প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০
বিখ্যাত বিজ্ঞানী আবুল পাকির জয়নুল আবেদিন আবদুল কালামের গল্প আমরা সবাই জানি। এপিজে আবদুল কালাম হতে চেয়েছিলেন বিমানবাহিনীর পাইলট। দেরাদুনে গেছেন ভর্তি পরীক্ষা দিতে। আটজন নেবে, তিনি হলেন নবম। মন খারাপ করে নদীর ধারে বসে আছেন তিনি। এই সময় এক সাধু এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি অন্ধকারে নদীর ধারে একা বসে আছো কেন?’
‘আমার জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে। এই জীবনের কোনো মানে নেই। আমি বিমানবাহিনীর ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছি।’
এপিজে আবদুল কালাম পরে ভারতের বিখ্যাত বিজ্ঞানীই কেবল হননি, ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। আমরা কি এই গল্প থেকে সিদ্ধান্তে আসতে পারি, এপিজে আবদুল কালাম আসলে ‘বাই চয়েজ’ বিজ্ঞানী নন; অথবা তিনি ‘বাই চান্স’ ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন?
দেশের প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তার সাথে আমার পরিচয় ছিল। তিনি যখন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন, তখন একদিন গল্প করতে করতে আমাকে বলেছিলেন, তিনি বুয়েটের প্রকৌশলী। বিসিএস পরীক্ষা দেবার কোন পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। বন্ধুরা সব পরীক্ষা দিচ্ছে দেখে বন্ধুদের সাথে তিনিও বিসিএসে আবেদন করলেন। ব্যাস ঐটুকুই; তিনি বিসিএসের জন্য আলাদা কোন পড়াশোনা বা প্রস্তুতি নিলেন না। অবাক বিষয় হচ্ছে প্রথম প্রচেষ্টাতেই তিনি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে সুযোগ পেয়ে গেলেন! এখন তিনি সরকারের উপ-সচিব। তাহলে আমরা কি বলতে পারি, তিনি ‘বাই চয়েজ’ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা না; তিনি এখন ‘বাই চান্স’ উপ-সচিব!
আমাদের কাছে কি তথ্য আছে, দেশে কতো শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েট তাদের পঠিত বিষয় বা আগ্রহ অনুযায়ী পেশা পছন্দ করার সুযোগ পান? অথবা কতো শতাংশ কর্মজীবী তাদের পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত বিষয়ের প্রতিফলন দেখতে পান? আমাদের দেশে এখন উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ‘ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও বিমা’ নামে একটি বিষয় পড়ানো হয়। অনুমান করি যত বছর যাবৎ শিক্ষাক্রমে এই বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তারচে’ ঢের বেশি সময় ধরে এই দেশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু আছে। তো প্রশ্ন হল, এত বছর কোন ডিসিপ্লিনে পড়া গ্রাজুয়েটরা ব্যাংকার হল? তারা কি সবাই ‘বাই চয়েজ’ ব্যাংকার হয়েছিল?
এখন শিক্ষাক্রমে ‘ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও বিমা’ বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবার পরের জমানার কথা ভাবি-বর্তমানে দেশে সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকলেই কি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ‘ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও বিমা’ পড়েছেন? এখানে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজকর্ম, রাষ্ট্রবিজ্ঞান অথবা ক্রিমিনলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্সে গ্রাজুয়েট করা কেউ কি নেই? যারা আছেন তারা কি ‘বাই চয়েজ’ না ‘বাই চান্স’ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন? আরেকটা বিষয়, আমরা কি হলফ করে বলতে পারি, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ‘ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও বিমা’ পড়া প্রত্যেক গ্রাজুয়েটরাই এখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ পেয়েছেন?
এটা সত্য যে আমাদের দেশের শিক্ষকদের একটা বড় অংশ ঘটনাক্রমে বা ‘বাই চান্স’ শিক্ষক হয়েছেন। হয়তো অন্য কোনো পেশায় তারা যেতে পারেননি, তাই শিক্ষক হয়েছেন। কিন্তু এটা কি শুধুমাত্র শিক্ষকদের ক্ষেত্রেই সত্য? আমাদের দেশের সকল গ্রাজুয়েটরাই কি তাদের পঠিত বিষয় বা আগ্রহ অনুযায়ী পেশা বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়?
