প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে যদি একজন শিক্ষার্থী দেশ, দশ এবং সমাজের উপকারে লাগে তবে সেটাই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থকতা’ এই মূল্যবান বাক্যটি করেছিলেন বাউবির সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এম.এ. মান্নান স্যার। তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বের কারণে বাউবি একটি পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে উঠে। আর এ ধারা এখনও অব্যাহত। সমকালীন বিশ্বে মুখোমুখি বা প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতার কারণে সবার জন্যে শিক্ষা, জীবনব্যাপী শিক্ষা, অব্যাহত শিক্ষা প্রভৃতি ধারণা থেকে বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে উন্মুক্ত ও দূরশিক্ষা পদ্ধতির প্রচলন করা হয়েছে। আমাদের সবার মনে রাখতে হবে, শিক্ষালাভ প্রতিটি ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার চাপ তথা ভর্তি বা আসন সমস্যা সমাধানের জন্যে বা চাহিদার প্রয়োজনে দূরশিক্ষা বা উন্মুক্ত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করা অসম্ভব। দূরশিক্ষার ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ১৮৪০ সালে স্যার আইজাক পিটম্যান (নাইট উপাধীপ্রাপ্ত) তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের পোস্টকার্ডের উপর সংক্ষিপ্ত আকারে (শর্ট হ্যান্ড পদ্ধতিতে) প্রতিলিপিকৃত পাঠ্যগুলোকে মেইল করে ফিডব্যাকের মাধ্যমে তা আবার সংশোধন করে দিতেন। তাঁর এ পদ্ধতি তখন ইংল্যান্ডে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো। এজন্যে তাঁকে দূরশিক্ষণের পথপ্রদর্শক বলা হয়। ১৮৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একটি সোসাইটির অধীনে করেসপোন্ডেন্স স্কুল গঠন করে বাড়িতে বসে লেখাপড়ার মাধ্যমে সাহস জোগানো হতো। একের পর এক বিভিন্ন দেশে দূরশিক্ষণের জন্যে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বা উন্মুক্ত কলেজ গঠিত হয়। বর্তমানে বিশ্বে আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ ৯৫টি দেশে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আছে। বাউবি একই সাথে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে নানাবিধ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন উচ্চশিক্ষার সাথে কারিগরি শিক্ষাকে জোরদার করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী এবং শিক্ষাবঞ্চিতদের জন্যে অনন্য অসাধারণ শিক্ষালয় বাউবি।
দেশের একমাত্র উন্মুক্ত ও দূরশিক্ষা ব্যবস্থার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বাউবি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় সারা বিশ্বে এর স্থান ৭ম এবং বাংলাদেশে ২য়। ১৯৯২ সালে পার্লামেন্টের ৩৮ নম্বর অধীনে ২১ অক্টোবর ঢাকা থেকে ৪০ কি.মি. উত্তরে গাজীপুরে ৩৫ একর জমিতে নির্মিত বাউবির দেশে-বিদেশে রয়েছে অনেক শাখা-প্রশাখা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ‘বোর্ড অব গভর্নরস’ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে। শিক্ষাপদ্ধতি ক্রেডিট, কোর্স এবং সেমিস্টার সিস্টেমের হলেও তুলনামূলক খরচ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কম। বাউবির প্রশাসনিক কার্যক্রম ১১টি বিভাগের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ১২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র, ৮০টি উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্র, ১৫১৬টি স্টাডি সেন্টার, ৩২টি আনুষ্ঠানিক ও ১৯টি অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাক্রম চালু আছে। ৬ লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর জন্যে রয়েছে ২৯৫০৭ জন টিউটর। এসএসসি থেকে পিএইচডি পর্যন্ত সকল রকমের শিক্ষার ব্যবস্থা এখানে আছে। আমাদের দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এসএসসি এবং এইচএসসি পড়ানো হয় না। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শিক্ষার্থীরা তাদের নির্ধারিত স্টাডি সেন্টারে গিয়ে কিছু সময়ের জন্যে টিউটরদের কাছে ক্লাস করেন, টিউটরগণ শিক্ষার্থীদের যে কোনো সমস্যা আন্তরিকতার সাথে সহজভাবে সমাধান করে দেন। এছাড়াও রেডিও, টেলিভিশনে নির্ধারিত সময় ব্যতীত অনলাইনে তাদের লিংকে প্রবেশ করে ক্লাস করা যায়। বাউবির পাঠ্যবইগুলো এমনভাবে রচিত , যা কয়েকবার পাঠ করলেই শিক্ষার্থীরা সহজে অনুধাবণ করে পরীক্ষায় লিখতে পারে। উন্মুক্ত বা দূরশিক্ষা এখন আর আপেক্ষিকভাবে নতুন শব্দ নয়।
