প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
জুমাতুল বিদা মুসলিম সংস্কৃতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ দিবস। জুমাতুল বিদা আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো সমাপনি সম্মিলন। ইসলামের পরিভাষায় সিয়াম সাধনার মাস রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘জুমাতুল বিদা’ বলে। এ দিবসকে এতদঞ্চলের ধর্মপ্রাণ মানুষ অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। একে কেন্দ্র করে প্রতিটি মুসলিম মনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। বলতে গেলে দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনাশেষে মুসলিম মনে যে ঈদুল ফিতরের আগমন ঘটে, তারই পরোক্ষ আগমন জানান দেয় জুমাতুল বিদা।
বস্তুত ইসলামি সংস্কৃতির একটি বিরাট অংশ দখল করে আছে জুমা দিবস। প্রতি সপ্তাহের জুমা দিবসে মুসলিম মনে এক জাগরণ সৃষ্টি হয়। এ জাগরণে অংশগ্রহণ করে পরবর্তী সপ্তাহের কর্মকৌশল ও কর্তব্য স্থির করার জন্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি ছুটি পালন হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি পালন হয়ে আসছে। এ দিবসটিকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে অনেক বিনোদন, অনেক আসর-আড্ডা।
জুমার দিনের গুরুত্ব ও মর্যাদার সহজ উপমা হলো, এ দিবসকে কেন্দ্র করে পবিত্র কুরআনে ‘জুমা’ নামে স্বতন্ত্র একটি সুরা নির্ধারণ করা হয়েছে। জুমাতুল বিদা তন্মধ্যে যেনো সোনায় সোহাগা। এক বর্ণনায় জুমা দিবসকে সাপ্তাহিক ঈদস্বরূপ বলা হয়েছে। সে হিসেবে প্রতি বছরের বড় দুটি ঈদ তথা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার আগমনিবার্তা ঘোষণা করার জন্যে প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার মিলে মোট বায়ান্নটি দিবস নির্ধারিত রয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বের দাবিদার জুমাতুল বিদা। জুমাতুল বিদাকে সকল জুমার শ্রেষ্ঠ জুমা বলা হয়।
আমাদের দেশে দীর্ঘ এক মাসের রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের পয়গামধন্য মাহে রমজানশেষে পশ্চিমাকাশের কোণে যে চিকন বাঁকা ঈদের চাঁদ উদিত হয়, তাকে কেন্দ্র করে প্রতিটি মানুষের মনে আনন্দের ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। এ উপলক্ষে প্রতিটি মানুষ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন পোশাক ক্রয় করে। সেমাই-ফিরনির সুঘ্রাণে চারদিক মৌ মৌ করে। মূলত ঈদুল ফিতরের সকল আনন্দের ধারা শুরু হয় জুমাতুল বিদা তথা রমজানের শেষ শুক্রবার হতে। জুমাতুল বিদার আলোচনায় মসজিদের ইমামণ্ডখতিবগণ যখন রমজানকে বিদায় জানানোর ইঙ্গিতবাহী বক্তব্য প্রদান করেন, তখন থেকেই শ্রোতাদের মন ঈদের কেনাকাটার জন্যে উশখুশ করতে শুরু করে। নামাজশেষে নতুন করে হিসেবের পালা শুরু হয় ঈদকে নিয়ে। ঈদের বাজার নিয়ে এতদিন যে গুঞ্জন মনের গভীরে ছন্দপতন ঘটাত, ওইদিন তা প্রকাশ্য তালিকায় রূপ নেয়। চূড়ান্ত তালিকা হয় ঈদের কেনাকাটার।
