প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
যাকাত ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোকন। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হলো সালাত ও যাকাত। কোরআন মজীদে বহু স্থানে সালাত ও যাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্যে অশেষ ছওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি হলো যাকাত। প্রতিবছরই যাকাত দিতে মুমিন মুসলমানরা সচেষ্ট থাকেন। গরিব দুঃখীকে দান করে আল্লাহর কাছে প্রিয় হবার জন্য চেষ্টা করেন। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন: ‘তোমরা নামায কায়েম করো, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহ-ভাজন হতে পারো।’ (সূরা নূর-৫৬) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘হে মু'আয! তুমি জানিয়ে দাও আল্লাহ তাদের সম্পদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা ধনী ব্যক্তিদের থেকে নিয়ে দরিদ্র ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ করা হবে।’ (বুখারী, মুসলিম ও তিরমিযি) যাকাত কি? যাকাত ইসলামের মৌলিক ইবাদত সমূহের মধ্যে অন্যতম ইবাদত। প্রত্যেক মুসলমানকে যেমন যাকাত ফরয হওয়ার বিষয় সম্পর্কে বিশ্বাস করতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে যার উপর যাকাত ফরয তাকে তা নিয়মিত পরিশোধও করতে হবে। পবিত্র কুরআনের ২৮ স্থানে নামাযের পাশাপাশি যাকাত প্রদানের হুকুম দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা নামায কায়েম করো, যাকাত প্রদান করো এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু করো’ (সূরা বাক্বারা, আয়াত-৪৩)। মহানবী (সাঃ) বলেন, ‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ নাই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল- এতে সাক্ষ্য দেয়া, নামায প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত দেয়া, শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য থাকলে হজ্জ্ব করা এবং রমযান মাসে রোযা রাখা।’ (বুখারী ও মুসলিম) যাদের উপর যাকাত ফরয নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক সকল মুসলিম নর-নারীর উপর যাকাত প্রদান করা ফরয।
যাকাত কী এবং কেন?
যাকাত শব্দের অর্থ পরিচ্ছন্নতা। নিজের আয় থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ কম সৌভাগ্যবান মানুষকে দান করে নিজের আত্মার পরিশুদ্ধিই যাকাত। শরীয়তের ভাষায়, বাৎসরিক আয়ের ২.৫% অংশ আল্লাহের পথে দান করে দেয়ার নাম যাকাত। এতে সম্পদ হয় হালাল এবং আত্মা হয় পরিশুদ্ধ। রাসূল (সাঃ) এর মতে, "যে ব্যক্তি যাকাত দিলো তার থেকে যেন শয়তান নির্মূল হয়ে গেলো।"
যাকাত দাতা
যাকাত দেয়ার জন্যে একজন মুসলিমের 'সাহিবে নিসাব' হতে হবে অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে। নিসাব বলতে বোঝায় ন্যূনতম ৭.৫ তোলা স্বর্ণ কিংবা ৫২.৫ তোলা রৌপ্য অথবা সমপরিমাণ অর্থ। এই পরিমাণ ধন-সম্পদ থাকলে যাকাত আদায় করা ফরজ। যে ব্যক্তি এক বছর যাবত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকেন, তাকে মোট অর্থের শতকরা ২.৫% হারে যাকাত পরিশোধ করতে হবে। অধিক সওয়াবের আশায় বেশিরভাগ মুসলমানই যাকাত দেবার জন্যে পবিত্র রমজান মাসকে বেছে নেন।
যাকাত দাতা হওয়ার শর্তবলী
