প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা যদি রোজা রাখ তবে তাতে রয়েছে তোমাদের জন্য কল্যাণ, যদি তা উপলব্ধি করতে পার। (সুরা বাকারা : ১৮৪) ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত কল্যাণকর, পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। তাই এতে স্বাস্থ্যনীতিও রয়েছে। দেহকে অযথা কষ্ট দেওয়া ইসলামের বিধি নয়। রোজা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম। সকল সক্ষম ঈমানদারদের ওপর আল্লাহ তায়ালা রমজানের একমাস রোজা ফরজ করেছেন। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাহদেরকে নিছক কষ্ট দেওয়ার জন্যে এটি ফরজ করেননি।
আল্লাহ তায়ালা রোজা পালনের নানাবিধ কল্যাণের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণ গবেষণা করে উপরিউক্ত আয়াতের সত্যতা প্রমাণ করেছেন। রোজার প্রায় সকল হুকুম আহকাম স্বাস্থ্যরক্ষার দিকে লক্ষ্য রেখেই করা হয়েছে। যেমন- শিশু ও অতিবৃদ্ধের জন্যে রোজা ফরজ নয়। সফরে ও অসুস্থ অবস্থায় রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় বেশি কষ্ট না পাওয়ার জন্যে সাহরির ব্যবস্থা ইত্যাদি।
এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ইউরোপের ঘরে ঘরে ইদানীং রোজা পালন করার হিড়িক পড়েছে। সবার মুখে এক কথা- শরীরটাকে ভালো রাখতে চাও তো রোজা করো। এ ধরনের চেতনা সৃষ্টির পিছনে সত্তর দশকে প্রকাশিত একটি বই বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বইটি হচ্ছে প্রখ্যাত জার্মান চিকিৎসাবিদ ড. হেলমুট লুটজানার-এর The Secret of Successful Fasting অর্থাৎ উপবাসের গোপন রহস্য। বইটিতে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের গঠন ও কার্যপ্রণালি বিশ্লেষণ করে নীরোগ, দীর্ঘজীবী ও কর্মক্ষম স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে বছরের কতিপয় দিন উপবাসের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ড. লুটজানারের মতে, খাবারের উপাদান থেকে সারাবছর ধরে মানুষের শরীরে জমে থাকা কতিপয় বিষাক্ত পদার্থ (টকসিন), চর্বি ও আবর্জনা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র সহজ ও স্বাভাবিক উপায় হচ্ছে উপবাস। উপবাসের ফলে শরীরের অভ্যন্তরে দহনের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে শরীরের ভিতর জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থসমূহ দগ্ধীভূত হয়ে যায়।
উল্লেখ্য যে, ‘রমজান’ শব্দটির উৎপত্তি আরবি ‘রমজ’ ধাতু থেকে। এর অর্থ দহন করা, জ্বালিয়ে দেওয়া ও পুড়িয়ে ফেলা। এভাবে ধ্বংস না হলে, ঐসব বিষাক্ত পদার্থ শরীরের রক্তচাপ, একজিমা, অন্ত্র ও পেটের পীড়া ইত্যাদি বিভিন্ন রোগব্যাধির জন্ম দেয়। এছাড়াও উপবাস কিডনি ও লিভারের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং শরীরে নতুন জীবনীশক্তি ও মনে সজীবতার অনুভূতি এনে দেয়।
রোজা পালনের ফলে মানুষের শরীরে কোনো ক্ষতি হয় না; বরং অনেক কল্যাণ সাধিত হয়। তার বিবরণ কায়রো থেকে প্রকাশিত 'Science Calls for Fasting' গ্রন্থে পাওয়া যায়। পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন, "The power and endurance of the bodz under fasting conditions are remarkable : After a fast properly taken the bodz is literally born afresh." অর্থাৎ রোজা রাখা অবস্থায় শরীরের ক্ষমতা ও সহ্যশক্তি উল্লেখযোগ্য সঠিকভাবে রোজা পালনের পর শরীর প্রকৃতপক্ষে নতুন সজীবতা লাভ করে।
