প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
আমরা অনেকেই বিতর্ক নিয়ে কম-বেশি ধারণা রাখি। বিটিভিতে জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক বা এটিএন বাংলার নিয়মিত বিতর্ক আয়োজন ‘ছায়াসংসদ’ অনেকেই হয়তো দেখে থাকি। স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনেকেই সরাসরিভাবে বিতর্কের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। বিতর্ক হচ্ছে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করা। একটি নির্ধারিত বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে নিজের যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে নিজের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করাই বিতর্কের মূল উদ্দেশ্য।
বিতর্ক হচ্ছে যুক্তি-তর্কের খেলা। বিতর্কের মাধ্যমে যুক্তির আয়নার নিজের ভাবনাগুলোকে প্রতিফলিত করা যায়। এর ফলে বাড়ে চিন্তার পরিধি, জ্ঞান আর প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান। একটি বিষয়কে বৃত্তের বাইরে গিয়ে কীভাবে আর কতভাবে ভাবা যায়, তা একজন বিতার্কিকের থেকে ভালো কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু সব ধরনের বিতর্কই কি একই রকম? বিতর্ক মানেই কি শুধু যুক্তিতর্কে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা? সব বিতর্কেই কি দুটি দল থাকে? নাকি তার অধিক দল নিয়েও বিতর্ক করা যায়? এ প্রশ্নগুলোর উত্তরে আজ আমরা জানবো বিতর্কের নানান প্রকারভেদ।
বিতর্ক সাধারণত প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে থাকে। প্রদর্শনী বিতর্কের মাঝে রম্য বিতর্ক, আঞ্চলিক বিতর্ক, প্ল্যানচ্যাট বিতর্ক, জুটি বিতর্ক আর প্রতিযোগিতামূলক বিতর্কের মাঝে সংসদীয় বিতর্ক, সনাতনী বিতর্ক, বারোয়ারি বিতর্ক ইত্যাদি প্রচলিত রয়েছে। এছাড়াও ইংরেজি বিতর্কের ঘরানার মাঝে ব্রিটিশ পার্লামেন্টরি বিতর্ক বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিস ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ বা রাউন্ড রবিনের মতো আন্তর্জাতিক ডিবেট টুর্নামেন্টগুলো মূলত ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি ফরম্যাটেই হয়ে থাকে।
সনাতনী বিতর্ক : বিতর্কের বেশ প্রাচীন এ ফরম্যাটটি বর্তমানে খুব একটি প্রচলিত না থাকলেও বাংলাদেশের জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক বা স্কুল পর্যায়ের বিতর্কগুলো এখনো সনাতনী পদ্ধতিতে করা হয়ে থাকে। বিতর্কের এ ধারায় ব্যাকরণিক জটিলতা অন্য যে কোনো ফরম্যাটের বিতর্ক থেকে যথেষ্ট কম। এখানে একটি নির্ধারিত বিষয়ের উপর পক্ষ দলের ও বিপক্ষ দলের তিনজন বক্তা (১ম বক্তা, ২য় বক্তা ও দলনেতা) পালাক্রমে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সনাতনী বিতর্কে সাধারণত প্রত্যেক বক্তা তার বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যে চার/পাঁচ মিনিট ও গঠনমূলক পর্বের বক্তব্য শেষে উভয় পক্ষের দলনেতারা যুক্তিখণ্ডনের জন্যে অতিরিক্ত দুই/তিন মিনিট করে সময় পেয়ে থাকেন। সনাতনী বিতর্ক পরিচালনার দায়িত্বে যিনি থাকেন তাকে ‘সভাপতি’ বা ‘মডারেটর’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়ে থাকে। বর্তমানে এর প্রচলন কমে গেলেও বিতর্কের হাতেখড়ির জন্যে সনাতনী বিতর্ক যথার্থ।
সংসদীয় বিতর্ক : সংসদীয় বিতর্ক হচ্ছে হালের জনপ্রিয় ডিবেট ফরম্যাট। বর্তমান সময়ে প্রতিযোগিতামূলক বিতর্কের ক্ষেত্রে সংসদীয় বিতর্কের ব্যবহার সর্বাধিক হারে দেখা যায়। তবে সনাতনী বিতর্কের তুলনার এ বিতর্ক ব্যাকরণগতভাবে বেশ জটিল। উভয় পক্ষের বক্তাদের (প্রধানমন্ত্রী/বিরোধীদলীয় নেতা, মন্ত্রী/উপনেতা, সংসদ সদস্য) প্রত্যেকে এখানেও পাঁচ মিনিট করে সময় পান তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যে, কিন্তু এই পাঁচ মিনিট সময়ের মাঝে কৌশলগতভাবে প্রতিপক্ষ দল পয়েন্ট অফ ইনফরমেশন, পয়েন্ট অফ অর্ডার বা পয়েন্ট অফ প্রিভিলেজের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে আঘাত হানার পাশাপাশি নিজেদের জন্যে সুবিধা আদায় করে নিতে পারেন। গঠনমূলক পর্ব শেষে যুক্তিখণ্ডন পর্বে প্রথমে বিরোধীদলীয় নেতা ও সর্বশেষে প্রধানমন্ত্রী তিন মিনিট করে অতিরিক্ত সময় পেয়ে থাকেন। ফরম্যাটের নামই যেহেতু সংসদীয় বিতর্ক, সুতরাং স্বাভাভিকভাবেই পুরো বিতর্কটি যিনি পরিচালনা করবেন তাকে ‘স্পিকার’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি বিতর্ক : এ বিতর্কটি বেশ জটিল ধরনের। মূলত ইংরেজি বিতর্কের ক্ষেত্রে এ ফরম্যাটটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে বিধায় আমাদের দেশে এ ফরম্যাটের সাথে অনেকেই পরিচিত নয়। তবে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি বিতর্কের ক্ষেত্রে নিয়মিত চর্চার পাশাপাশি বর্তমানে এ ফরম্যাটটিকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে ‘বাংলা বিপি বিতর্ক’-এর বেশ প্রচলন দেখা যাচ্ছে।
এ ফরম্যাটটি মূলত ব্রিটেনের সংসদীয় পদ্ধতির অনুসরণে করা। ব্রিটেনের সংসদে যেমন হাউজ অফ লর্ডস আর হাউজ অফ কমন্স নামে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে, একইভাবে বিপি বিতর্কেও উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ আলাদা আলাদাভাবে থাকে। সুতরাং, মোট চারটি দল নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি বিতর্ক হয়ে থাকে। চারটি দল হচ্ছে সরকার দলীয় উচ্চকক্ষ, বিরোধী দলীয় উচ্চকক্ষ, সরকার দলীয় নিম্নকক্ষ ও বিরোধী দলীয় নিম্নকক্ষ। এদেরকে বিতর্কের প্রচলিত ভাষায় OG (Opening Government), OO (Opening Opposition), CG (Closing Government) ও CO (Closing Opposition) বলা হয়ে থাকে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি বিতর্কের ক্ষেত্রে বক্তারা সাধারণত সাত মিনিট করে সময় পান বক্তব্য দেয়ার জন্যে। তবে এ বিতর্কে কোনো ধরনের যুক্তিখণ্ডনের জন্য আলাদা সময় বরাদ্দ থাকে না বিধায় নির্ধারিত সাত মিনিটের মাঝেই বক্তাদেরকে যুক্তিখণ্ডন করতে হয়। পুরো বিতর্কটি একজন স্পিকার পরিচালনা করেন।
ইসমাইল হোসেন সিরাজী : প্রভাষক (ইংরেজি), চেড়িয়ারা স্কুল এন্ড কলেজ।