করোনাকালে সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও সকল শিক্ষাস্তরে দূরশিক্ষা চালু ছিলো। এটা ছিলো এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ এবং বাউবির কনসেপ্ট। আজকের আপামর জনতা সহজেই বুঝতে পেরেছেন বাউবির মূল দর্শন কী? বাউবির মূল দর্শন হলো, সকলের জন্যে শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করা। উন্মুক্ত বলতে, এখানে বয়সের কোনো বিধি-নিষেধ নেই। নেই জাতি, ধর্ম, শ্রেণি, বর্ণ-বৈষম্য। আছে বাস্তবতার বিচারে সঠিক মূল্যায়ন। অনেক শিক্ষার্থী কারণে অকারণে সময়মত প্রথাগত শিক্ষা অর্জনে সময় পায়নি, হতে পারে ভৌগোলিক দিক থেকে তারা ছিলো অনগ্রসর এলাকার বাসিন্দা, কারো জীবনে ঘটে গেছে শৈশবে-কৈশোরে সংসারে আর্থিক অভাব-অনটনের জন্যে বাধ্যতামূলকভাবে শিশুশ্রম। ভাগ্য বিড়ম্বনায় সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বা বিচ্যুত, বাল্যবিবাহের অভিশাপে মেধা থাকা সত্ত্বেবও বিশেষ করে নারীদের আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরতে না পারা, কেউ কেউ ছোটোখাটো পদে কর্মরত কিন্তু সনদের অভাবে বড় পদে না যেতে পারা। এ রকম নানাবিধ সমস্যা গভীরভারে গবেষণা করে সবকিছুই উন্মুক্ত করে দিয়ে সমাধানের জাদুরকাঠি হাতে নিয়ে এসেছে বাউবি।
দূরশিক্ষাকে সহজভাবে বলা যায় দূর থেকে শিক্ষাগ্রহণ। যেমন অনেকেই আজ কর্মস্থল বা আবাসস্থল থেকে নিজের চেষ্টায় বাউবির মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করে সমাজ এবং দেশকে আলোকিত করছেন। ৮৪ বছর বয়সী সিনিয়র সহকারী সচিব শাহজাহান বিশ্বাস এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে ত্রিপল (মানে তিনবার) এমএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি উন্মুক্ত এবং দূরশিক্ষার এক গৌরবময় উদাহরণ, এ রকম আরও শত শত উদাহরণ আছে। বৈপ্লবিক চিন্তাধারার জন্যে ওপেন এবং ডিস্টেন্স এডুকেশনের সবকিছুকে নমনীয় এবং সহনীয় করা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্বে কিছু প্রতিষ্ঠান, বিভাগের অবদান আছে। যেমন এসবিপি, এনআইইএমটি, বিআইডিই ইত্যাদি।
১৯৫৬ সালে দুইশত রেডিও সেট বিতরণের মধ্য দিয়ে এদেশে দূরশিক্ষার গোড়পত্তন ঘটে এবং ১৯৮১ সালে এর সম্ভাব্যতা যাচাই হয়। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ দূরশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (বাইড) স্থাপিত হয়। বাইড রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দূরশিক্ষণে বিএড প্রোগ্রাম চালু করে এবং ১৯৯২ সালে বাউবির প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত উক্ত প্রোগ্রাম অব্যাহত ছিলো। বাউবির সূচনা হয়েছিলো স্কুল অব এডুকেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে।
আজ ৩০ বছর পেরিয়ে শিক্ষা প্রসারে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে প্রবাসী কল্যাণে এগিয়ে গেছে স্বপ্নের ঠিকানা বাউবি। দৃষ্টিনন্দন মূল ক্যাম্পাসের মহান দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার তথা আন্তর্জাতিক মানের গড়ে তোলার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাউবির অসংখ্য এবং অগণিত সন্তানেরা দেশে, বিদেশে ছুটে গিয়ে মোমবাতির ন্যায় আলোকিত করছে প্রতিটি জনপদকে। আলোর দিশারী বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথা যেনো সর্বদা থাকে ‘চির উন্নত মম শির’।