রোজা একই সাথে দেহে রোগ প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। রোজাব্রত পালনের ফলে দেহে রোগ জীবাণুবর্ধক জীর্ণ অন্ত্রগুলো ধ্বংস হয়, ইউরিক এসিড বাধাপ্রাপ্ত হয়। দেহে ইউরিক এসিডের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন প্রকার নার্ভ সংক্রান্ত রোগ বেড়ে যায়। রোজাদারের শরীরের পানির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার ফলে চর্মরোগ বৃদ্ধি পায় না। আধুনিক যুগের চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোজার ব্যবহারিক তাৎপর্য উপলব্ধি করেই জার্মান, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ব্যবস্থাপত্রে প্রতিবিধান হিসেবে এর উল্লেখ করা হচ্ছে।
ডা. জুয়েলস এমডি বলেছেন, “যখনই একবেলা খাওয়া বন্ধ থাকে, তখনই দেহ সেই মুহূর্তটিকে রোগমুক্তির সাধনায় নিয়োজিত করে।”
ডক্টর ডিউই বলেছেন, “রোগজীর্ণ এবং রোগক্লিষ্ট মানুষটির পাকস্থলী হতে খাদ্যদ্রব্য সরিয়ে ফেল, দেখবে রুগ্ণ মানুষটি উপবাস থাকছে না, সত্যিকাররূপে উপবাস থাকছে রোগটি।” তাই একাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইবনে সিনা তার রোগীদের তিন সপ্তাহের জন্য উপবাস পালনের বিধান দিতেন।
রমজান মাসে অন্য মাসের তুলনায় কম খাওয়া হয় এবং এই কম খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, দীর্ঘজীবন লাভের জন্যে খাওয়ার প্রয়োজন বেশি নয়। কম ও পরিমিত খাওয়াই দীর্ঘজীবন লাভের চাবিকাঠি। বছরে একমাস রোজা রাখার ফলে শরীরের অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিশ্রাম ঘটে। এটি অনেকটা শিল্প-কারখানায় মেশিনকে সময়মতো বিশ্রাম দেওয়ার মতো। এতে মেশিনের আয়ুষ্কাল বাড়ে। মানবদেহের যন্ত্রপাতিরও এভাবে আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পায়।
ডা. আলেক্স হেইগ বলেছেন, “রোজা হতে মানুষের মানসিক শক্তি এবং বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়। স্মরণশক্তি বাড়ে, মনোসংযোগ ও যুক্তিশক্তি পরিবর্ধিত হয়। প্রীতি, ভালোবাসা, সহানুভূতি, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটে। ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি প্রভৃতি বেড়ে যায়। এটি খাদ্যে অরুচি ও অনিচ্ছা দূর করে। রোজা শরীরের রক্তের প্রধান পরিশোধক। রক্তের পরিশোধন এবং বিশুদ্ধি সাধন দ্বারা দেহ প্রকৃতপক্ষে জীবনীশক্তি লাভ করে। যারা রুগ্ণ তাদেরকেও আমি রোজা পালন করতে বলি।”
বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড নারায়াড বলেন, “রোজা মনস্তাত্ত্বিক ও মস্তিষ্ক রোগ নির্মূল করে দেয়। মানবদেহের আবর্তন-বিবর্তন আছে। কিন্তু রোজাদার ব্যক্তির শরীর বারবার বাহ্যিক চাপ গ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জন করে। রোজাদার ব্যক্তি দৈহিক খিঁচুনি এবং মানসিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয় না।”
ডাঃ এএম গ্রিমী বলেন, “রোজার সামগ্রিক প্রভাব মানব স্বাস্থ্যের ওপর অটুটভাবে প্রতিফলিত হয়ে থাকে এবং রোজার মাধ্যমে শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে।”
ডা. আর ক্যাম ফোর্ডের মতে, “রোজা হচ্ছে পরিপাক শক্তির শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী।”
