প্রকাশ : ২০ মে ২০২২, ০০:০০
মানুষ শান্তি প্রত্যাশী জীব, সমাজে সুখ-শান্তি ও পারস্পরিক ভাতৃত্ববোধ বজায় রেখে বসবাস করতে চায়, তাই মহান আল্লাহ তা’আলা রাসূল (সাঃ) এর মাধ্যমে ইসলাম নামক একটি শান্তিময় জীবন ব্যবস্থা গঠন করে দিয়েছেন। এই জীবনব্যবস্থা জীবনের সকল সমস্যার সমাধান করে মানব জীবনে বয়ে আনে অনাবিল সুখ শান্তি। পৃথিবীতে এমন মানবসমাজ নেই যে, সুন্দর জীবন যাপন করে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে চায় না, প্রতিটি মানুষই সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে উন্নত জীবন যাপনের স্বপ্নে থাকে বিভোর।
একটি সুখী পরিবার, সুন্দর সমাজ, সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রব্যবস্থা উপহার দিতে কার মন দোলা না দেয়? প্রিয় দেশটিকে শত্রুমুক্ত করতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অসংখ্য মায়ের সন্তান জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন মাতৃভূমির জন্যে, তাদের রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি প্রকৃতির সৌন্দর্যে ঘেরা প্রিয় দেশকে, তাইতো এই মাটিতে মিশে আছে অসংখ্য মনোরঞ্জন স্বপ্নের ইতি কথা। অন্যদিকে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৃথিবীর দিকবিদিকে পশ্চিমা বিশ্বসহ অসংখ্য সামাজিক সংগঠন, মানবাধিকার সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, কিন্তু তারপরও শান্তির অবহ মিলছে না, বরং এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়, রাজনৈতিক নিপীড়ন, শোষণ, দুর্নীতি , সংঘাত, লুটপাট, চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি, অন্যায় অবিচার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মানুষের অধিকার হরণ, মানবাধিকার লংঘন, মাদক সেবন, ক্ষমতার অপব্যবহার, সামাজিক অবক্ষয়, ইত্যাদি। যা সভ্য মানবসমাজ কখনই এই পশুত্বপ্রবণ চিত্র দেখতে চায় না। প্রতিফলন স্বরুপ আমাদের চারপাশে এই পরিস্থিতিগুলোর কোনো-না-কোনোভাবে সম্মুখীন হতে হচ্ছে, মুখোমুখি হতে হয় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার, যা শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
শান্তির বাণী, আশার আলো নিয়ে কিছু মানবিক সংগঠন এগিয়ে আসলেও পরিসরে তারাও যেন সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায়।
মাঝে মধ্যে সংবাদ পত্রে ক্ষমতার অপব্যবহারের চিত্র ফুটে উঠে কিছু স্বার্থান্বেষী ক্ষমতার চেয়ারে বসে অসামাজিক কার্যকলাপে, দুর্নীতির মতো নির্লজ্জ পন্থায় তারাও মেতে উঠে। অথচ, যাদের কাজ করার কথা একনিষ্ঠভাবে জাতির কল্যাণে, তাদের এই দুরবস্থা, দায়িত্বের প্রতি অসৎচারিতা, অপেশাদারিত্বমূলক আচরণ আশার শেষটুকু আলোই যেনো নিভিয়ে দিচ্ছে। প্রতিদিন একটু একটু করে অবক্ষয়ের অতল অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয় দেশটি, আমরা গর্বিত জাতি কিন্তু আজ হতাশার গ্লানি নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। এসবের মূল কারণ ইসলামী নৈতিক চর্চা, ধর্মীয় অনুশাসন, এবং মূল্যবোধের আলোকে জীবন পরিচালনা না করা। তাই
ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা সর্বক্ষেত্রে অন্তর্ভূক্ত করা সময়ের দাবি হয়ে উঠছে, শিক্ষার সর্বস্তরে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটানো উচিত বলে আমি মনে করি।
ইসলামই একমাত্র সর্বময় জীবন ব্যবস্থা যা সর্বদাই মানুষকে কল্যাণকর পথে আহ্বান করে, অতএব ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে শান্তি প্রতিষ্ঠা আশা করা যায়।
আর এ কারণেই ধর্ম হিসেবে একমাত্র ইসলাম মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিতে পেরেছে।
ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সবধরনের অন্যায় অত্যাচার, শোষণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজন সৎসাহসী, প্রতিবাদী, প্রত্যয়ী কিছু তরুণ। কারণ, যে সমাজে অন্যায়ের প্রতিবাদ হয় না, সে সমাজে মানবতার উপর নেমে আসে ভয়াল অন্ধকার, অন্যায় অবিচারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যাপক হারে বেড়ে যায়, যা থেকে শান্তি বিনষ্ট হয়।
প্রসিদ্ধ আছে হযরত উমর ফারুক (রাঃ) ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা মনোনীত হওয়ার পর মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘আমি যদি তোমাদের আল্লাহর পথে পরিচালিত না করি, তাহলে তোমরা কী করবে?’ একবার-দুইবার-তিনবারের পর একজন যুবক উঠে দাঁড়িয়ে তরবারি উঁচিয়ে বলল, ‘এই তরবারি আপনাকে সোজা করবে।
হযরত উমর (রাঃ) শুকরিয়া আদায় করে বলেন, ‘ওই জাতি কখনো পথভ্রষ্ট হবে না, যে জাতির মধ্যে এমন সৎসাহসী তরুণ রয়েছে।’
হ্যাঁ, এটাই অন্যতম মন্ত্র। সমাজশুদ্ধির জন্য তরুণদের মধ্যে সততা, সৎসাহসিকতা ও নৈতিকতা জাগ্রত করার বিকল্প নেই।
সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আরো যে সকল কাজ করা যেতে পারে-
ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া : পবিত্র কুরআন এবং হাদিসে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন জোরদার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা এসেছে, আর তাহলো-শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলামি ভ্রাতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য বজায় রাখতেই আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই।’ (সুরা হুজরাত : আয়াত ১০)
দেশ-কাল-ভাষা-বর্ণের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে এ ভ্রাতৃত্ব ছড়িয়ে পড়ে দূর-বহুদূর। কোনো পূর্ব পরিচিতি নেই, একজন অন্যজনের ভাষাও বোঝে না- এমন দুইজন মুমিনও যখন ঈমানের দাবিতে একত্রিত হয়, তখন মুহূর্তেই যেনো তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে পারস্পরিক সহমর্মিতা ভালোবাসা। ভাষার সীমাবদ্ধতা, দেশের ভিন্নতা এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, পবিত্র কুরআনের ঘোষণা-কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো : তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে।’ [সূরা আলে ইমরান : ১০৩]
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা: একটি সমাজকে অনুপম সৌন্দর্যের চাদরে আবদ্ধ করতে হলে সৎকাজে আদেশের বিকল্প নেই, অপরদিকে অসৎকাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করলে সমাজে জুলুম অনাচার বেড়ে সমাজের শৃঙ্খলাবোধ বিনষ্ট হয়, এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেন,
এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম দল তোমাদের কর্মক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের হিদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য। তোমরা নেকীর হুকুম দিয়ে থাকো, দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো। (আলে ইমরান : ১১০)। মুমিনের গুণাবলীর মধ্যে এটি অন্যতম, নিজেও সৎ কাজ করবে এবং মানুষদেরকেও সর্বদাই সত্যের পথে আহ্বান করবে।
কারো ওপর জুলুম না করা : ন্যায়বিচারের বিপরীত হলো জুলুম, অর্থাৎ কারো প্রতি অবিচার করাই হল বড় জুলুম। অবিচারের মাধ্যমে নিরপরাধ ব্যক্তিদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। ইসলামে জুলুম মস্ত বড় অন্যায় বলে বিবেচিত। ইসলাম সব সময় জুলুমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ইসলাম বলেছে, আল্লাহর হক আদায় না করলে আল্লাহ ক্ষমা করলেও বান্দার হক বিনষ্টকারীকে আল্লাহ কখনও ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ না যার ওপর জুলুম করা হয়েছে, সে ক্ষমা করে দেয়। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যেও একে হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’ [মুসলিম : ৬৭৪০]