যিনি যাকাত দেবেন তার মধ্যে নিম্ন লিখিত বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে ১. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া: নাবালেগের উপর যাকাত ফরজ হয় না। ২. যাকাত দেয়ার জন্য নিয়ত করা: নিয়ত না করে নিজের সকল সম্পদ সদকা করলেও যাকাত হবে না। ৩. বুদ্ধি-বিবেক সম্পন্ন হওয়া: পাগলের জন্য যাকাত ফরজ নয়।
যাকাত গ্রহীতা
যাকাত নিজ ইচ্ছেমতো যাকে-তাকে দিলে আদায় হবে না। আল্লাহ তায়ালা যাকাতের খাত উল্লেখ করেছেন। ১. ফকির: ফকির এমন মজুর ও শ্রমজীবীকে বলা হয়, যে শারীরিক ও মানসিকভাবে কর্মক্ষম হওয়া সত্ত্বেও প্রতিকূল অবস্থার কারণে বেকার ও উপার্জনহীন হয়ে পড়েছে। যে সব অভাবগ্রস্ত মেহনতি লোক কোনো জালিমের জুলুম হতে আত্মরক্ষার জন্যে জন্মভূমি ছেড়ে এসেছেন বা আসতে বাধ্য হয়েছেন তাদেরকেও ফকির বলা যেতে পারে। ২. মিসকিন: দৈহিক অক্ষমতা যাকে নিস্কর্মা ও উপার্জণহীন করে দিয়েছে তাকে মিসকিন বলে। বার্ধক্য, রোগ, অক্ষমতা, পঙ্গুত্ব যাকে উপার্জনের সুযোগ হতে বঞ্চিত করেছে অথবা যে ব্যাক্তি উপার্জন করতে পারে কিন্তু তা দ্বারা তার প্রকৃত পয়োজন মোটেই পূর্ণ হয় না; অন্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, পঙ্গু, খাদ্য-বস্ত্র ও আশ্রয়হীন শিশু ইত্যাদি সকলকেই মিসকিন বলা হয়। ৩. যাকাত বিভাগের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা: যাকাত আদায় এবং তা সুষ্ঠু ও সুনির্দিষ্টভাবে বন্টন করার কাজে যারা সার্বক্ষনিক নিযুক্ত থাকবে এবং যারা অন্য কোনভাবে জীবিকা নির্বাহের ব্যাবস্থা করতে অক্ষম, সেসব কর্মচারীর নূন্যতম প্রয়োজন পূরণার্থে আদায়কৃত যাকাত থেকে তাদের বেতন -ভাতা দেয়া হবে। ৪. অমুসলিমদের অত্যাচার থেকে মুসলিম সমাজকে রক্ষার জন্যে যাকাতের সম্পদ ব্যায় করা যাবে। ইসলাম প্রচারের কাজ কোথাও প্রতিরোধের সন্মুখীন হলে সে ক্ষেত্রে যাকাতের অর্থ ব্যায় করা যাবে। সংগতিহীন নও মুসলিমকেও স্বর্নিভর করার কাজে যাকাতের অর্থ ব্যায় হতে পারে। ৫. ক্রীতদাস মুক্তি: যেসব দেশে দাস প্রথা চালু আছে এবং মুসলমানদেরকে দাস বানিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে দাসদেরকে অর্থ দিয়ে মুক্ত করার কাজে যাকাতের সম্পদ ব্যায় করা যাবে। ৬. ঋণমুক্তি: প্রথমত, যারা নিজেদের দৈনিন্দিন প্রয়োজন পূরণ করতে গিয়ে ঋনগ্রস্ত হয়েছে এবং সে ঋন পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়েছে, তাদেরকে যাকাতের সম্পদ হতে সাহায্য করা যাবে। দ্বিতীয়ত, যারা মুসলমানদের সামষ্টিক কল্যাণ ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ঋন গ্রহণ করে, তাদের সে ঋন শোধ করার জন্য যাকাত দেয়া যাবে। যাদের বাড়ি-ঘর আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেছে, বন্যা-প্লাবনে মাল-আসবাব ভেসে গেছে, তাদের পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণের জণ্যে যাকাতের সম্পদ দেয়া যাবে। ৭. ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ব্যাবস্থা: যাকাতের ৭ম খাত হলো 'ফি সাবীল্লিাহ' (আল্লাহর পথে)। ৮ মুসাফির: যাকাতের ৮ম খাত হলো 'ইবনুস সাবীল' (নি:স্ব পথিকেদের জন্যে)। সৎ উদ্দেশ্যে দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে যারা পথিমধ্যে নি:সম্বল হয়ে পড়েছে, তাদেরকে যাকাতের অর্থ দেয়া যাবে।
কেন দেবেন যাকাত?
