শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০

কোরআন ও হাদিসে ওয়াজ মাহফিল : প্রেক্ষিত আমাদের সমাজ
অনলাইন ডেস্ক

॥ এক ॥

ওয়াজ-মাহফিল যেহেতু একটি দ্বীনি বিষয়, তাই দ্বীনের অন্যান্য বিষয়ের মতো এক্ষেত্রেও রাসূল (সাঃ) সাহাবায়ে কেরাম ও সালফে সালেহীনের অনুকরণ করা জরুরি। মানুষের ব্যক্তি জীবনের পরিশুদ্ধি ও আকিদা-বিশ্বাসের সংশোধনের ক্ষেত্রে ওয়াজ মাহফিলের গুরুত্ব অপরিসীম। ওয়াজ-মাহফিল নতুন কোন বিষয় নয়। যুগ যুগ ধরে তা নিজস্ব গতি ও নিয়মে চলে আসছে। ইদানিং নিয়মণ্ডনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান যুগের ওয়াজ-মাহফিল, সভা-সম্মেলনগুলো নিছক একটি প্রথা ও বার্ষিক অনুষ্ঠান পালনের রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। সেকালের মাহফিলগুলো সাধারণত মাদরাসা কেন্দ্রিক অনুষ্ঠিত হতো। যেখানে মাদরাসা ছিল না, সেখানে এলাকার ধর্মপ্রাণ লোকদের উদ্যোগে এ ধরনের মাহফিলের আয়োজন করা হতো। একালে শুধু মাদরাসা নয়, প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জ-পাড়া-মহল্লা ও প্রতিটি রোডে রোডে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, যুব সংঘ/সংস্থা/পরিষদ ও ব্যবসায়ীদের উদ্যোগ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সেকালে মাদরাসার মাহফিল জনসাধারণে স্বতস্ফুর্ত আর্থিক সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হত। কোন কোন দ্বীনি মাদরাসার মাহফিল কয়েক দিনব্যাপী থাকতো। কোন কোন এলাকায় টানা কয়েকদিন তাফসির মাহফিল অনুষ্ঠিত হতো।

দেশ-বিদেশের সমকালীন খ্যাতিসম্পন্ন ওলামায়ে কেরাম তাতে উপস্থিত থেকে কুরআন হাদিসের আলোকে সারগর্ভ নসিহত পেশ করতেন। মুসলমানদের ইমান-আকাইদ ও আমলী সংশোধন, আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং যুগসচেতন হওয়ার আহ্বান করতেন। তৎকালীন ওলামা ও বুজুর্গানে দ্বীনদের কাছে ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতের কোন ঘাটতি ছিল না। বর্তমানে সামাজিক সংগঠন, ব্যক্তি উদ্যোগের আয়োজিত মাহফিলের ইতিবাচক ফায়েদা কিন্তু একেবারে কম নয় । মদণ্ডজুয়া, যাত্রা, নর্তকী ও গানের কনসাটের বিপরীতে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন সত্যিই খুব প্রশসংসার দাবি রাখে। তবে মাহফিলগুলো যাতে করে রেওয়াজ ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে না হয় সেদিকে অবশ্য খেয়াল রাখতে হবে। বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। ইলম ও আমলওয়ালা ওলামা ও বুজুর্গানে কেরামগণকে মাহফিলে দাওয়াতের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

শুধু সুন্দর সুর-কণ্ঠ, মাঠ কাঁপানো ও কন্টাক্টওয়ালা বক্তাদের দিয়ে আজীবন ওয়াজ করালেও একজন মানুষেরও হিদায়াত হবে না। অযথা টাকা খরচ ও সময় নষ্ট এবং বিনোদন বৈকি। একথা স্বীকার করতে বাধ্য, আমাদের বর্তমানের মাহফিলগুলো আগের মতো সেই প্রভাবময় নয়। আগে বক্তাদের যেরকম ইলম ছিল, ছিল সেরকম আমলও। ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতেরও কোন ঘাটতি ছিল না। এককালে মুজাহিদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী, খতীবে আযম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ, শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, খতীব মাওলানা উবায়দুল হক, মাওলানা নুর উদ্দীন আহমদ শায়খে গহরপুরী, ফখরে বাঙাল মাওলানা তাজুল ইসলাম, কুতুবে দাওরান শায়খ লূৎফুর রহমান বর্ণভী, খতীবে মিল্লাত মাওলানা আতাউর রহমান খান, মাওলানা আবদুর রহমান শায়খে দিঘলবাগী, মাওলানা গিয়াস উদ্দিন শায়খে বালিয়া, কুতবে বাঙাল মাওলানা আমিন উদ্দিন শায়খে কাতিয়া, আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া মাওলানা আব্দুর রহমান শায়খে মাধবপুরী, চরমোনাই পীর সৈয়দ ইসহাক, মাওলানা ফজলুল করিম চরমোনাই, মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী, আব্দুল হক শায়খে গাজিনগরী, দরগার ইমাম আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী, শায়খে আব্দুল্লাহ হরিপুরী, মাওলানা আব্দুল গফ্ফার মামরখানী, মাওলানা মোশাহিদ আহমদ বায়ুমপুরী, মাওলানা আব্দুল হাই দিনারপুরী, (রাহিমাহুমুল্লাহ তায়ালা) প্রমুখ বুজুর্গানে দ্বীন নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে দেশের আনাচে-কানাচে সফর করতেন।

