প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
(গত সংখ্যার পর)
১২.
সম্প্রতি দৈনিক সংবাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় (১৭ জুলাই, ২০১৮) প্রকাশিত তাঁর অত্যন্ত যুগোপযুগী শিক্ষাচিন্তা ‘শিক্ষকের মর্যাদা প্রসঙ্গ প্রসঙ্গান্তর’ রচনাটিও মনে দাগ কাটে। শিক্ষা গবেষক হিসেবে অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান উল্লেখ করতে দ্বিধা করেন না, ‘শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়টি আমাদের দেশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রসঙ্গ। বিশেষ করে গড়পড়তা মানুষের আর্থিক সক্ষমতা যখন বাড়ছে তখন এই প্রসঙ্গটি জোড়ালো হয়ে উঠছে। মানুষের আর্থিক সক্ষমতা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিপুল উত্থানের এই ক্রান্তিলগ্নে সামাজিক যে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে এবং সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের যে সঙ্কট তৈরি হচ্ছে তার সঙ্গে বিচিত্র অনুষঙ্গে শিক্ষকের মর্যাদার প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আলোচনার এই পটভূমিতে যাওয়ার পূর্বে আমাদের বিবেচনা করতে হচ্ছে যে, ‘শিক্ষক’ কাকে বলে, আর তার পরিপূর্ণ অবয়বটি-বা কেমন।’ তিনি আরো উল্লেখ করছেন, ‘একজন শিক্ষককে প্রথমেই ভালো শিক্ষক হতে হবে। একসময় মনে করা হতো যে, একজন ভালো শিক্ষক মানে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী গুরুগম্ভীর একজন মানুষ। শিক্ষার্থীরা কী বুঝল বা না বুঝল তাকে কিছুমাত্র বিবেচনায় না নিয়ে তিনি মনের আনন্দে বক্তৃতা দিবেন এবং শিক্ষার্থীদের প্রচণ্ড শাসনের মধ্যে রেখে ক্লাসের কাজ শেষ করবেন। শিখন-শেখানোর এই সনাতন পদ্ধতি এখনো বর্তমান আছে। এই পদ্ধতিতে যারা শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করেন তারা কোনো অবস্থাতেই ভালো শিক্ষক নন। অ্যাডাম স্মিথ (১৭২৩-১৭৯০) একটি চমৎকার কথা বলেছেন : ‘The Teacher Teaches John Latin’। এর মানে হলো শিক্ষককে শুধু ল্যাটিন জানলেই হবে না, তাকে ‘জন’কেও জানতে হবে। জনের সম্পর্কে জ্ঞান থাকা মানে হচ্ছে তার মনের গড়ন, প্রকৃতি, ক্ষমতা, তার আবেগ, ভালো লাগা-মন্দ লাগা ইত্যাকার বিচিত্র বিষয় সম্পর্কে শিক্ষকের পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকা অপরিহার্য। খুব ছোট একটি বাক্যের মধ্যে অ্যাডামস আধুনিক শিক্ষামনস্তত্ত্বের পুরো জগতটিকে ধরতে চেষ্টা করেছেন। এক পরিমাপকে সকল শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করার যুগ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এখন প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে এক একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব (individual personality) হিসেবে বিবেচনা করতে হয় এবং প্রত্যেকের স্বতন্ত্র শিখনচাহিদাকে সন্তুষ্ট করতে হয়।’
১৩.
