প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২২, ০০:০০
স্বপ্নপূরণের সুযোগ হাতড়াতে হাতড়াতে কখন যে পুকুর ছেড়ে বৃহৎ জলাশয়ে এসে পড়েছি সেটা টেরও পাইনি। আর সেই বৃহৎ মুক্ত টলটলে জলাশয়টি হলো চাঁদপুর সরকারি কলেজ। এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী হওয়ার সুযোগ পাওয়াকে আমি সৌভাগ্য মনে করি। যে প্রতিষ্ঠান আমাকে দিয়েছে অফুরন্ত ইচ্ছেশক্তির জ্বালানি। আর জ্বালানির উৎসটি হলো আমার প্রিয় ‘দর্শন বিভাগ’।
আমি বলছি না যে এটি আমার উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্বপ্নের বিষয়গুলোর একটি। বলতে গেলে এ বিষয়টিতে পড়ার সুযোগ পাওয়ার পর কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কেননা এই বিষয় সম্পর্কে পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না বললেই চলে। যেদিন প্রথম ক্লাস করতে গেলাম সেদিন থেকেই ‘দর্শন’ সম্পর্কে আমার সমস্ত দোটানার অবসান ঘটিয়ে এক স্বপ্নের জাদুকাঠি হাতে তুলে দিলেন আমার বিভাগের সম্মানীয় শিক্ষকবৃন্দ।
‘দর্শন পড়বে শুধুমাত্র সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য এমন নয়’ বরং ‘দর্শন মানে জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা’। ‘বিদ্যা অর্জন করো, মানুষ হও’! বিভাগীয় প্রধান জনাব আজহারুল ইসলাম ভূঁইয়া স্যারের সেই মনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কথাটি আজও আমার কানে বাজে। যা দিয়েছে আমায় এক নতুন উদ্যম, নতুন পথ এবং লক্ষ্য পূরণের আলোকিত সন্ধান। প্রাথমিক অবস্থায় জ্বালানি ছিলো মূলত তাঁর এ অনুপ্রেরণা। আর পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী এবং পাশাপাশি কলেজ কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে আমার দক্ষতা উন্নয়নে যিনি সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছেন তিনি হলেন আনিস ফারদীন স্যার। তিনি প্রতিটি শিক্ষার্থীর সকল সমস্যার সমাধানে সর্বদা আন্তরিকভাবে সচেষ্ট থাকেন।
আমার ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি একধরনের ভালোলাগা কাজ করতো। তবে কখনোই সেই দক্ষতা কিংবা প্রতিভাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পাইনি। এমনকি আমি কখনোই কোনো ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণও করিনি। জড়তার বেড়াজাল থেকে স্যারই প্রথম একপ্রকার নিজেই প্রতিযোগিতায় আমার নাম লেখালেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে তখন প্রতিযোগিতায় ¯œাতক পর্যায়ে বিজয়ীও হয়ে যাই আমি। বিজয়ী হয়ে পুরস্কার জিতাটা আমার জন্যে মুখ্য ছিলো না। বরং এতে আমি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। সব জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারি। কলেজের সব কো-কারিকুলাম কার্যক্রম ও প্রতিযোগিতায় এখন অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করি একরকম ভালো লাগা থেকে।