জুমাতুল বিদা তথা রমজানের শেষ জুমায় আমাদের দেশের প্রতিটি জামে মসজিদে মুসল্লির উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। এদিন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের উল্লেখযোগ্য মসজিদগুলোতে তিল ধরার ঠাঁই থাকে না। নামাজি মুসল্লিদের কাঁধে কাঁধ মিলানো কাতার চলে আসে রাজপথে। অনেক স্থানে এমনও দেখা যায় যে, ঈদের জামাতের চাইতেও জুমাতুল বিদার জামাত বড় হয়ে পড়ে। জুমাতুল বিদার বড় জামাতে অংশগ্রহণ করা এতদঞ্চলের মানুষজন বড় পুণ্যের মনে করে থাকে। ফলে গ্রাম কিংবা মফস্বল এলাকার বহু ধর্মপ্রাণ মানুষ ছুটে আসে শহরের বড় বড় মসজিদের জুমাতুল বিদার জামাতে শরিক হতে। আতর-গোলাপের সুঘ্রাণ, সাদা পোশাক, মাথায় টুপি মিলে যেন এক বেহেশতি দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। ঈদের আগে এ যেন এক ভিন্ন রকমের ঈদ। অবস্থা এমন ঘটে যে, মুসলিম বিশ্বে ঈদ দুটি নয়; তিনটি।
ইসলামে জুমাতুল বিদার সরাসরি গুরুত্ব বহনকারী কোনো বক্তব্য না পাওয়া গেলেও একে কেন্দ্র করে প্রতিটি যুগের মানুষের মাঝে একটি ফুরফুরা ভাব লক্ষ্য করা গেছে। প্রতিটি যুগের মুসলমানরাই জুমাতুল বিদাকে ভিন্নভাবে গুরুত্ব দিতেন। তবে হাদিসে সাধারণ জুমা দিবসের যেই গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে, জুমাতুল বিদার ফজিলত যে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি, তা যৌক্তিকভাবেই বলা যায়। হাদিসে এমনও বর্ণনা পাওয়া যায় যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) জুমাতুল বিদার খোতবায় ‘আল বিদা! আল বিদা!!’ শব্দ উচ্চারণ করতেন। এ শব্দ শোনার পর সাহাবায়ে কেরাম একবার বিলাপ ধরে কান্না শুরু করেন। তারা বলতে লাগলেন রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তাবাহী মাহে রমজানকেই মূলত জুমাতুল বিদায় সম্ভাষণ জানানো হয়েছে। পরবর্তী রমজান ভাগ্যে জুটে কিনা এবং রমজানের মতো ক্ষমাপ্রাপ্তির মাসেও আমাদের বরাতে ক্ষমা জুটেছে কিনা- এসব আফসোসেই সাহাবায়ে কেরাম ক্রন্দনরোল চালু করেন। প্রকৃতপক্ষে জুমাতুল বিদার আগমন মানেই পুণ্যের মাস রমজানকে বিদায় জানানো।
প্রসঙ্গত, জুমা দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করা যাক। আগেই বলা হয়েছে জুমা শব্দের অর্থ সম্মিলন কিংবা সমাবেশ। আল্লাহ তায়ালা নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও সমস্ত জগতকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। এই ছয় দিনের শেষ দিন ছিল জুমার দিন। এ দিনেই আদম আ. সৃজিত হন, এ দিনেই তাকে জান্নাতে দাখিল করা হয় এবং এ দিনেই জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামানো হয়। কেয়ামত এ দিনেই সংঘটিত হবে। জুমা দিবসে এমন একটি মুহূর্ত আসে, যাতে মানুষ যে দোয়াই করে, তাই কবুল হয়।
আল্লাহ তায়ালা প্রতি সপ্তাহে মানবজাতির সমাবেশ ও ঈদের জন্যে জুমা দিবস রেখেছিলেন। কিন্তু পূর্ববর্তী উম্মতরা তা পালন করতে ব্যর্থ হয়। ইহুদিরা ইয়াওমুসসাবত তথা শনিবারকে নিজেদের সমাবেশের দিন নির্ধারিত করে নেয়। খ্রিষ্টানরা নেয় রবিবারকে।