কল্যাণমূলক সংগঠন গড়ে তোলা : এটির প্রচলন এবং কার্যকারীতা পূর্বের তুলনায় বর্তমানে ব্যাপক হারে দেখা যাচ্ছে, এটি মূলত কিছু যুবকদের সৎ উদ্দেশ্যে এবং অনুপম সুস্থ মানসিকতার প্রতিফলন । সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সহায়ক হিসেবে কল্যাণমূলক সংগঠনগুলো ও ভূমিকা রাখতে পারে, সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে যদি অসহায় মানুষের পাশে যথাযথ সময়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে, বেকারত্ব, কর্মসংস্থানের অভাব এবং দারিদ্রতা থেকে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ফিরে আসা সম্ভব হবে।
ইনসাফ করা : ইসলামের পরিভাষায় কোনো বস্তু তার হকদারদের মধ্যে এমনভাবে বণ্টন করে দেয়া যাতে কারও ভাগে বিন্দুমাত্র কম বেশি না হয়। এর নাম আদল বা ন্যায়বিচার। আর আদল বা ন্যায়বিচার করার প্রক্রিয়াটাকেই বলে ইনসাফ। অর্থাৎ ন্যায়বিচার করাটাই হলো ইনসাফ। এই সম্পর্কে পবিত্র কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা দণ্ডায়মান হও। কোনো কওমের প্রতি শত্রুতা যেনো তোমাদেরকে কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতম এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’ [সূরা আল-মায়েদা : ৮]
জবাবদিহীতার মানসিকতা তৈরি করা : সমাজে প্রতিটি মানুষ তার কর্মফলের জন্য নিজেই দায়ী হবে। পার্থিব জীবন শেষে কিয়ামতের মাঠে প্রত্যেককে নিজ নিজ কর্মের ব্যাপারে জবাবদিহী করতে হবে। ঠিক তেমনি দুনিয়াতেও যেকোনো বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে যথাযথভাবে তা আদায় করতে হবে দায়িত্বের মধ্যে কোনো ধরনের অনিয়ম এবং অনাকাক্সিক্ষত ভুল করলে জবাবদিহীতার মানসিকতা তৈরি করতে হবে, তবেই আশাব্যঞ্জক হারে অপরাধপ্রবণতা কমতে থাকবে। একজনের অন্যায়, অপকর্মের জন্য অন্য কাউকে দায়ী করা যাবে না যেমন, আত্মীয়স্বজন, বংশপরম্পর। মানুষকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত সুষ্ঠু ও স্বচ্ছতার সঙ্গে যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
সুশিক্ষার বিস্তার ঘটানো : সমাজকে সুন্দর ভাবে গড়তে হলে আগে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। আদর্শ মানুষ তৈরি করতে শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই একজন মসলমানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো সে নিজে এলেম শিখে তদানুযায়ী আমল করবে।
কারণ এলেম শিখার সাথে ইসলামী নৈতিক শিক্ষা অর্জন হয়। মহান আল্লাহ তা’য়ালা দ্বীনি শিক্ষাকে সকল নর এবং নারীর উপর ফরজ করে দিয়েছেন। হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
যে কেউ ইলমের খোঁজে কোনো পথে চলে আল্লাহ তার জন্যে জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। - মুসনাদে আহমদ ১৪/৬৬।
উপরোল্লেখিত মৌলিক করণীয়গুলো যদি সঠিকভাবে আমরা পালন করি, তবে আশা করা যায় আমাদের মাঝে সুদিন আবারও ফিরে আসবে। পরিসরে, সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সবাইকে একযোগে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণার্থে কাজ করে যেতে হবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে উপরোক্ত আলোচনা বুঝে আমল করার তৌফিক দান করুক। আমিন।
লেখক : শিক্ষার্থী, বিএ অনার্স, (ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ) চাঁদপুর সরকারি কলেজ।