পড়াশোনাটা আমার কাছে কখনোই খুব বেশি আকর্ষণীয় কিছু ছিলো না। মোটামুটি ভালোভাবে পাস করাটাই এতোদিন ছিলো অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু আজকাল ভালো রেজাল্টের নেশাটা মনে হয় মাথায় জেঁকে বসেছে। মনের মাঝে একরকম জেদ তৈরি হয়েছে। আমি প্রতিভা নয়, বরং পরিশ্রমেই বিশ্বাসী ছিলাম ছোট থেকে। তাই এখন পরিশ্রমটাকেই জীবনের লক্ষ্য করে নিয়েছি এবং সেই ইচ্ছেটা জাগিয়েছেন আমার শিক্ষক আনিস ফারদীনসহ অন্যান্য স্যার। নানা সময় নানাভাবে তিনি বুঝিয়েছেন যে পড়ালেখাটা কতোটা জরুরি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। তার অনুপ্রেরণা এবং উপদেশই গতিপথের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। বই পড়াটাও এখন আমার অন্যতম এবং প্রধান শখগুলোর একটি। শুধু পাঠ্যবই-ই নয়, এর পাশাপাশি সাহিত্যের সব ক্যাটাগিরির বইও পড়ছি সমানতালে, কোনো বাছ-বিচার ছাড়াই যা পাচ্ছি তাই পড়ছি এবং গত একবছরে আমার বই পড়া শূন্যের কোঠা থেকে ২০৮টি বই পর্যন্ত পৌঁছেছে। যা আমার নিজের কাছেই বিস্ময়কর মনে হয়।
আমি খুব সৌভাগ্যবতী যে আমি আমার বিভাগের চারজন আদর্শ শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি। এটা শুধু আমার কথা নয় বরং দর্শন বিভাগের প্রতিটি শিক্ষার্থী এভাবেই মূল্যায়ন করবে আমাদের প্রিয় শিক্ষকবৃন্দকে। তাঁরা একাধারে আমাদের শিক্ষক, অভিভাবক এবং পথপ্রদর্শক। চাঁদপুর সরকারি কলেজের স্নিগ্ধপরিবেশ এবং নান্দনিকতা এখানকার আবহাওয়াকে করে তুলেছে শিক্ষার্থীদের অনুকূল, যা শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। আমাদের কলেজের মান্যবর অধ্যক্ষ প্রফেসর অসিত বরণ দাশ স্যারও একজন পিতৃসম ব্যক্তি। যিনি একজন সৃজনশীল মানুষ। অমায়িক এ মানুষটিকে প্রায়ই কলেজ লাইব্রেরিতে ঘুরেফিরে শিক্ষার্থীদের সাথে আন্তরিকভাবে কথা বলতে দেখতে পাই। যিনি ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যাপারে খোঁজখবর নেন এবং বেশ বন্ধুত্বসুলভভাবেই তাদের কাছাকাছি আসেন, ঠিক যেমন বাবারা তার সন্তানদের বোঝান। পাশাপাশি তিনি প্রায়ই বিভিন্ন বিভাগের ক্লাসে চলে যান। শিক্ষা প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হয়েও ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ক্লাস করানোয় ক্যাম্পাসে তিনি জনপ্রিয়, যা খুব কম স্যারের জীবনে ঘটে থাকে।
‘দর্শন’ বিভাগের একজন ছাত্রী হিসেবে আমি ‘দার্শনিক’ হতে না পারলেও একজন আদর্শ মানুষ হতে চাই মনে-প্রাণে। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে ভালো ফলাফল করতে চাই। উপভোগ করতে চাই বিজয়ের সেরা স্বাদটি। পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে নিতে চাই। হতে চাই আমার স্যারদের মতো শিক্ষার্থীদের প্রিয় শিক্ষক। সাথে হতে চাই একজন ভালো মানুষ। দর্শন পড়ায় তা খুব ভালোভাবে আমাকে সহায়তা করবে। কেননা দর্শনে রয়েছে একই সাথে যুক্তিবিদ্যা, নীতিবিদ্যা এবং নন্দনতত্ত্ব ইত্যাদি। যুক্তিবিদ্যা পড়ে আমি নিজেকে যুক্তির আলোকে পরিচালিত করতে পারবো। আমার ব্যক্তিজীবন পরিচালিত হবে যুক্তি, বুদ্ধি এবং বিবেকবোধের প্রয়োগের মাধ্যমে এবং আমি দর্শন বিভাগে পড়ছি বলেই তা সম্ভব হচ্ছে। বিভাগের শিক্ষকদের প্রত্যাশাই আমার পরবর্তী জীবনের লক্ষ্য যা পূরণ করা একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর থাকবো ইনশাআল্লাহ। আমার শিক্ষকদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি যে ভীষণ মমতায় তারা আমাদের আপন করে নিয়েছেন তা পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
খাদিজা নাছরিন মিতু : অনার্স ১ম বর্ষ, সেশন : ২০২০-২০২১, চাঁদপুর সরকারি কলেজ, চাঁদপুর।