আমাদের সমাজের একটি সাধারণ প্রবণতা হল আমরা সামর্থ্যবানদের সম্মান করি। আমাদের দেশে শিক্ষকরা হলেন অর্থ ও ক্ষমতার দিক থেকে দুর্বল শ্রেণির। তাঁর নিজের শিক্ষার্থী ছাড়া অন্যদের কাছ থেকে যথাযথ সম্মান পাওয়ার সম্ভাবনা সীমিত। একজন শিক্ষককে এমপিওভুক্তি, পদোন্নতি, উৎসর ভাতা, ইনক্রিমেন্ট, পেনশনের জন্য লড়াই করতে হবে; তাকে অভাব ও সম্মানের সাথেও লড়াই করতে হবে, এবং এটা জেনেও তিনি শিক্ষকতা পেশাকে ব্রত হিসেবে বেছে নেবেন! আসলে এই বক্তব্যটি যত কম যৌক্তিক, তত বেশি হাস্যকর।
শিক্ষার মান বিশ্লেষণ বলছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের শিক্ষার মান ২ দশমিক ৮ শতাংশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় শিক্ষার মান ২০ দশমিক ৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানের শিক্ষার মান ১১ দশমিক ৩ শতাংশ (বাংলা ট্রিবিউন, ২০.০৯.২০২১)। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, আমাদের দেশে শিক্ষার মান এমন কেন? তাহলে কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এই করুণ হাল কেবল এই ‘বাই চান্স’ শিক্ষকদের জন্যই? কিন্তু কেন শিক্ষকতা আমাদের দেশে একটি ‘বাই চান্স’ পেশা? তার আগে আমাদের জানা উচিৎ শিক্ষকদের সামাজিক ও আর্থিক সুবিধার ক্ষেত্রে আমাদের দেশ এবং উন্নত দেশের মধ্যে পার্থক্য; একই সাথে আমাদের দেশের অন্যসব পেশার সাথে শিক্ষকতা পেশার সামাজিক ও আর্থিক সুবিধার পার্থক্য।
২০২১-২০২২ সালে মোট বাজেট ছয় লাখ তিন হাজার ছয় শত একাশি (৬০৩৬৮১) কোটি টাকা, তার মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ একাত্তর হাজার নয় শত পঞ্চান্ন (৭১৯৫৫) কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১.৯১ শতাংশ। ইউনেস্কো গঠিত ‘একবিংশ শতাব্দীর জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশন’ দেলরস’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রাপ্ত বৈদেশিক সহায়তার ২৫ শতাংশ শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ করা উচিত। অথচ বর্তমানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বার্ষিক বিনিয়োগের পরিমাণ বাংলাদেশে ৫ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ১০ ডলার, ভারতে ১৪ ডলার এবং মালয়েশিয়ায় ১৫০ ডলার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক প্রশ্ন তুলেছেন, যে সমাজে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর মর্যাদা দেওয়া হয় সেখানে শিক্ষকতাকে কেন ‘বাই চয়েজ’ পেশা হিসেবে নেওয়া হবে? দেশের ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্সে ৮ম স্থানে আছেন মন্ত্রীরা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি প্রমুখ (এপিলেট ডিভিশন)। ৯ম স্থানে আছেন প্রতিমন্ত্রীরা, নির্বাচন কমিশনার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ। ১০ম স্থানে আছেন উপমন্ত্রীরা। ১২তম অবস্থানে আছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রধানগণ।
এইরকমভাবে গিয়ে ১৭তম অবস্থানে আছেন জাতীয় অধ্যাপক। জাতীয় অধ্যাপকের উপরে আছেন সচিবরা, মেজর জেনারেল পদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অফিসারগণ। আর সকল অধ্যাপক না, শুধু সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপক অর্থাৎ সিনিয়র অধ্যাপকের অবস্থান হলো ১৯ নম্বরে। এখন আমরা একটু খুঁজে দেখি আমাদের দেশে ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্সে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থান কোথায়?
আমাদের জাতীয় সংসদে আসন রয়েছে ৩০০টি (এর বাইরে আরও ৫০টি সংরক্ষিত আসন রয়েছে)। একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতার সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা সংসদ সদস্য হতে পারবেন না, তারা নিশ্চয়ই দলে অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবেন না? তাদেরও দলে এবং সরকারের গুরুত্ব¡পূর্ণ যায়গায় কাজ করার সুযোগ থাকে, এবং সাধারণত দলের হাই-কমান্ড তাদের সেভাবেই কাজে লাগান। যারা সংসদ সদস্য না হয়ে টেকনোক্রেট কোঠায় মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী হন, তাদের ক্ষেত্রে এই কথাটা বলা সমীচীন হবে না যে তাঁরা ‘বাই চান্স’ কেবিনেটে এসেছেন।
আমাদের দেশে কোন কোন পেশায় আমরা ‘বাই চয়েজ’ আসি? অনেকেই হয়ত ডাক্তার, খেলোয়াড় বা সামরিক অফিসার পেশার কথা উল্লেখ করবেন। যদি তা মেনে নেই, তাহলে কিন্তু অন্যসব পেশায় একটি বড় অংশ আছেন ‘বাই চান্স’। পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার, অভিনেতা, অনেক উদাহরণ দেওয়া সম্ভব যারা এই পেশায় এসেছেন ‘বাই চান্স’। সব থেকে বড় কথা হল, আমরা শিক্ষকতা পেশার জন্য এমন কি করেছি (অন্য পেশার তুলনায়) যাতে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েটরা এই পেশায় ‘বাই চয়েজ’ আসবেন?
শিক্ষকতা পেশায় অনেক সীমাবদ্ধতা থাকার পরেও আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে এইভাবে যে, যারা ‘বাই চান্স’ শিক্ষকতা পেশায় এসেছেন তারা পরে সত্যিকারের শিক্ষক হতে পেরেছেন কি-না? আর ‘বাই চান্স’ কোন পেশায় আসলেই সে অযোগ্য হয়ে যান না; এপিজে আবদুল কালাম পাইলট হননি তবে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশযানবাহী রকেট উন্নয়নের কাজে তার অবদানের জন্য তাকে ‘মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ বলা হয়।
নজরুল ইসলাম : লেখক, এমফিল গবেষক (শিক্ষা) ও সহযোগী বার্তা সম্পাদক, দ্য বাংলাদেশ এক্সপ্রেস। ই-মেইল : [email protected]