প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
আমাদের ছোট একটা পরিবার। এই পরিবার জুড়েই রয়েছে আমাদের বন্ধুত্ব- আত্মবিশ্বাস আর ভালোবাসা। ভালোবাসার শুরুটা হয়েছিলো ২০১৫ সালের ২৯ এপ্রিল। সেই থেকে শুরু হওয়ার এই বন্ধুতের বন্ধন আজো এক মধুমায়া'য় জড়িয়ে আছে। আখড়ে ধরে রয়েছে হাজারো স্মৃতির- শত বন্ধন।
বেশ কিছু দিন ধরেই আমাদের পরিবারে মধ্যে কথা চলছিলো মিনি পিকনিক আয়োজন করবার। কিন্তু কোথায় যাবে- কেমন হবে? কি কি আয়োজন থাকবে এবারের পিকনিকে। সেটা নিয়েই চলছিলো নানা রকমের কথা আর পরিকল্পনা। অবশেষে সবার সিদ্ধান্ত হলো গোবিন্দপুর আনন্দ পালের পুরনো জমিদার বাড়ির কথা।
প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো এই জমিদার বাড়ি। অসম্ভব সুন্দর সব কারুকাজে গড়া এই জমিদার বাড়িটি। রয়েছে পুরনো দিনের সেই বাসন্তী মন্দির। একসময় এখানে নাকি পুজোকে কেন্দ্র করে জমজমাট মেলা বসতো, হাজার হাজার লোকজনের সমাগমে মিলিতো হয়ে উঠতো বাসন্তী পুজার আয়োজন।
তবে মন্দিরটি এখন কিছুটা ঝিনঝরা হয়ে পরলেও সেই মন্দিরে নিয়মিত পুজা করেন স্থানীয় লোকজনরা। এর কিছুটা পথে এগিয়ে চলতেই দেখা যায় আরো একটি জমিদার বাড়ি। তবে এই দু'টি জমিদার বাড়ি সম্পর্কে ফরিদগঞ্জের অনেকেরি হয়তো হয়ে আছে অজানা। ফরিদগঞ্জের ইতিহাস- ঐতিহ্য শিল্প ও সংস্কৃতি নিয়ে লেখা বই ‘আমাদের ফরিদগঞ্জ : ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ বইটিতেও উল্লেখ নেই এখানকার এই দুটি জমিদার বাড়ির কথা।
শুরুতেই নৃত্যবিদ্যা পরিবারের সদস্যরা গোবিন্দপুর বাজার থেকে প্রায় ৩ কিলো পথ গ্রামের ভিতর দিয়ে রওনা হলো তাদের পিকনিকের নির্ধারিত স্থান সুনীল মাষ্টারের জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। সাথে ওই গ্রামের কয়েকজন বন্ধুও ছিলো আমাদের সাথে। পুরনো এই বাড়িটি দেখার আগ্রহ ছিলো অনেক আগে থেকেই আমাদের মনে। অটোরিকশা থেকে নেমে গ্রামের আঁকাবাঁকা পথে হেঁটে এগিয়ে চলতেই চোখে পড়লো বিশাল এক- ‘বটবৃক্ষ’।
অনেকের ধারণা এই বটবৃক্ষটি নাকি প্রায় ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে দাড়িয়ে আছে। এখনকার স্থানীয় একজন বৃদ্ধ লোক সাথে কথা বললে তিনি আমাদের জানান তিনি ছোটবেলা থেকে এই বটবৃক্ষ'টি যেমন দেখে ছিলেন আজো নাকি তেমনিই রয়েছে। এই বটবৃক্ষটির কথাটি না কি তিনি তার নানার কাছে থেকেও কয়েকবার শুনেছেন।
আমরা নৃত্যবিদ্যা পরিবার কিছুসময় ওখানে ঘুরেফিরে এগিয়ে চলতে থাকি পুরনো জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়িতে ডুকতেই জমিদার বাড়ির প্রধান যে গেইট রয়েছে তার একপাশে ভীম আর অন্য পাশে অজুনের প্রতিচ্ছবি আঁকা প্রায় ২০ ফুট উচু দুটি রক্ষনপিলারে ইটমাটি খশেপড়ে ঝিনঝরা অবস্থায় রয়ে গেছে 'কালের সাক্ষী' হয়ে। মুলতো- মহাভারতের পঞ্চপান্ডবদের দু'পান্ডব হচ্ছেন ভীম ও অজুন। ভীমকে- শক্তির প্রতিক আর অজুনকে- শান্তি, জ্ঞান ও বুদ্ধি'র প্রতিক হিসেবে বুজানো হয়েছে। তবে এই দুটি পিলারে সামনে প্রহরীরা অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আজ অযত্ন আর অবহেলায় পরে থেকে এভাবেই বিলুপ্তির পথে জমিদারদের পুরনো ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি।