যাকাত বান্দাকে স্রষ্টার নিকটে আসতে সহায়তা করে। ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুকন বা স্তম্ভ হিসেবে যাকাত অত্যন্ত জরুরী। শুধুমাত্র স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভই নয়, একে অপরের প্রতি সহানুভূতি বৃদ্ধি ও সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ গঠনে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করে যাকাত। যাকাত দিয়ে আপনি বাঁচাতে পারেন কারো জীবন, ফোটাতে পারেন তার প্রিয়জনের মুখে হাসি। হতে পারেন কারো বিপদের বন্ধু। একইসাথে লাভ করতে পারেন স্রষ্টার সান্নিধ্য। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় যেটি যাকাত আপনাকে এনে দেবে এক অসাধারণ তৃপ্তি। একজন মানবতাবাদী হিসেবে আরেকজন অসহায় মানুষের দুঃসময়ের বন্ধু হয়ে নিজের কাছে নিজে যে প্রশান্তি পাবেন তার কোন বিকল্প আছে কি?
যেসব জিনিসের ওপর জাকাত ফরজ হয়
১. সব ধরনের সম্পদ ও সামগ্রীর ওপর যাকাত ফরজ হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা এবং ব্যবসার পণ্যে যাকাত ফরজ হয়। ২. ব্যাংক-ব্যালেন্স, ফিঙ্ড ডিপোজিট, বন্ড, ট্রেজারি বিল, ব্যাংক গ্যারান্টি মানি ইত্যাদি নগদ টাকাণ্ডপয়সার মতোই। এসবের ওপর যাকাত ফরজ হবে। ৩. সোনা-রুপার অলঙ্কার সবসময় বা কালেভদ্রে ব্যবহৃত হোক কিংবা একেবারেই ব্যবহার না করা হোক, সব অবস্থায় তার যাকাত দিতে হবে। (সুনানে আবু দাউদ ১/২৫৫, হাদিস : ১৫৬৩; সুনানে কুবরা, নাসায়ি, হাদিস : ২২৫৮) ৪.হজ্বের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘরবাড়ি নির্মাণ, ছেলেমেয়ের বিয়ে-শাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হয়, তাণ্ডও এর ব্যতিক্রম নয়। সঞ্চিত অর্থ পৃথকভাবে কিংবা অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিসাব পরিমাণ হলে বছরান্তে এর ওপরও যাকাত ফরজ হবে। অবশ্য বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই যদি খরচ হয়ে যায়, তাহলে তার যাকাত দিতে হবে না। (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, হাদিস: ৭০৩২)
যাকাত দেয়ার নিয়ম :
স্বর্ণ ও রূপার যাকাতের নিসাবঃ স্বর্ণের নিসাব হচ্ছে ২০ মিসকাল (দিনার) তথা ৮৫ গ্রাম। যদি কারো কাছে ৮৫ গ্রাম পরিমাণ বা অধিক স্বর্ণ ১ বছর (অর্থাৎ ১২ মাস) পর্যন্ত স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে তাহলে বছর শেষ হলে যাকাত দিতে হবে। রূপার নিসাব হচ্ছে ১৪০ মিসকাল (দিরহাম) তথা সৌদি আরবের রূপার দিরহাম অনুযায়ী ৫৬ রিয়াল অর্থাৎ ৫৯৫ গ্রাম। অর্থাৎ কারো কাছে ৫৯৫ গ্রাম বা এর অধিক রূপা ১ বছর কাল সময় পূর্ণ করলে এর যাকাত আদায় করতে হবে।
জমানো টাকার ক্ষেত্রে :
জমানো টাকার পরিমাণ যদি বাজারে স্বর্ণ বা রূপার নেসাব এর বাজার মূল্যের পরিমাণ বা অধিক থাকে তাহলে তার যাকাত দিতে হবে! এখানে আমাদের একটু বুঝতে হবে। যদি কারো কাছে স্বর্ণ অথবা রূপার নেসাব পরিমাণ বাজার মূল্য 'টাকা' হিসেবে পুর্ণ ১ বছর জমা থাকে তাহলে তার যাকাত দিতে হবে। এখানে নেসাব হিসেবে স্বর্ণকেও গ্রহণ করা যেতে পারে আবার রূপাকেও গ্রহণ করা যেতে পারে, এই সুযোগ দেয়া হয়েছে।
করোনা প্রার্দুভাবের কারণে যাকাতের হুকুম :
মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন: তোমরা সালাত আদায় করো এবং যাকাত প্রদান করো। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন। (সূরা বাকারা : ১১০) রাসূল(সা) ইরশাদ করেন : যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে তাঁর যাকাত দেয়নি কিয়ামতের দিন তা বিষধর সর্পরূপে উপস্থিত হবে এবং তা তাঁর গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার উভয় অধরপ্রান্তে দংশন করবে এবং বলবে, আমিই তোমার ঐ ধন, আমিই তোমরা পুঞ্জিভূত সম্পদ। (সহীহ বুখারী) সুতারাং বর্তমানে করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাব বেড়েই চলছে। এ সংকটময় মুহুর্তে বিত্তবান ব্যক্তিদের উচিত অসহায় ও গবীর মানুষের পাশ্র্বে দাড়ানো। বর্তমানে একবেলা খানা খাওয়া সাধারণ মানুষের জন্য অনেক কষ্টসাধ্য। সরকারি ও বিত্তবানদের সহায়তায় কিছু মানুষ ত্রাণ সামগ্রী পেয়েছেন কিন্তু সমাজের এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা কারো কাছে মুখ খুলে বলতে পারছে না। যেমন, অসহায়, হত দরিদ্র, গরীব, নন-এমপিও শিক্ষক/কর্মচারী, কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষক/কর্মচারী, স্বল্প আয়ের ওলামায়ে কেরাম, বিভিন্ন দোকান কিংবা কারখানার কর্মকর্তা/কর্মচারী ও সরকারি অনুদান ভূক্তনয় এমন মাদ্রাসার শিক্ষক/কর্মচারীগণ খুবই কষ্টে জীবন যাপন করতেছে। চলমান সঙ্ককটন মুহূর্তে যাকাতের সম্পদ হতে তাদেরকে কিছু পরিমান দান করা একান্ত প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কেউ যদি এ ক্ষাত ভিক্ষার সাথে তুলনা করেন তাহলে সেটা বোকামি ছাড়া অন্য কিছু নয়।
যাকাতের নির্দিষ্ট অংশের চেয়ে বেশী দান করার হুকুম :
উবাই ইবনু কা'ব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ছাঃ) আমাকে যাকাত আদায় করার জন্য প্রেরণ করলেন। আমি এক ব্যক্তির নিকট পৌঁছলাম, সে আমার সামনে তার সম্পদ উপস্থিত করল। তার যে সম্পদ ছিলো তাতে তার উপর একটি এক বছর বয়সের উট যাকাত ফরজ ছিলো। আমি বললাম, এক বছরের একটি উষ্ট্রি দিয়ে দাও। সে বলল, সে তো দুধও দিবে না এবং তার পিঠে আরহণ করাও যাবে না। কাজেই আমার এই যৌবনে পদার্পণকারী মোটা তাজা উষ্ট্রিটিই গ্রহণ করুন। তখন আমি বললাম, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুমতি ছাড়া এটি গ্রহণ করতে পারবো না। তবে রাসূল (ছাঃ) তোমার থেকে নিকটবর্তী কোন স্থানে অবস্থান করছেন। তুমি যদি চাও তাহলে তুমি তোমার যে উষ্টিটি আমার নিকট পেশ করছিলে তা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট পেশ করতে পার। যদি তিনি তা গ্রহণ করেন তাহলে আমিও তা গ্রহণ করবো। আর যদি তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে আমিও তা প্রত্যাখ্যান করবো। সে বলল, আমি তা (রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট) পেশ করবো। অতঃপর যে উষ্ট্রিটি সে আমার নিকট পেশ করছিলো সে উষ্ট্রিটি নিয়ে আমার সাথে রওনা দিলো। এমকি আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট পৌঁছে গেলাম। তখন সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনার নিয়োজিত যাকাত আদায়কারী আমার কাছে যাকাত আদায়ের উদ্দেশ্যে এসেছিল। আর আল্লাহর শপথ! ইতিপূর্বে আপনার পক্ষ থেকে কেউ আমার নিকট যাকাত আদায়ের জন্য আসেনি। আমি তার সামনে আমার সম্পদ পেশ করলাম। তখন তিনি বললেন, আমার উপর একটি এক বছরের উষ্ট্রি যাকাত ফরয। অথচ সেটি দুধও দিবে না এবং তার পিঠে আরহণও করা যাবে না। আমি তার নিকট যৌবনে পদার্পণকারী মোটা তাজা উষ্ট্রি গ্রহণ করার জন্য পেশ করলাম। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। আর এই হচ্ছে সেই উষ্ট্রি যা আমি আপনার নিকট নিয়ে এসেছি, আপনি তা গ্রহণ করুন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমার উপর ফরয ছিল তাই যা সে বলেছে। কিন্তু যদি তুমি নিজের খুশীতে ভালো কাজ করতে চাও তাহলে আল্লাহ তা'আলা তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিবেন। আর আমরাও তা গ্রহণ করবো। সে বলল, এই হচ্ছে সেই উষ্ট্রি যা আপনার নিকট নিয়ে এসেছি। অতএব আপনি তা গ্রহণ করুন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তা গ্রহণ করার নির্দেশ দিলেন এবং তার সম্পদের বরকতের জন্য দো'আ করলেন।(আবুদাউদ হা/১৫৮৩; ছহীহ ইবনু খাযায়মাহ হা/২২৭৭)
যাদেরকে যাকাত দেওয়া যাবে না
১. যার যাকাত দেওয়ার মতো সম্পদ রয়েছে (নিসাব পরিমাণ) তাকে যাকাত দেয়া যাবে না। ২. কোন অমুসলিমকে যাকাত দেওয়া যাবে না। ৩. যে সমস্ত মাদরাসায় ইয়াতীমখানা ও লিল্লাহ বোডিং আছে সেখানে যাকাত দেয়া যাবে এবং যে সমস্ত মাদরাসায় লিল্লাহ বোডিং নেই সেখানে যাকাত দেয়া যাবে না। ৪. পিতামাতাকে, সন্তানকে, স্বামী বা স্ত্রীকে যাকাত দেয়া যাবে না। ৫. প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ইয়াতীমখানা লিল্লাহ বোডিংয়ের জন্য যাকাত আদায়কারী নিযুক্ত হলে তাকে যাকাত দেয়া যাবে না। ৬. উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি উপার্জন ছেড়ে দিয়ে নামায-রোযা ইত্যাদি নফল ইবাদতে মশগুল হয়ে যায় তাকে যাকাত দেয়া যাবে না। তবে সে যদি উপার্জন না থাকার কারণে যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত হয় তবে যাকাত দেয়া যাবে।
যাকাত পরিশোধ না করার পরিণাম
আল্লাহ তায়ালা বলেন, "আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পূঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে না, তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন স্বর্ণ ও রৌপ্য জাহান্নামের অগ্নিতে উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। সেদিন বলা হবে, এটা তা যা তোমরা নিজেদের জন্য পূঞ্জীভূত করতে। সূতরাং তোমরা যা পূঞ্জীভূত করেছিলে তা আস্বাদন কর।" (সুরা তওবা-৩৪-৩৫)
১.আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা:) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, "কোনো ব্যক্তি যদি তার ধনসম্পদের যাকাত না দেয় তবে ঐ সম্পদ কিয়ামতের দিন অজগর সাপের আকার ধারণ করে তার গলদেশ বেষ্টন করবে"। অতঃপর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুরা আল-ইমরানের ১৮০ নং তিলাওয়াত করলেন, 'আল্লাহ তাদেরকে নিজের অনুগ্রহে যা দান করেছেন তাতে যারা কৃপণতা করে এই কার্পন্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেনো ধারণা না করে। বরং এটা তাদের পক্ষে একান্তই ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হবে। যাতে তারা কার্পন্য করে সে সমস্ত ধন-সম্পদকে কিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ী বানিয়ে পরানো হবে। আর আল্লাহ হচ্ছেন আসমান ও যমীনের পরম সত্ত্বাধিকারী। আর যা কিছু তোমরা কর; আল্লাহ সে সম্পর্কে জানেন।" (সুরা আল-ইমরানঃ ১৮০)