ডা. বেন কিম বেশ কিছু রোগের ক্ষেত্রে উপবাসকে চিকিৎসা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ (হাঁপানি), শরীরের র্যাশ, দীর্ঘদিনের মাথাব্যথা, অন্ত্রনালীর প্রদাহ, ক্ষতিকর নয় এমন টিউমার ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে তিনি বলেন, উপবাসকালে শরীরের যেসব অংশে প্রদাহজনিত ঘা হয়েছে তা পূরণ এবং সুগঠিত হতে পর্যাপ্ত সময় পেয়ে থাকে। বিশেষত খাদ্যনালী পর্যাপ্ত বিশ্রাম পাওয়াতে তার গায়ে ক্ষয়ে যাওয়া টিস্যু পুনরায় তৈরি হতে পারে। সাধারণত দেখা যায় টিস্যু তৈরি হতে না পারার কারণে অর্ধপাচ্য আমিষ খাদ্যনালী শোষণ করে দুরারোগ্য সব ব্যাধির সৃষ্টি করে। ডা. বেন কিম আরও বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন উপবাস কিভাবে দেহের সবতন্ত্রে স্বাভাবিকতা রক্ষা করে।
প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. জন ফারম্যান সুস্বাস্থ্য রক্ষায় উপবাস এবং খাবার গ্রহণের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে উপবাসের স্বপক্ষে মত দিয়েছেন। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় হলো, রমজানের রোজা রাখার সুফল পাওয়া যায় না মূলত খাদ্যাভ্যাস ও রুচির জন্য।
বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম বলেছেন, “রোজা মানুষের দেহে কোনো ক্ষতি করে না। ইসলামে এমন কোনো বিধান নেই, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। গ্যাস্ট্রিক ও আলসার-এর রোগীদের রোজা নিয়ে যে ভীতি আছে তা ঠিক নয়। কারণ রোজায় এসব রোগের কোনো ক্ষতি হয় না; বরং উপকার হয়। রমজান মানুষকে সংযমী ও নিয়মবদ্ধভাবে গড়ে তোলে।”
১৯৫৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডা. গোলাম মুয়াযযম কর্তৃক ‘মানব শরীরের ওপর রোজার প্রভাব’ শীর্ষক যে গবেষণা চালানো হয়, তাতে প্রমাণিত হয় যে, রোজার দ্বারা মানব শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। কেবল ওজন সামান্য কমে। তাও উল্লেখযোগ্য কিছুই নয়; বরং শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমাতে এরূপ রোজা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অপেক্ষা বহুদিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ।
১৯৬০ সালে তার গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, যারা মনে করে রোজা দ্বারা পেটের শূলবেদনা বেড়ে যায়, তাদের এ ধারণা নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক। কারণ উপবাসে পাকস্থলীর এসিড কমে এবং খেলেই এটি বাড়ে। এ অতি সত্য কথাটি অনেক চিকিৎসকই চিন্তা না করে শূলবেদনার রোগীকে রোজা রাখতে নিষেধ করেন।
সতেরোজন রোজাদারের পেটের রস পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, যাদের পাকস্থলীতে এসিড খুব বেশি বা খুব কম রোজার ফলে তাদের এ উভয় দোষই নিরাময় হয়েছে। এ গবেষণায় আরও প্রমাণিত হয় যে, যারা মনে করেন রোজা দ্বারা রক্তের পটাসিয়াম কমে যায় এবং তাতে শরীরের ক্ষতি সাধন হয়, তাদের এ ধারণাও অমূলক। কারণ পটাসিয়াম কমার প্রতিক্রিয়া প্রথমে দেখা যায় হৃদপি-ের ওপর অথচ এগারোজন রোজাদারের হৃদপি- অত্যাধুনিক ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম যন্ত্রের সাহায্যে (রোজার পূর্বে ও রোজা রাখার পঁচিশ দিন পর) পরীক্ষা করে দেখা গেছে রোজা দ্বারা তাদের হৃদপি-ের ক্রিয়ার কোনোই ব্যতিক্রম ঘটেনি।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক; বিভাগীয় প্রধান (হাদিস) আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স