প্রাবন্ধিক, গবেষক অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান সমাজের অসুখ জানেন বলেই লিখছেন, ‘শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করার যুগও শেষ হয়েছে। কেননা শিক্ষাবিজ্ঞানিগণ স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করতে পেরেছেন যে, শারীরিক ও মানসিক শাস্তির ভেতর দিয়ে শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত ও সুনাগরিক করে তোলা যায় না। উপরন্তু এ ধরনের শাস্তি তার মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং তার বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয় । সুতরাং একজন ভালো শিক্ষক অবশ্যই বিবেচনায় রাখবেন যে, তার ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থী যেন তার আচরণে বিব্রত না হয়, অপমানিত না হয়, মনোকষ্ট না পায়। বরং তার ক্লাসটি সকল শিক্ষার্থীর জন্য হবে আনন্দদায়ক। ক্লাসে সকল শিক্ষার্থী শিক্ষকের নির্দেশনা মতো কথা বলবে, কাজ করবে, আঁকবে, দেখবে, পড়বে। অর্থাৎ শিক্ষকের কাজ হলো ক্লাসে শিখন-শেখানো কার্যক্রমে সকল শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। তিনি কোনো অবস্থাতেই বিবেচনায় রাখবেন যে, কোন শিক্ষার্থী দুর্বল, কোন শিক্ষার্থীর ধর্মীয় পরিচয় কী, কোন শিক্ষার্থীর আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান কী, কোন শিক্ষার্থী দেখতে কেমন, কোন শিক্ষার্থীর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী। তিনি শুধু বিবেচনায় রাখবেন যে, সকল শিক্ষার্থী তার ছাত্র বা ছাত্রী। এমনকি শিক্ষার্থীর লৈঙ্গিক পরিচও গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। তিনি সকলকে সমান চোখে দেখবেন এবং শিখনচাহিদার ভিন্নতা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের পাঠদান করবেন। শিক্ষককে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তার মনোযোগ ও স্নেহ থেকে কোনো শিক্ষার্থী যেন বঞ্চিত না হয়। তিনি যেন কিছুতেই বৈষম্যমূলক আচরণ না করেন। ক্লাসরুমে তিনি এমন একটি বন্ধুর পরিবেশ তৈরি করবেন যেখানে সকল শিক্ষার্থী নিজেদের সবচেয়ে নিরাপদ মনে করবে। একজন শিক্ষক সর্বদাই আশাবাদী মানুষ। তার চিন্তায়, কর্মে ও কথায় এবং তার সামগ্রিক জীবনাচরণে একজন আশাবাদী মানুষের পরিচয় মূর্ত হয়ে উঠবে। শিক্ষার্থীদেরও তিনি আশাবাদী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। সুতরাং তার দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে জীবনের প্রতি কৌতূহল ও মমত্ববোধ তৈরি করা। প্রত্যেক শিক্ষার্থী যেন তার অফুরন্ত সামর্থ্যরে সঙ্গে পরিচিত হতে পারে, অফুরন্ত সম্ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হতে পারে- শিক্ষক তার সেই সম্ভাবনার দরজা-জানালাগুলো খুলে দেবেন। শিক্ষক শিক্ষার্থীকে চিন্তার চর্চা করতে শেখাবেন আর সৃষ্টিশীল ভাবনার বিকাশ ঘটানোর পথ করে দেবেন। এইভাবে তিনি মর্যাদাবান মানুষ হয়ে উঠবেন।’
১৪.
শিক্ষা গবেষক অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান-এর মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই যখন তিনি শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানে ও জীবন বাস্তবতার নিরিখে উল্লেখ করেন, ‘সকল শিক্ষার্থী পড়াশোনায় ভালো হবে এমনটা আশা করা নিশ্চয় যৌক্তিক নয়, বাস্তবও নয়। মেধার দিক থেকে কিছু শিক্ষার্থী দুর্বল (slow learner), বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী মাঝারি (mediocre learner) এবং কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী উত্তম (first learner)। আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অধিকাংশ সময় সবচেয়ে বেশি যত্ন নেয়া হয় উত্তম শিক্ষার্থীদের প্রতি। এটা অনেকাংশে তেলা মাথায় তেল দেওয়ার মতো। আর দুর্বল শিক্ষার্থীরা শুধু অবহেলিতই থাকে না তারা নানাভাবে লাঞ্ছিতও হয়। পরিবার-পরিজনেরে মধ্যে যেমন তারা অত্যাচারিত হয় তেমনি স্কুলেও তারা শিক্ষকদের মনোযোগ ও স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়। এমনকি তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিতও করা হয়। বিষয়টি যেন এমন যে, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ভালো না করতে পারলে মানবজীবন বৃথা। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যারা শিক্ষার্থীদের বিবেচনা করেন তারা কখনই ভালো শিক্ষক হতে পারেন না। প্রত্যেক শিক্ষার্থী যে মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ, সম্মানের পাত্র শিক্ষকগণ কিছুতেই তা বুঝতে চান না। বরং তারা শিক্ষার্থীদের নানাভাবে লাঞ্ছিত করেন, অপমান করেন, মানসিক ও শারীরিক সাস্তি দিয়ে অস্তিত্বহীন করে তোলেন।’
(চলবে)