বাংলার মানুষদেরকে দ্বীনের পথে আনার জন্য খেয়ে- না খেয়ে (পারিশ্রমিক-হাদিয়া ব্যতিত) মাহফিলগুলোতে হাজির হয়ে গুরুত্বপূর্ণ নসিহত করতেন। সে যুগের মাহফিলগুলোর অভূতপূর্ব প্রভাব এখনকার মাহফিলগুলোতে আর নেই। তাদের প্রতিটি কথা ধর্মপ্রাণ মুসলমান লুফে নিয়ে আমলে পরিণত করতেন। সাদামাটা সহজ সরল লৌকিকতাহীন সে ওয়াজগুলো দ্বীনি শিখার পরিবেশ ও আমলের স্পৃহার স্ফুরণ ঘটতো। তখনকার মাহফিলগুলো চটে বসে জান্নাতি আবহে মুগ্ধ হতেন শ্রোতারা।

আজ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এখনকার ওয়াজ মাহফিলগুলোতে বিশেষ অপচয়। শ্রোতাদের নিবেদন রক্ষার্থে বেশিরভাগ মাহফিলগুলোতে কন্টাক্টওয়ালা বক্তাদের আমন্ত্রণ। আসলে এটা সমাজেরই দোষ। সমাজ যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তেমনি মানুষের ভেতরের খুলুছিয়ত ও লিল্লাহিতের ঘাটতি হ্রাস পাচ্ছে।

ওয়াজের উদ্যেশ্য কি হবে, ওয়াজ কি ও কেন এটা অনেকেরই অজানা। বক্ষমান নিবন্ধে ওয়াজের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও বর্তমান প্রেক্ষিত নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো। হাদিসের আলোকে বলা যায় যে, ওয়াজের উদ্দেশ্য হবে মানুষকে ইহ-পরকালীন কল্যাণের পথনির্দেশ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করা।

এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শুধুই ঐ আমল কবুল করেন, যা তার সন্তুষ্টির জন্য করা হয় । (-বাইহাকী শরীফ)

হজরত আব হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, যে ভাষার প্রাঞ্জলতা শিখে মানুষের অন্তরকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার কোন ফরজ ও নফল ইবাদতসমূহকে কবুল করবেন না’। (মিশকাত : ৪১০)

ইমাম গাজালী (রাহ.) তার লিখিত গ্রন্থ ‘’আইয়্যুহাল ওয়ালাদ’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ওয়াজকারীদের ওয়াজ দ্বারা উদ্দেশ্য যেন হয় মানুষকে দুনিয়া হতে আখেরাতের প্রতি, গোনাহ থেকে নেকির প্রতি, লোভ থেকে পরিতুষ্টির প্রতি আহ্বান করা। এরই ভিত্তিতে বক্তাগণ শ্রোতাদেরকে পরকালীনমুখী ও দুনিয়াবিমুখ করে গড়ে তোলার প্রয়াস করা। ইবাদত-বন্দেগী ও তাকওয়ার দীক্ষা দান করা। সর্বোপরি আত্মিক অবস্থা পরিবর্তনের সাধনা করা। এটাই হলো প্রকৃত ওয়াজ। আর যে বক্তা এরুপ উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে ওয়াজ করবে তার ওয়াজ মানুষের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। দ্বীনদার মুসলমানগণ যেন এ রকম বক্তা ও ওয়াজ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে। (মাজালিসূল আবরার : ৪৮২)

বক্তাদের জন্য পাঁচটি জিনিস অত্যাবশ্য : সেগুলো হলো : ১. ইলম, কেননা ইলমহীন ব্যক্তি সঠিক ও বিশুদ্ধ বয়ান করতে অক্ষম।

২. আল্লাহর সন্তুষ্ট ও তার দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্য।

৩. যা বয়ান করবেন তা আমল করা।

৪.বক্তা শ্রোতাদের ওপর দয়ার্দ্র ও বিনম্র হয়ে কথা বলা।

৫. বক্তা ধৈর্যশীল ও সহনশীল হওয়া। (ফাতওয়ায়ে আলমগীরি ৪/১১০)

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে জানা গেল যে, আল্লাহর সন্তুষ্ট, দ্বীনের দাওয়াত ও মানুষের হিদায়াতকে লক্ষ্য না বানিয়ে যতই ওয়াজ হোক তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে না এবং দ্বারা মানুষের কোন উপকারও সাধিত হয় না। অর্থ কড়ি, যশ-খ্যাতি ও দুনিয়াবী কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য যারা ওয়াজ করে বা ওয়াজের আয়োজন করে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

ওয়াজকারী ব্যক্তির জন্য দুটি গুণ থাকা অপরিহার্য। যদি দুই গুণ না থাকে তাহলে মানুষের হিদায়াত হবে না। কুরআনুল কারীমে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তাদেরকে অনুসরণ করা যারা দ্বীনি বিষয়ে কোন পারিশ্রমিক চায় না এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত’। (সূরা- ইয়াসিন : ২১)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়