তাফসিরে ইবনে কাসিরের বর্ণনা মতে, মূর্খতা যুগে শুক্রবারকে ইয়াওমে আরূবা বলা হতো। আরবে কাব ইবনে লুওয়াই সর্বপ্রথম একে ‘ইয়াওমুল জুমা’ নামকরণ করেন। এ দিবসে কুরাইশদের সমাবেশ হতো এবং কাব ইবনে লুওয়াই এতে ভাষণ দিতেন। এটি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর আবির্ভাবের পাঁচশত ষাট বছর পূর্বের ঘটনা। কাব ইবনে লুওয়াই তার ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর আবির্ভাবের সুসংবাদও মানুষকে শুনিয়েছিলেন। সারকথা এই যে, ইসলামপূর্বকালেও কাব ইবনে লুওয়াইর আমলে শুক্রবার দিনকে গুরুত্ব প্রদান করা হতো। (মাজহারি)
‘জুমাতুল বিদাকে কেউ কেউ আখেরি জুমাও বলে থাকেন। রমজান মাসের শেষ জুমাকে কবে থেকে জুমাতুল বিদা নামে বলা হয়ে আসছে, তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও ইতিহাস থেকে উদ্ধারকৃত তথ্যমতে, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের রমজান মাস ছিল রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর জীবনের শেষ রমজান। ঐ রমজান মাসের শেষ জুমাতেই প্রিয়নবি (সাঃ) তার প্রদত্ত খোতবায় দুবার ‘আল বিদা’ বলেন। এ শব্দ উচ্চারণ করে কী বোঝাতে চেয়েছেন, পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরাম তার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। অর্থাৎ এটিই ছিল তার জীবনের সর্বশেষ রমজান মাস। পরবর্তী বছরের রবিউল আউয়াল মাসেই তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। তাই ওই খোতবাতে তিনি রমজানকে বিদায় জানাতে গিয়ে উম্মতের কাছ থেকে নিজের বিদায় হবার ঘোষণাই দিয়েছিলেন।
ইতিহাসে এমনও রয়েছে যে, ঐ বছর প্রিয়নবি (সাঃ)-এর খোতবায় ব্যতিক্রমী ‘আল বিদা’ শব্দটি শোনার পরই প্রধান সাহাবি হজরত আবু বকর (রাঃ) ফুঁফিয়ে কেঁদে ওঠেন। সাহাবায়ে কেরাম তাকে এর কারণ সুধালে তিনি বলেন, ‘প্রিয়নবির প্রস্থান আর বেশি দূরে নয়।’ মূলত হুজুর (সাঃ)-এর মুখনিসৃত ‘আল বিদা’ শব্দ থেকেই পরবর্তীতে রমজানের শেষ জুমাকে জুমাতুল বিদা বলা হয়ে আসছে।
তাফসিরে ইবনে কাসিরের বর্ণনা মতে, জুমার দিনে এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে, যাতে যে দোয়াই করা হয়, তাই কবুল করা হয়। সহিহ হাদিসে এ কথা প্রমাণিত রয়েছে। অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, কোনো ধর্মীয় মজলিসে যদি অন্তত চল্লিশজন লোক একত্রিত হয়ে কোনো দোয়া করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্যে যে কোনো একজনকে অলির মর্যাদা দিয়ে তার সঙ্গে সকলের দোয়া কবুল করে নেন। জুমাতুল বিদার বিশাল জামাতে আমাদের দেশের বিভিন্ন মসজিদে হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন। তাই ঐ দিনের দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আর সাধারণ জুমার দিনেই সেখানে নির্দিষ্ট মুহূর্ত যে কোনো দোয়া করা হয়ে থাকে, সেখানে জুমাতুল বিদায় তো এ ফজিলত আরও উন্মুক্ত হওয়াই যুক্তিযুক্ত।
এক বর্ণনায় রয়েছে, রমজান মাসে প্রতিদিন ইফতারপূর্ব সময়ে আল্লাহ তায়ালা সত্তর হাজার গুনাহগারকে ক্ষমা করে দেন। এ হিসেবে সমগ্র রমজানে যেই পরিমাণ গুনাহগারকে ক্ষমা করা হয় শুধুমাত্র জুমাতুল বিদা তথা আখেরি জুমায় সেই পরিমাণ গুনাহগারকে ক্ষমা ঘোষণা করা হয়ে থাকে। তাই প্রাণ খুলে আল্লাহর দরবারে রোজাদার ব্যক্তির প্রার্থনা করা উচিত।
লেখক : মুহাদ্দিস, গবেষক ও প্রাবন্ধিক; খতিব, হাজি শরিয়ত উল্লাহ (রঃ) জামে মসজিদ, চাঁদপুর।