইশারা দিলেই আয়ত্ত করে ফেলে এবং কেউ এত কামেল কেন হত, স্বয়ং তার মন থেকেই বিভিন্ন বস্তুর আসল অবস্থা উথলে উঠে, ওস্তাদের কাছে শিক্ষা করার আবশ্যকতাই হয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তার জ্বালানি নিজে থেকেই প্রজ্বলিত হওয়ার উপক্রম হয়, যদিও তাকে আগুন স্পর্শ করে না। নূরের উপর নূর।”

নবীগণ এরূপ কামেল লোক। সূক্ষাতি সূক্ষ্ম বিষয়াদি তাঁদের অন্তরে কারও শেখানো ব্যতীতই এবং কারও কাছ থেকে শোনা ছাড়াই উন্মোচিত হয়ে যায়।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ ধরনের বিষয়বস্তুই এ হাদীসে বর্ণনা করেছেন, রুহুল কুদুস (জিব্রাঈল) আমার মনে ঢেলে দেন, তোমরা যাকে ইচ্ছে বন্ধু বানাও, তার কাছ থেকে পৃথক হবে, যত দিন ইচ্ছে জীবিত থাক, একদিন মরতে হবেই এবং যা ইচ্ছে আমল কর, তার প্রতিদান অবশ্যই তোমরা পাবে।

নবীগণকে ফেরেশতাদের এভাবে সংবাদ দেয়া ওহী নয় বরং এটা স্বতন্ত্র ব্যাপার। কেননা, ওহীর ক্ষেত্রে নবী কানে শুনেন এবং ফেরেশতাকে চোখে দেখেন। ইলহামে তা নেই। সেজন্যেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘ আমার মনে ঢেলে দেন', অন্য কোন শব্দ বলেননি।

ওহীর অনেক ধাপ রয়েছে। এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে, যে ব্যক্তি ওহীর ধাপগুলো জানতে পারে, সে ওহীর উপযোগী হয়ে যায়। কেননা, কোন বিষয় জানা এক জিনিস আর তা পাওয়া আরেক জিনিস। যেমন, কোন অসুস্থ চিকিৎসকের জন্য স্বাস্থ্য রক্ষার যাবতীয় স্তর জেনে নেয়া অসম্ভব নয়, অথচ এ চিকিৎসকের মধ্যে স্বাস্থ্য বিদ্যমান নেই। তদ্রুপ যেব্যক্তি নবুওয়াত ও ওলীত্ব সম্পর্কে জানবে, তার নবী বা ওলী হওয়া অপরিহার্য নয়।

মোট কথা, কোন কোন মানুষ উপলব্ধির মাধ্যমেই অনেক বিষয় বুঝতে পারে, আবার অনেকে প্রশিক্ষণ ছাড়া বুঝে না। আবার অনেকের জন্য প্রশিক্ষণও উপকারী হয় না। এটা অবিকল ভূমির মত। যেমন ভূমিতে পানি জমা থাকে এবং অতিরিক্ত হয়ে তা থেকে স্বাভাবিকভাবেই ঝরণা প্রবাহিত হতে থাকে। আবার ভূমিতে কূপ খনন করতে হয়। কূপ খনন না করা পর্যন্ত পানি বের হয় না। এছাড়া কোন কোন সময় খনন করলেও পানি বের হয় না, শুকনোই থেকে যায়। বিবেক যে কম - বেশ হয়, এর প্রমাণ আদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা:) -এর একটি বর্ণনা। তার জিজ্ঞাসার জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি দীর্ঘ বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যের শেষ ভাগে তিনি আরশের মহাত্ম উল্লেখ করে বললেন, “ ফেরেশতারা আল্লাহ তা'আলার কাছে নিবেদন করল? হে আল্লাহ, আপনি আরশের চেয়েও বড় কোন কিছু সৃষ্টি করেছেন কি? এরশাদ হল, হ্যাঁ । তা হচ্ছে বিবেক। আরশের চেয়েও বড় বিবেক। প্রশ্ন হল, এর পরিমাণ কতটুকু? আল্লাহ বললেন, তোমরা এটা পূর্ণভাবে জানতে পারবে না। তোমরা বালুকণার সংখ্যা জান কি? উত্তর হল, না, জানি না, আল্লাহ বললেন, আমি বিবেককেও বালুকণার সংখ্যানুযায়ী বিভিন্ন রূপ সৃষ্টি করেছি। কেউ পেয়েছে এক রতি, কেউ দুরতি, কেউ তিন রতি এবং কেউ বা চার রতি পেয়েছে। আবার কেউ আট সেরের কাছাকাছি এবং কেউ এক উটের বোঝা পরিমাণ পেয়েছে। ”

পরিশেষে বলব, বিবেক বুদ্ধি মহান আল্লাহ তায়ালার এক অশেষ নেয়ামত।

বিবেক দিয়ে আমরা সব সময় ভালো বিষয়টি গ্রহণ করি।অন্যায়-অপরাধ কাজ থেকে দূরে থাকি।বিবেক বুদ্ধি দিয়ে ইসলাম ধর্মকে যথাযথ পালন করে, অনৈসলামিক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকে। আল্লাহ তাআলার হুকুম আহকাম যথাযথ পালন করি। (ইহইয়ায়ে উলুমুদ্দীন)

লেখক : মুফতি মুহাঃ আবু বকর বিন ফারুক, ইমাম ও খতিব, বিষ্ণুপুর মদিনা বাজার বাইতুল আমীন জামে মসজিদ, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়