প্রকাশ : ১১ মে ২০২২, ০০:০০
ভূমিকা
ছাত্রজীবন হলো মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জীবনের এই সময়ে আমরা নিজেদের চরিত্রকে ইচ্ছেমতন গড়ে তোলার সুযোগ পাই। মানুষের জীবনের জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়া সমগ্র জীবনব্যাপী চললেও, মানুষ হিসেবে নিজের চরিত্রকে গড়ে তোলার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ জীবনের এই সময়েই হয়ে থাকে। শিক্ষা জীবনের অর্থ শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দির মধ্যে আবদ্ধ শিক্ষা নয়। ছাত্রজীবনের শিক্ষা হওয়া উচিত ব্যাপক ও বিস্তৃত। তবেই শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য সার্থক হয়ে থাকে। ছাত্রজীবনের শিক্ষার এই বহুমুখী চরিত্রের মধ্যে জীবনের প্রতিটি দিকের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি হওয়া আবশ্যক। সেই প্রাথমিক জীবন দর্শন-এর মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর চরিত্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ছাত্রজীবনে শিক্ষামূলক সফরের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
শিক্ষাসফরের তাৎপর্য
একটি শিক্ষাসফর একজন শিক্ষার্থীর সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গণ্ডির বাইরের পৃথিবীর পরিচিতি ঘটায়। এই পরিচিতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সাথে বিশ্বপ্রকৃতির যে সংযোগ গড়ে ওঠে তা তার চরিত্র গঠনে সহায়তা করে। তাছাড়া একজন শিক্ষার্থীর শখ, ভবিষ্যতের পেশা এবং আত্মপ্রতিভামূলক দিকনির্দেশ নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও শিক্ষাসফরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষার্থী একটি যথাযথ শিক্ষাসফরে গিয়ে যা শেখে তা শিক্ষাঙ্গনের পুঁথিতে আবদ্ধ বিদ্যা তাকে শেখাতে পারে না। শিক্ষামূলক সফরে গিয়ে একজন শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, পরিবেশ তথা স্থানীয় মানুষের দৈনিক জীবন সম্পর্কে পরিচিতি লাভ করতে পারে। তাই শিক্ষাসফর থেকে লব্ধ উপলব্ধি একজন শিক্ষার্থীর সমগ্র জীবনে বিশেষ প্রভাব রেখে যেতে সক্ষম হয়।
স্থান নির্বাচন
শিক্ষাসফরের মূখ্য বিষয় হলো স্থান নির্বাচন করা। কারণ উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করা না গেলে শিক্ষাসফরের উদ্দেশ্য সাধন সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশের কথা, প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কথা, নিরাপত্তা, বিশ্রাম, যাতায়াত ব্যবস্থা, সময়কাল ইত্যাদি বিবেচনায় শিক্ষাসফরের স্থান নির্বাচন করা প্রয়োজন। অন্যদিকে স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রাগৈতিহাসিক দিক বিবেচনায় ঐতিহাসিক ও ভূতাত্তিক নিদর্শন সমূহ, ভূ-প্রকৃতির দিক থেকে অনন্য, আবার উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের বিবিধ বৈচিত্রের ব্যাপারেও দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। এছাড়াও জলপথে শিক্ষামূলক ভ্রমণ অনন্য শিক্ষাসফরের অভিজ্ঞতা হতে পারে।
যাত্রাপথ এবং ভ্রমণ পরিকল্পনা
শিক্ষাসফরের জন্যে ভ্রমণ পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্ববহ একটি বিষয়। ভ্রমণ পরিকল্পনায় প্রথমত যেটি প্রয়োজন, সেটি হলো তারিখ নির্ধারণ। দ্বিতীয়ত যাত্রাপথ নির্ধারণ ও যাত্রার মাধ্যম নির্ধারণ। একটি কাক্সিক্ষত ও সফল শিক্ষাসফরের জন্যে নির্ধারিত তারিখে গন্তব্যে পৌঁছাতে কী পরিমাণ সময় লাগবে এবং কখন কোথায় যাওয়া হবে, তা যদি পূর্ব থেকে পরিকল্পনা না করা হয় তবে সে সফর সার্থক হয়ে ওঠে না। সফরটি যদি একাধিক দিনের হয় তবে অবশ্যই তারিখ ও সময়েরর একটি রূপরেখা করে তদানুযায়ী