প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
আমি খুবই ঘুমকাতুরে। কেবল ঘুমকাতুরেই নই। ঘুমালেই স্বপ্ন দেখি। অর্থাৎ স্বপ্নাতুরও বটে। প্রতি রাতেই ঘুমে স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন সত্যি কি মিথ্যা তা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। মাঝে মাঝে মজার স্বপ্ন দেখি আর কখনো ভয়ের। স্বপ্নে এক এক সময় এক এক জায়গায় যাই। কখনো আকাশে মেঘের সাথে উড়ি, কখনো পালতোলা নৌকায় ঘুরি। কখনো ফড়িঙের পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সকালে আর সে সব স্বপ্ন হবহু মনে থাকে না। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সে সব স্বপ্নের কথা বলতে চাইলেও বলতে পারি না। তবে গতকাল যে স্বপ্নটা দেখলাম তা কেন জানি হবহু মনে গেঁথে গেছে। ওই স্বপ্নের এক অক্ষরও আমি ভুলিনি। ভুলতে পারিনি। সারাদিন ধরে কেবল সেই স্বপ্ন আমাকে জাগিয়ে রেখেছে।
আমি ভালো গল্প বলতে পারি না। অনেকেই আছে বেশ রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলে। যা ঘটে তাতে একটু রঙ চড়িয়েই তারা বলতে পছন্দ করে। আমি আবার সিধেসাদা কথা বলি। তাই আমি চেষ্টা করলেও গল্প হয় না। কেন জানি বর্ণনা হয়ে যায়। তবে এই স্বপ্নের কথা কিন্তু গল্প নয়। এমনিতেই বর্ষা ঋতু আমার প্রিয় নয়। বলতে গেলে দুচোখের বিষ। কেবল বৃষ্টি আর বৃষ্টি। খেলার মাঠ কাদা হয়ে যায়। খেলতে যেতে পারি না। ঘরে আটকে থাকতে হয়। আচ্ছা, আমার মতো বাচ্চারা যদি না খেলতে পারে তবে কেমন লাগে? তার উপরে মায়ের বকুনি, অ্যাই, একবার নাকি রাত্রে তারা মা-ছেলেতে ঘুমিয়েছেন। রাত কয়টা বাজে তার খেয়াল নেই। শুধু খেয়াল হলো ঘুমের মধ্যে কী জানি ঠাণ্ড ঠণ্ডাা লাগে। উঠে দেখেন, বৃষ্টির পানিতে ঘর ভেসে গেছে। তারপর সারারাত তারা মায়ে-ছেলেতে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। তার ছেলেটা আমার মতোই বয়সী। মা আমাকে সেদিন স্কুল থেকে আনতে গেলে আয়া আন্টি মাকে দেখে মনের দুঃখ জানিয়েছিলেন। মা তার পরদিন আয়া আন্টির ছেলের জন্যে আমরা বৃষ্টিতে ভিজবে না। ভিজলেই অসুখ হবে। বর্ষা তাই আমার অপছন্দের। আমাদের স্কুলে যে আয়া আন্টি কাজ করে, বর্ষা এলে তাদের বাসায় ফুটো চাল দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়ে। তাই বর্ষা ঋতুতে তিনিও আতঙ্কে থাকেন। দুভায়ের কিছু পুরানো কাপড়-চোপড় দিয়েছিলেন।
যে স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে আমি খেই হারিয়ে ফেললাম এবার তোমাদের সেই স্বপ্নের কথা বলছি। এখন শ্রাবণ মাস। আজ শ্রাবণ মাসের শেষদিন। গতরাতে বৃষ্টি হচ্ছিল বলে আমরা তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুম। আর ঘুম মানেই স্বপ্ন।
জনমানবহীন একটা বলতে বলতেই শোনা গেলো ঠা ঠা ঠা, ঠা ঠা ঠা। গুলির আওয়াজ। নে তালা লাগার যোগাড়। তারপর সব নিস্তব্ধ। সুনসান নিরবতা। আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। কী হচ্ছে এসব! ধীরে ধীরে একটা ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে তত ছায়ামূর্তিটা প্রকাশিত হয়ে উঠছে। একটা বালক। আমার বয়সী। