প্রকাশ : ৩১ মে ২০২২, ০০:০০
মোঃ আনিসুর রহমান ফারদীন। তিনি চাঁদপুর সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের প্রভাষক। ২০১৯ সালে তিনি শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ করেন। তিন বছর পার হয়েছে ইতিমধ্যে। এরই মধ্যে তিনি শিক্ষার্থীদের নিরেট শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার জায়গা দখল করে নিয়েছেন। হয়েছেন সকলের ‘প্রিয় আনিস স্যার’। যা তাঁর মনে প্রশান্তির আবহ রচনা করে। শিক্ষার্থীদের প্রিয় ও পছন্দের শিক্ষক হয়ে উঠাকে তিনি অর্জন মনে করেন।
মোঃ আনিসুর রহমান ফারদীন সম্প্রতি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ‘শিক্ষাঙ্গন’ বিভাগের মুখোমুখি হন। সাক্ষাৎকারটি আজ ছাপা হলো।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কেমন আছেন?
মোঃ আনিসুর রহমান ফারদীন : সব মিলিয়ে ভালো আছি। বলা চলে একজন সুখী মানুষ।
চাঁদপুর কণ্ঠ : শিক্ষকতা পেশায় কিভাবে এলেন?
মোঃ আনিসুর রহমান ফারদীন : ছাত্রজীবনে অনেক টিউশন করিয়েছি। ভার্সিটি অ্যাডমিশন টেস্টের কোচিং, বিভিন্ন একাডেমিক কোচিংয়ের ক্লাস করাতাম। এটা আমার ভালোলাগার কাজগুলোর মধ্যে একটি ছিলো। শিক্ষার্থীদের পড়াতে আমার ভালো লাগতো। আমি বুঝতে পারতাম শিক্ষার্থীদের সাথে যতোক্ষণ থাকি ততোক্ষণ আমি ভালো, সুস্থ এবং প্রাণবন্ত থাকি। তাই ভাবতাম যদি কোনো দিন শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে পারি তাহলে মন্দ হয় না। সেই ভাবনা থেকে বিসিএস পরীক্ষায় বোথ ক্যাডারে অংশগ্রহণ করে এডুকেশন ক্যাডার থেকে সরকারি কলেজের প্রভাষক হিসেবে জয়েন করি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : শিক্ষক হিসেবে প্রথমদিন কেমন কেটেছে?
মোঃ আনিসুর রহমান ফারদীন : প্রফেশনালি শিক্ষক হিসেবে প্রথমদিন আমি যেনো এক অকৃত্রিম প্রশান্তি অনুভব করছিলাম। এটা ছিলো আমার জন্যে এক ধরনের ¯িœগ্ধ অনুভূতি। কলেজ কর্তৃপক্ষ ফুলেল অভ্যর্থনা দিয়েছিলো। যা আমায় মুগ্ধ করেছিলো। প্রথমদিন ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে ইন্সপাইরেশনাল অনেক গল্প করেছি। জীবনের মানে কী, বলার চেষ্টা করেছি। সেই থেকেই মনে হয় শিক্ষার্থীরা একজন শিক্ষক হিসেবে পছন্দ করে। যা আমার জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার স্কুলজীবনের কিছু স্মরণীয় ঘটনা বলুন।
মোঃ আনিসুর রহমান ফারদীন : এক. আমি ক্লাস ফাইভের ছাত্র থাকাকালীন স্যারদের উপর রাগ করে অন্য একটা স্কুলে গিয়ে ভর্তি হই। কারণ ওই সময় দু-একজন স্যারের পক্ষপাতিত্বের কারণে আমি পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার কথা থাকলেও হতে পারিনি। তাই খারাপ লেগেছিলো। আমি চলে যাওয়ার পর আমার কিছু স্যার মনে কষ্ট পেয়েছিলেন। যার জন্যে এখনো অনুতাপে পুড়ি।
দুই. হাইস্কুলে থাকতে আমাদের স্কুলে শহিদ মিনার ছিলো না। আমার মহান ভাষা ও শহিদ দিবস পালনের জন্যে কলাগাছ দিয়ে শহিদ মিনারের আদলে কাগজ মুড়িয়ে শহিদ মিনার বানাতাম। সারা রাত স্কুলের বড়ভাই, বন্ধুদের সাথে জেগে থাকতাম। এলাকার বিভিন্ন বাড়ি থেকে ফুল এনে সকালে ভাষাশহিদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করতাম। অবশ্য দেশের পরিস্থিতি অনেক উন্নত হয়েছে। নতুন করে শহিদ মিনার তৈরি হয়েছে ওই হাইস্কুলে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার প্রিয় শিক্ষক কে? কেনো প্রিয়?