আমরা বেশ কিছুখন ধরেই জমিদার আনন্দ পালের পুরনো বাড়িটি ঘুরে দেখতে শুরু করলাম, স্থানীয় লোকজনদের সাথে আমাদের খুব সহজেই ভালো বন্ধুতো হয়ে উঠলো অল্পকিছু সময়ের মধ্যে। তাদের সঙ্গে একরকমের কথার আড্ডায় মেতে উঠলাম। ওনারা আমাদের কয়েকজনকে ডেকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলো। পান, সুপারি দিয়ে আপায়ন করলো, খাবার খেতেও বললো।
ওখানকার মানুষ গুলোর মন এতো সুন্দর আর সহজ-সরল তা না দেখলে হয়তো বা কখনোই বুজতে পারতাম না। আমরা নৃত্যবিদ্যা পরিবার এবার সবাইকে নিয়ে ছবি তোলতে শুরু করলাম। ছবি তোলা শেষ করেই সবাই মিলে নাচ গানের আড্ডায় মেতে উঠলাম। কারো কারো তো ঘুরে দেখবার কিংবা ছবি তোলাও রেস এখনো কেটেই উঠেনি।
দুপুর ঘনাতেই পরিবারে সবাই মিলে খাবারে পস্তুতি নিলাম। আমরা কয়েকজন মিলে জমিদার বাড়ির ছোট দিঘিতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। খাবারের পর্ব শেষ করে কিছুখন এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে এবার সবাই মিলে পাশের জমিদার বাড়ি উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। যা বতমানে সুনীল মাষ্টারের বাড়ি বলে সবার কাছে খুব পরিচিত।
সেখানকার অনুভূতি গুলো ছিলো খুবই অন্যরকম। মনের মাঝে ছিলো পরস্পর- পরস্পরের প্রতি প্রকাশ না পাওয়া প্রেম! সবার চোখে ছিলো সুন্দয্যের অনুভূতি। প্রকৃতি আর সুন্দয্যের সাথে ছিলো আমাদের প্রাণখোলা হাসিখুশি আর ভালোবাসা। এখানকার জমিদার বাড়িটাও অনেক সুন্দয্যে ভরা। তবে আনন্দ পালের বাড়ির চেয়েও এই বাড়িটি এখানো অনেক মজবুদ। দু'তালা ভবন জুড়ে শিল্পের কারুকাজ। আর শান্তির প্রতীক হয় দাড়িয়ে আছে এই জমিদার বাড়ির স্মৃতিগুলো। এখানেও স্থাপিত হয়ে আছে ছোট সুন্দর একটি লোকনাথ মন্দির।
নৃত্যবিদ্যা পরিবারের সবাইকে নিয়ে অনেকটা সময় এখানে কাটানোর অনুভূতিগুলো ছিলো ভালোবাসায় সম্পন্ন। এই পরিবার শতবাধা পেরিয়ে এক অটুট বন্ধনে জড়িয়ে আছে বন্ধুতো- আত্মবিশ্বাস আর ভালোবাসা নিয়ে। বিকেলে নৃত্যের ছন্দে ভ্রমণের আনন্দ কিছুটা মিঠটে থাকে। বিকাল ঘনিয়ে সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয় এক আনন্দঘন মুহূর্ত। হঠাৎ করেই আলোর প্রদীপ! খুব তারাহুরো করে কি সব যেন কথা চলছে। হুট করেই নৃত্যবিদ্যার নৃত্যশিল্পী পিপল দাসকে আলাদা ভাবে ডেকে বিভিন্ন কথা বলতে বলতে জমিদার বাড়ির দরজার সামনের নিয়ে দার করাতেই ছোটরা ইস্পে মারতে শুরু করলো।
পিপল অনেকটাই চমকে গেলো! ঠিক তখনি চোখের সামনে পরিবারে কয়েকজনকে কেক নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে বুজতে বাকি রইলো না আজ তার জন্মদিন। মনে পরে গেলো তার আজকের দিনটির কথা।
অনেকটা চমকে গিয়েও আনন্দের অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছিলো তার মনে। বিশেষ এই আয়োজনের পরিকল্পনায় ছিলো নৃত্যবিদ্যা অন্যতম দুই নৃত্যশিল্পী রত্মা রানী দাস ও পূনিমা দাস পূণ্যি। সবশেষে পিপলের জন্মদিন মধ্যে দিয়েই সমাপ্তি ঘটলো নৃত্যবিদ্যা পরিবারের 'মিনি পিকনিক' আয়োজন। জমিদার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে ফিরতে হলো নিজ গন্তব্যে।