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। ছায়ামূর্তিটা ধু ধু প্রান্তর। অনেকটা মরুভূমির মতো। কোথাও আদি-অন্ত নাই। ভূতুরে অবস্থা। যেন যমপুরী। কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। থেকে থেকে অদ্ভুত এক গোঙানি শোনা যাচ্ছে। কোনটা নারী কণ্ঠের, কোনটা আবার পুরুষ কণ্ঠের । হঠাৎ চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে বন্ধ হয়ে গেল গোঙানি। তারপর কানে এলো একটা ভয়ার্ত কোমল শিশুকণ্ঠ। আমাকে মেরো না, আমাকে মেরো না। আমি কাউকে কিছু বলবো না। আমাকে আমার হাসুবুর কাছে যেতে দাও, আমাকে আমার হাসুবুর কাছে যেতে দাও। শিশুকণ্ঠের আকুতিকে দাবিয়ে বেজে উঠল ভয়ানক দানবীয় হাসি। হা হা হা, হা হা হা। যেন একদল রক্তলোলুপ হায়েনার পৈশাচিক উল্লাস। বাংলা-উর্দু মিশিয়ে হায়েনাদের দলনেতাকে মুখ চিবিয়ে বলতে শোনা যায়, তুম হাসুবু কি পাস্ যানা চাহতা হ্যায়? তো মঞ্জুর। যাও, একেবারেই যাও। অশরীরী কথামালা আমার খুব কাছে চলে এলো। যে শিশুকণ্ঠের আর্তি এতোক্ষণ শোনা যাচ্ছিল তাকে এখন দেখা যাচ্ছে। মনে হোল কোথায় জানি তাকে দেখেছি। আমার খুব আপন মনে হোল। আমারই বয়সের হবে ছেলেটা। মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল তার। ছোট বুক হতে রক্ত ঝরছে। তাজা রক্ত। গল গল করে ঝরছে ছেলেটার কোমল বুক হতে। মুখ তার ব্যথায় কাতর। চোখের নিচে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুধারার গতিপথ আঁকা। আমাকে সে জিজ্ঞেস করলো, কি! আমাকে চিনতে পারছিস্? আমি রাসেল। ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর বাড়িতে থাকতাম। আমি বললাম, অবাক কাণ্ড! তুমিই শেখ রাসেল! আচ্ছা তোমার বুকে রক্ত কেন? রাসেল বললো, ওরা আমার বুকে গুলি মেরেছে। ওরা কারা? রাসেলকে জিজ্ঞেস করলাম। ওরা মানে যারা তোমাদের জাতির জনককে মেরেছে। আমি দ্রুত বলে উঠলাম, ওহ্! তোমার কষ্ট হচ্ছে না? রাসেল বললো, আমাকে মেরেছে তাতে কষ্ট ছিলো না। আমি আমার হাসুবুকে যদি মরার আগে একটু দেখতে পেতাম! জানিস্, আমার হাসুবু আমাকে ঘুড়ি বানিয়ে দিত, পতাকা বানিয়ে দিত। আর আমার মাথার চুলে বিলি কেটে আদর করতো। এই বলে রাসেল একটু দম নিল। দীর্ঘ দম। তারপর আবার বলতে শুরু করে, আচ্ছা তুই কি জানিস্ আমার ভাগ্নে এখন কত্তো বড় হয়েছে? সেই পুঁচকেটাকে নিয়ে আমি কতো খেলতাম! নাদুস-নুদুস ছিল আমার ভাগ্নেটা। আমার খুব আদরের। ওকে কোলে নিয়ে আমি বারান্দায় বারান্দায় ঘুরতাম। আমার আম্মা আমাকে নিতে দিতো না। ভয়ে থাকতো, এই না আমার হাত থেকে তাঁর প্রাণের নাতি পড়ে যায়। অবশ্য কখনো পড়েনি। পুঁচকে ভাগ্নের সাথে আমার কতো মধুর স্মৃতি আছে রে! মুক্তিযুদ্ধের সময় সে ছিল আমার খেলার সাথি। ধীরে ধীরে রাসেল স্মৃতিকাতরতা থেকে বেরিয়ে আসে। তার চোখমুখ এবার স্বাভাবিক হয়ে আসে। আমার দিকে তাকিয়ে সে বলে, আগে কষ্ট হতো। এখন এতো বছর পর আর কষ্ট হয় না। ওরা আমাকে মেরেছে, বাবাকে মেরেছে, মাকে মেরেছে, ভাইয়াকে মেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশকেতো আর মারতে পারেনি। তাই এখন আর কষ্ট হয় না। রাসেল বললো, শোন্, তুই তো আমার বন্ধু, তাই বলছি। আমি কিন্তু জেগে আছি বিচারের আশায়। তোরা যদি আমার খুনীদের সবার বিচার না করতে পারিস্ তাহলে আমার শান্তি নেই। ওরা আমাকে, আমাদেরকে মেরে আমার বাংলাদেশকে মারতে চেয়েছিল। ওরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সাথে পারেনি। তাই পঁচাত্তরে ওরা সপরিবারে আমাদের মেরে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে। আমি রাসেলের কথা শুনে থমকে গেলাম। বলে কী! ওই সব ঘাতকেরা এতো খারাপ! তারা শিশুকেও রেহাই দেয়নি!