মোঃ আনিসুর রহমান ফারদীন : আমার প্রিয় শিক্ষকদের একজন শাহজাহান কবীর স্যার। তিনি ছিলেন আমার হাইস্কুলের স্যার। স্যার একজন অমায়িক ও বন্ধুবৎসল মানুষ ছিলেন। যে কোনো বিষয় স্যারের সাথে শেয়ার করা যেতো নির্দ্বিধায়। একজন ছাত্রের সমস্যা, সুবিধা ও অসুবিধা স্যার খুব সহজে ধরতে পারতেন। একজন শিক্ষার্থীকে তিনি খুব সহজে পড়ে ফেলতে পারতেন। যা আমাকে মুগ্ধ করতো। ব্যক্তিজীবনে আমিও স্যারের মতো একজন মানুষ হতে চাই।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার বর্তমান (কর্মরত) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কিছু বলুন?
মোঃ আনিসুর রহমান ফারদীন : চাঁদপুর সরকারি কলেজ মেঘনাপাড়ের বাতিঘর হিসেবে সম্যক পরিচিত। নদীবিধৌত এ অঞ্চলের হাজারো শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে এ প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এ কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম, ফলাফল এবং কলেজ ক্যাম্পাসের নান্দনিক সৌন্দর্য একদিন সারাদেশে রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হবে এ প্রত্যাশা।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার বিভাগ নিয়ে আপনি কী স্বপ্ন দেখেন?
মোঃ আনিসুর রহমান ফারদীন : দর্শন বিষয়টি একটু জটিল। আর আমাদের দেশের পেক্ষাপটে অনেকে এ বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা করতে চায় না। এর কারণ হলো চাকুরির সাথে অসামঞ্জস্য। এক্ষেত্রে এপ্লাইড ফিলোসফি নামে একটি কোর্স চালু করতে পারলে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি উপকৃত হবে বলে আশা করি। সাথে নীতিবিদ্যা দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হওয়ায় নীতিবিদ্যাকে সকল ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থীর জন্যে বাধ্যতামূলক করা গেলে সমাজ বাস্তবতায়, সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন সম্ভব হতো। এতে দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল, সর্বোপরি একজন মানবিক নাগরিক তৈরি সহজ হতে পারে। সাথে সত্য, সুন্দর এবং মঙ্গলের মাধ্যমে একটা সুন্দর সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। আর আমি চাই আমাদের শিক্ষার্থীরা এখানে হাতে-কলমে কিছু শিক্ষা পাক। এই যেমন বিভিন্ন বিষয়ের উপর কোর্স চালু। কম্পিউটারে প্রাথমিক হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ। তাছাড়া দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, মানবিক কাজে অংশগ্রহণ করবে এই প্রত্যাশা।
চাঁদপুর কণ্ঠ : শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত?
মোঃ আনিসুর রহমান ফারদীন : আমি মনে করি, একজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যকার সম্পর্ক শ্রদ্ধা ও ¯েœহপূর্ণ হবে। একজন শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীদের প্রতি বন্ধুবৎসল হবে। শিক্ষার্থীরা একজন শিক্ষককে বড় ভাই, বাবা কিংবা অভিভাবক হিসেবে ভাবতে পারবে। শিক্ষককে নির্ভয়ে নিজের যে কোনো সমস্যার কথা খুলে বলতে পারে এমন সম্পর্ক হওয়া উচিত এবং একজন শিক্ষক তাঁর জায়গা থেকে শিক্ষার্থীদের সুবিধা ও অসুবিধা দেখবেন। শিক্ষার্থীদের যে কোনো যৌক্তিক প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াবেন। একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের জন্যে শামসসুজ্জোহা স্যারের মতো হয়ে উঠবেন, যার জন্যে শিক্ষার্থীরা গর্ব করতে পারে। এমন শিক্ষকের সাহচর্য পেলে শিক্ষার্থীরা এতে চলার পথে ভরসা পাবে। সাথে একজন শিক্ষার্থীর মানসিক পরিশুদ্ধি এবং বিকাশের জন্যে কাউন্সিল প্রয়োজন, যা একজন শিক্ষক সহজে করতে পারেন। পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীর উচিত শিক্ষকেক সম্মান ও শ্রদ্ধা করা। শিক্ষকের কথা মেনে চলা এবং নিয়মিত পড়াশোনা ও শৃঙ্খলিত এবং নিয়মানুবর্তী জীবনযাপন করা।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনি সাহিত্য চর্চা করেন। সাহিত্য চর্চার সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন?