২.হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, "সুদখোর, সুদদাতা, এর সাক্ষী ও লেখক, উল্কি অংকনকারিণী এবং যে নারী উল্কি অংকন করায়, অভিশপ্ত ঐ ব্যক্তি যে যাকাত দিতে অস্বীকার করে, হিল্লাকারী ও যার জন্য হিল্লা করানো হয়, এদের সকলের উপর আল্লাহর অভিশাপ বা লা'নত "।(আহমাদ ও নাসায়ী)
৩.হাদীসে বর্ণিত আছে , একদা দু'জন মহিলা রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট আসল। তাদের দু'জনের হাতে স্বর্ণের কংকণ ছিলো। তখন নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমরা তোমাদের অলঙ্ককারের যাকাত দাও কি?" তারা বললো, "না "। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, "তোমরা কি পছন্দ করবে যে, আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে আগুনের দু'টি বালা পরিয়ে দিবেন"? তারা দু'জন বলল, "না "। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, "তাহলে তোমরা এ স্বর্ণের যাকাত প্রদান কর"। (তিরমিযি)
৪. ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, 'আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই ও মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল, আর ছালাত ক্বায়েম করে ও যাকাত আদায় করে। তারা যদি এগুলো করে, তবে আমার পক্ষ হতে তাদের জান ও মালের নিরাপত্তা লাভ করলো; অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোনো কারণ থাকে, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহর উপর ন্যাস্ত'।(বুখারী হা/২৫)
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে যাকাত অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের উপর এক বিপ্লবাত্মক কর্মকাণ্ডের সূচনা করেছে। সমাজে সম্পদের সুষম বণ্টনের নিশ্চয়তা বিধানই যাকাতের মূল উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতে, সুন্নাহ মোতাবেক জমিতে উৎপাদিত ফসল বা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পশুপালন, ব্যবসায়ে টাকা খাটানো ইত্যাদি সম্পর্কে যাকাত প্রদানে পরিমাণের ভিন্ন ভিন্ন অংশ রয়েছে।
সবকিছু বিবেচনায় এনে একথা বলা চলে যে, সত্যিকার অর্থে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক যাকাত প্রদানের মাধ্যমেই ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য অনেকাংশে লাঘব করা সম্ভব। পরিশেষে এটাও লক্ষণীয় বিষয় যে, পরম করুনাময় স্রষ্টা যাকাত আদায়ের তাগিদ দিয়েই মানুষকে সম্ভবত সম্পদের হিসাব-নিকাশ সংরক্ষণের দিকে ধাবিত করেছেন। এদিক থেকে সম্পদের বার্ষিক হিসাব-নিকাশ করার জন্য মানবজাতিকে হিসাববিজ্ঞান সৃষ্টির দিকে অনুপ্রাণিত করেছেন বলে বলা যায়। কারণ, প্রত্যেক নবীর মাধ্যমেই তার উম্মতের উপর যাকাত আদায় ফরজ করা হয়েছে। সেই সুবাদে মানবজাতির সূচনাকাল থেকেই হিসাব বিজ্ঞানেরও সূচনা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
লেখক : খতিব, কালেক্টরেট জামে মসজিদ ও আরবি প্রভাষক,
মান্দারী আলিম মাদ্রাসা, চাঁদপুর।