আমার সাথে কথা যতক্ষণ বলছিলো ততোক্ষণ রাসেলের ছোট্ট বুক রক্তের নদী হয়ে উঠছিলো। আমি আর কষ্টে থাকতে না পেরে আমার জামা খুলে তার বুকে বেঁধে দিলাম। কিছুক্ষণ পরে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে গেলো। রাসেল এবার স্বাভাবিক হয়ে আসলো। বললো, চল্, তোকে আমার পায়রাগুলো দেখাই। বললাম, তুমি কি পায়রা পুষতে? হ্যাঁ, পুষতাম। এই বলে রাসেল আমাকে হাতে ধরে তার বাসায় নিয়ে গেল। আমি কখনো আগে এখানে আসিনি। ধানম-ি বত্রিশ নম্বর। কত যে এ বাড়ির কথা শুনেছি! এই বাড়িটা ইতিহাস। এ বাড়ি বাঙালির স্বপ্ন দেখার বাড়ি। এ বাড়ি সংগ্রামের বাড়ি। রাসেল দোতলা বেয়ে ছাদে উঠে গেল। আমিও উঠলাম। আয় আয়। আয় আয়। এভাবেই ডাক পাড়ল রাসেল। আমি ভেবেছিলাম আমাকেই ডাকছে। ওমা! কিছুক্ষণ পর দেখি একঝাঁক সাদা পায়রা। কিন্তু এক ঝলক দেখেই মন খারাপ হয়ে গেল। তাদের বুকেও রক্তের দাগ। তাদের সাদা রঙের বুকে রক্ত যেন বাংলাদেশের পতাকার লাল গোলক হয়ে আছে। রাসেল তাদের দানা খাওয়াচ্ছে। গমের দানা, চালের দানা। ওরা শস্যদানাগুলো টুক টুক করে খেয়ে নিচ্ছে। আশ্চর্য! তারা আমাকে একটুও ভয় পাচ্ছে না।
আচ্ছা রাসেল, তোমার পায়রাগুলোর গায়ে রক্ত কেন? রাসেল বললো, আমার বুকের রক্ত ছিটকে তাদের বুকে লেগেছিল। তারা আজও সেই রক্তচিহ্ন বহন করে চলেছে। আমি একটা ইশশ্ শব্দ করে বললাম, শান্তির শ্বেত কপোতকে ওরা রক্তে লাল করে দিলো কেন? রাসেল বললো, ওরা তো চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক, চায়নি বাংলাদেশের পতাকা হোক। তাই এ বাড়ির ওপর, এ বাড়ির প্রতিটি সদস্যের ওপর ওদের আক্রোশ ছিল। এমনকি সেই আক্রোশ থেকে রেহাই পায়নি পোষা সাদা পায়রারাও। রাসেলের পায়রা দেখা শেষ হলে আমরা নেমে আসলাম নিচতলায়। নিচতলায় নামার পথে দোতলার সিঁড়িতে রক্তের দাগ চোখে পড়লো। রাসেল আমাকে থমকে দাঁড়াতে দেখে বললো, ভয় পাস্ না। এটা আমার বাবার বুকের রক্ত। ঘাতকের গুলিতে বাবা এই সিঁড়িতে পড়ে যান। এ রক্ত তারই স্মৃতিচিহ্ন। কালের কপালে একটুকু কলঙ্ক তিলক। রাসেল অনেক ভালো বাংলা বলতে পারে। আমি অতো ভালো পারি না। মাঝে মাঝে তার কথাগুলো দার্শনিকের মতো মনে হয়। তাকে বললাম, রাসেল, তুমি বড় হলে কী হতে চাইতে? রাসেল হেসে দিলো। আমার তো আর বড় হওয়ার