সফর সম্পাদন গুরুত্ববহ সফরে পরিনত হয়। শিক্ষাসফরের ক'দিন পূর্ব থেকে সফরের বিস্তারিত শিক্ষার্থীদের গাইডলাইন দেয়াতেও সফরের সার্থকতা রহিত। এছাড়াও যাবার পথে শিক্ষকরা সমগ্র ভ্রমণ পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে সবাইকে বুঝিয়ে দেয়া সফরের মূখ্য বিষয়ের একটি। একাধিক দিনের সফর হলে অবশ্যই প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড বিষয়ে দিনের শুরুতে এবং দিনের শেষে ঐদিনের দর্শনীয় বিষয়বস্তুর ফিডব্যাক নেয়াই হবে সফল শিক্ষাসফরের সার্থকতা।
ভূপ্রকৃতির, অরণ্যানী, বন্য ও জলজ প্রাণী সম্পর্কে জ্ঞানলাভ
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব-দ্বীপগুলোর একটি। এটি পলিমাটি গঠিত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব-দ্বীপ। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে সামান্য পাহাড়ি অঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাংশের সীমিত উঁচুভূমি ব্যতিত সমগ্র বাংলাদেশ নদী বিধৌত এক বিস্তীর্ণ সমভূমি। পাহাড়, সমভূমি ও নদী অঞ্চল সব মিলিয়ে আমাদের দেশ প্রাকৃতিক চারণভূমির দেশ। এ দেশে রয়েছে বহু প্রত্নতত্বের নিদর্শন ও ম্যানগ্রোভ অঞ্চল। এছাড়া রয়েছে মানুষের তৈরি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভ্রমণ স্পট ও চিড়িয়াখানা। আমাদের ম্যানগ্রোভ একই সাথে অরণ্য, বন্য ও জলজ প্রাণি সম্পর্কে জ্ঞান লাভের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। নৌ শিক্ষাসফরে আনন্দদায়ক ভ্রমণসহ শিক্ষার্থীরা ডলফিন, তিমি, গাংচিলসহ জানা-অজানা নানা প্রজাতির জলজ প্রাণির সন্ধান পেতে পারে। স্থান ও কাল ভেদে ভূপ্রকৃতি বিবেচনায় শিক্ষাসফরের জন্যে প্রতিষ্ঠানের সুবিধামত স্থানে শিক্ষাসফর করাই শ্রেয়। আবার একেক বছর একেক স্থানে সফর করলে শিক্ষার্থীরা ওই স্থানের ভূপ্রকৃতির সকল উপজীব্যে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। ভূপ্রকৃতি জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মেধাকে আরো বেশি বিকশিত করে।
স্থানীয় জীবন-মানের ধারণা
সমগ্র পৃথিবী আধুনিকতার দিকে এগিয়ে গেলেও অঞ্চল কিংবা দেশভেদে নানান প্রজাতির মানুষ এখনও প্রকৃতির ওপর প্রাগৈতিহাসিক নির্ভরশীলতার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা খুঁজে নেয়। বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে উন্নয়নশীল দেশে এগিয়ে চললেও এ দেশের পাহাড়ি ও বন্য অঞ্চলগুলোর নানা প্রজাতির মানুষ এখনো প্রাগৈতিহাসিক নির্ভরশীলতার উপর দিন-যাপন করে চলছে। এছাড়াও আমাদের দেশে অঞ্চলভেদে মানুষের চলাফেরা, কথা-বার্তা, বসবাস, খাদ্যভাস ও জনজীবন নানান প্রকারের। তাই অঞ্চলভেদে একেক সময়ে একেক অঞ্চলে শিক্ষাসফরে শিক্ষার্থীরা সমগ্র দেশের নানা প্রজাতির মানুষের জীবন-মান সম্পর্কে ধারণ অর্জন করতে পারবে। এটি হবে শিক্ষার্থীদের জীবনের সবচেয়ে বেশি সার্থকতার শিক্ষাসফর।
উপসংহার
সফলতার সাথে শিক্ষাসফর শেষ করে নিজ গন্তব্যে ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। শিক্ষাসফরের অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের জীবনে যে কতটা অভূতপূর্ব হয়ে ওঠে তা বলে বোঝাতে হবে। দর্শনীয় স্থানের অপরূপ সৌন্দর্য, শিক্ষাসফরের প্রয়োজনীয় উপকরণ, ব্যাপক জীব বৈচিত্রের শোভা এবং সহপাঠী ও শিক্ষকদের সাথে একসাথে কাটানো দিন শিক্ষার্থীদের মনে অদ্ভুত পূর্ণতায় ভরে ওঠে। জীবন ও প্রকৃতির অপরূপ বন্ধন শিক্ষার্থীদের কাছে উন্মোচিত হয়। শিক্ষকরা ফেরার পথে শিক্ষার্থীদের আশ্বাস দিবেন, পরের বছর একই ধরনের আরেকটি শিক্ষাসফর অন্য কোন স্থানে আয়োজন করা হবে।
এইচএম জাকির : সাবেক শিক্ষার্থী, অনার্স শিক্ষাবর্ষ ২০০৪-২০০৫।