প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
আফসানার বয়স যখন ছয় বছর, তখন বড় একটা দূর্ঘটনায় তার মা মারা যান। খুব ছোট বেলায় মাকে হারিয়ে আফসানার ভাগ্যে জোটেনি মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা। এই জন্য তার মা মারা যাওয়ার পর থেকে মায়ের জন্য সে সারাদিন মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকত। খেলার সাথীরা ডাকতে আসলে তাদেরকে সে ফিরিয়ে দিত। মাঝে মধ্যে বাবাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের জন্য হাউমাউ করে কাঁদত। ব্যথা ভরা মন নিয়ে তার বাবাকে বলত, ও বাবা, আমার মাকে এনে দাও না। মাকে যে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। মা আমাকে রেখে কোথায় চলে গেছে? মা কি আর কোনদিন আমার কাছে ফিরে আসবে না? আমার খেলার সাথীদের তো সবারই মা আছে। কত আদর, যত্ন করে তাদের মা। আমার মা কি আমাকে আর কোনদিন ভালোবাসবে না? আমাকে আদর করে ভাত খাওয়াবে না। মাথায় হাত বুলিয়ে রাতে ঘুম পাড়াবে না।
মা মরা মেয়েটির আকুতি মিনতি দেখে সেদিন আফসানাকে ভুলিয়ে রাখতে, তার বাবা হাসেম আলী রাতের আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘ঐ যে দেখছো মা, রাতের আকাশে অনেক তারকারাজি জ্বলছে, ঐ তারকারাজির মাঝে তোমার মা লুকিয়ে আছে। নিশ্চয়ই একদিন তোমার মা তোমার কাছে ফিরে আসবে। তুমি এখন কান্না থামাও।’ বাবার মুখে মা ফিরে আসার কথা শুনে পরের দিন থেকে আফসানা আকাশের তারকারাজির দিকে তাকিয়ে থাকত। মনে মনে ভাবত বাবার কথা মত নিশ্চয় মা একদিন ফিরে আসবে। কিন্তু দিন যায়, মাস যায় আফসানার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না। তার জনম দুঃখিনী মা আর কোনদিন ফিরে আসে না।
এভাবে মা মরা মেয়েটির দুঃখ কষ্ট দেখে সহ্য করতে পারলেন না হাসেম আলী। এই জন্য তিনি মা মরা মেয়েটির মায়ের স্নেহ, ভালবাসার অভাব পূরণের জন্য আরেকটা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিছুদিন পর তিনি সিদ্ধান্ত মোতাবেক এক সন্তানের জননীর সাথে বিয়ে করলেন এবং আফসানকে দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে রেখে জীবিকার তাগিদে হাসেম আলী শহরে চলে গেলন। শহরে চলে যাওয়ার সময় তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীকে বলে গেলেন, মা মরা মেয়েকে স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে আগলিয়ে রাখতে। কোনদিন তার সাথে দুর্ব্যবহার না করতে।
কিন্তু মায়ের স্নেহ ভালোবাসা তো দূরের কথা বাবার অবর্তমানে আফসানার জীবনে নেমে আসে দুর্দশা। তার সৎমা ছিল খুব জেদি। তিনি আফসানাকে মোটেও পছন্দ করতেন না। উগ্র মেজাজে দেখিয়ে সবসময় তিনি আফসানাকে মারধর করতেন। এমনকি ঠিকমত খাবারও খেতে দিতেন না। মা মরা মেয়েটির দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিতেন। রান্নার কাজে ভুলটুটি হলে, সেদিন তাকে আর রেহাই দিতেন না। শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি সারাদিন রান্না ঘরে বন্দি করে রাখতেন। কার সাথে ঠিক মত খেলাধুলা করতে দিতেন না। এমনকি তার বাবার কাছে ফোন করার সুযোগ পর্যন্তও দিতেন না।
এভাবে দিনের পর দিন দাসদাসীদের মতো মুখ বুজে অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হত আফসানাকে। সৎমায়ের ভয়ে নিরবে-নিভৃতে কাঁদতে হত রান্না ঘরে বসে। দিনরাত অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকতে হত বাবা ফিরে আসার জন্য।
অতঃপর, একদিন হাসেম আলী মা মরা মেয়েটির মায়ায় শহর থেকে বাড়ি ফিরে আসলেন। বাড়ি ফিরে প্রথমে তিনি আফসানার নাম ধরে ডাকতে থাকেন। আফসানা মা কোথায় গেলি, এদিকে আয় দেখ কে বাড়ি ফিরে এসেছে। আফসান তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বাহির হয়ে দেখে, তার বাবা বাড়ি ফিরে এসেছেন। সে দৌড়ে গিয়ে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
সেই মুহূর্তে হাসেম আলী আফসানাকে কাঁদতে দেখে বলছেন, কাঁদছি কেন মা? কি হয়েছে তোর? তোর জন্য তো আমি শহর থেকে অনেক কিছু কেনাকাটা করে এনেছি। কেনাকাটার কথা শুনার পরও আফসানার কান্না থামে না। মা মরা মেয়েটির কান্না দেখে তখন হাসেম আলীর বুঝতে আর বাকি রইল না। তিনি তখন আফসানাকে বলছেন, ‘আফসানা মা, নিশ্চয় তোর সৎমা তোর সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। এই জন্যই তুই আমাকে জড়িয়ে ধরে এত কাঁদছি। তোর সৎমা, তোর মায়ের অভাব পূরণ করতে পারেনি। সেই জন্য তোর মায়ের স্মৃতি যেন তুই এখনও ভুলতে পারছিসনে। মাকে হারিয়ে তুই একদম মনে ভেঙে পড়েছিস। অনেক দিন পর আমাকে কাছে পেয়ে তুই আনন্দ-উল্লাস কোনকিছুই করছিসনে।’