সুযোগ নেইরে বন্ধু! ইতিহাস আমাকে এই বয়সেই স্থির করে রেখে দিয়েছে। আমি আর কারো কাছেই বড় হবো না। সবাই আমাকে এই ছোট্টটিই ভেবে নিয়ে কথা বলবে সব সময়। মৃত্যু আমাকে বড় হতে দিবে না কোনদিন। তারপরও তুই যখন প্রশ্নটা করলি তখন তো তোকে উত্তরটা দিতেই হয়। তুই কি জানিস্ আমার নাম কেন রাসেল? আমি বললাম, এ তো সোজা কথা। তোমার বাবা তোমার নাম রেখেছে, তাই তোমার নাম রাসেল। রাসেল হেসে বললো, নাম তো বাবাই রাখে রে বোকা। কিন্তু আমার বাবার পছন্দের এক দার্শনিক ছিলো বার্ট্রা- রাসেল। অনেক অনেক বড় দার্শনিক। বাবা চাইতেন, আমি যেন তাঁর মতো বড় দার্শনিক হই। তাই আমার নাম রেখেছিলেন রাসেল। আমি বেঁচে থাকলে একজন মহান দার্শনিক হতে চাইতাম। আমি অবাক হয়ে বললাম, আচ্ছা রাসেল, দার্শনিকের কাজ কী? রাসেল বললো, হাসুবু একদিন বলেছিলো, দার্শনিক হচ্ছে যারা ভালো ভালো চিন্তা করে।গভীর চিন্তা। যারা বিভিন্ন পথ বাৎলে দেয় জীবনের। যারা সমাজ ও দেশের উন্নয়নে তাদের মহান চিন্তার ফসল দিয়ে অবদান রাখে। আমি বললাম, বুঝেছি। আহা! তুমি বেঁচে থাকলে আমরা সে রকম একটা দার্শনিক পেতাম। তাহলে আজ আমাদের আর সুচিন্তার অভাব হতো না। আমার কথা শুনে রাসেল বললো, আরে ধূর! আমি না, আমার আব্বায় বেঁচে থাকলে আমরা এখন জাপানের সাথে টক্কর দিতে পারতাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, বন্ধু টক্কর মানে কী? রাসেল হেসে দিল। বুঝছি। তুই তো ইংরেজি মিডিয়ামে পড়স্। তাই সব বাংলা শব্দের মানে বুঝতে কষ্ট হয়। টক্কর মানে হলো পাল্লা দেওয়া, প্রতিযোগিতা করা। আমি মাথা নুইয়ে থাকি রাসেলের এ কথায়।
রাসেলের সাথে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি হলো। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। এদিকে রাসেলও বলে উঠলো, যাইরে, আমার আবার হাসুবুর কাছে যেতে হবে। আজ তো পনর আগস্ট। আজ হাসুবুর মনে আমার সারাদিন সারাবেলা কাটবে। আজ হাসুবুর কষ্টগুলো সব আমার জন্যে গলে গলে অশ্রু হয়ে পড়বে রে। আমি গেলাম। এই বলে রাসেল কোথা দিয়ে যে গায়েব হয়ে গেলো বুঝলাম না। শুধু চোখ মেলে বুঝলাম, পর্দার ফাঁক দিয়ে ভোরের রোদ ঢুকে গেছে ঘরে। বাইরে মাইকে বাজছে শোকের গান, ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেতো...’।