মোঃ আনিসুর রহমান ফারদীন : আমি লেখালেখি করি স্কুলজীবন থেকে। তবে পেশাগত জীবনে পদার্পণের পর থেকে ভেবে-চিন্তে লিখছি। আমাদের সমাজ, বাস্তবতা, যাপিত জীবন ইত্যাদি বিষয়গুলো আমায় বরাবরই টানে। তাই একটু-আধটু পড়তে পছন্দ করি। সেখান থেকেই লেখালেখির অগ্রযাত্রাটা একটু বাড়ছে। আর আমি বাস্তবতাকে আমার লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমি মনে করি সাহিত্যজগৎ নিয়ে যাঁরা ভাবেন তাঁরা সমাজ, সভ্যতা, জীবন দর্শনকে আয়না হিসেবে কাজে লাগায়। দর্শনের একজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হিসেবে আমার চিন্তাকে শাণিত করার একটা সুযোগ আমি বরাবরই পেয়েছি এবং পেয়ে আসছি। দর্শনের শিক্ষা ও আমার পেশাগত কর্ম আমায় ভাবতে শিখিয়েছে। দার্শনিকদের জীবন, কর্ম এ কাজে আমায় অনুপ্রাণিত করছে। তাই সাহিত্য চর্চার বিষয়টি আমার ভালো লাগে। তাছাড়া আমার বিভিন্ন শুভাকাক্সক্ষী, শুভানুধ্যায়ী, আমার বন্ধু-বান্ধব এবং সহকর্মীগণ অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দেন, যা লেখালেখির এ পথে আমার চলার পথকে সহজ করছে, সাহস যুগিয়েছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : ভালো ফলাফল ও ভালো মানুষ হতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
মোঃ আনিসুর রহমান ফারদীন : ভালো ফলাফলের জন্যে একজন শিক্ষার্থীকে নিয়মিত পড়াশোনার সাথে যুক্ত থাকতে হবে। অধ্যবসায় নিয়ে, মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করতে হবে। পার্টটাইম পড়াশোনা করে ভালো ফলাফল করা কঠিন। অথবা ভালো ফলাফল হলেও তা সার্টিফিকেট-সর্বস্ব হবে। পার্টটাইম পড়াশোনা করে পেশাগত জীবনে ভালো করার সুযোগ থাকে না।
আর একজন ভালো মানুষ হওয়ার জন্যে একজন শিক্ষার্থীকে তার বিবেকের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। নীতি, নৈতিকতার চর্চা করতে হবে। সত্যকে সত্য, মিথ্যেকে মিথ্যে বলার সৎসাহস অর্জন করতে হবে। বলা হয়ে থাকে ‘বিদ্বানের কলমের কালি, শহিদের রক্তের চেয়ে পবিত্র’। তাই বিদ্বানের কলমের কালি দিয়ে সুন্দর আগামী নির্মাণ করতে হবে। মন থেকে কেউ যদি পড়াশোনা করে এবং অধ্যবসায়, মূল্যবোধ ইত্যাদির চর্চা করে তাহলে সে সত্যকারের মানুষ হয়ে উঠবে। শিক্ষা মানুষকে বিনয়ী হতে শেখায়, তাই যথাযথ শিক্ষা অর্জনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি গৃহস্থালির কাজগুলো হাতে-কলমে শেখা যায়। বর্তমান যুগ ডিজিটাল হওয়ায় কম্পিউটার রিলেটেড কাজ, প্রোগ্রামিংগুলো সম্পর্কে হাতে-কলমে শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত। পাশাপাশি দেশের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো যথাযথভাবে পালন করে একজন সুনাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : অবসর সময় কী করেন?
মোঃ আনিসুর রহমান ফারদীন : অবসর সময়ে লিখালিখি করি। সুযোগ পেলে বই পড়ার চেষ্টা করি। গান শুনি। বাগান করা অন্যতম শখ।