প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
অয়নের জাদু খুব পছন্দ। জাদু অবশ্য বড়দেরও পছন্দের। জাদু যে দেখায় তার কথাতেও যেন জাদু থাকে। জুয়েল আইচের যাদু একবার টিভিতে দেখছিল অয়ন। ওহ! কী দুর্ধর্ষ জাদু। কেমন করে একটা আস্ত মানুষকে যে জাদুকরেরা হাওয়ায় মিলিয়ে দিতে পারে তা এক বিশাল রহস্য। আবার শার্টের হাতা থেকে কেমনে জানি আগুন ধরায়। জুয়েল আইচের সবচেয়ে কঠিন জাদু হলো একটা জীবন্ত মানুষকে ইলেকট্রিক করাত দিয়ে তিনখণ্ড করে ফেলা এবং আবার জোড়া লাগানো। উফ্! কী যে শ্বাসরুদ্ধকর সে জাদু! মূলত জুয়েল আইচের জাদু দেখেই অয়নের খুব ম্যাজিক শেখার শখ। অয়নের বাবারও ম্যাজিকের প্রতি আগ্রহ আছে। ভার্সিটিতে পড়াকালীন তারও ম্যাজিক চর্চা করার ইতিহাস আছে। অনেক বইপত্তর কিনেছিলো অয়নের বাবা। কিন্তু কর্মজীবনের চাপে পড়ে তার ম্যাজিকের নেশা গেছে টুটে। অয়নের বাবা বলেন, ম্যাজিক হলো হাত সাফাইয়ের কাজ। মিষ্টি মিষ্টি কথায় মানুষের মনোযোগকে নিজের দিকে টেনে এনে তলে তলে আসল কাজ সেরে ফেলা। কোন কোন ম্যাজিশিয়ান চোখের ব্যায়াম করে হিপনোটাইজিং পাওয়ার বা সম্মোহনী শক্তি পায়। দর্শকের চোখের দিকে ঠায় তাকিয়ে থেকে তাকে সম্মোহিত করে ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখিয়ে যায়। ম্যাজিক দেখাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। অনেক খরচও লাগে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কিনতে। সব যন্ত্রপাতি তৈরি কিনতে পাওয়া যায় না। অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিতে হয়। ফলে খরচ পড়ে যায় অনেক। হাজার হাজার মানুষের নির্মল বিনোদনের পেছনে অনেক টাকার লগ্নী থাকে। তাই ইচ্ছে থাকলেও সবার পক্ষে ম্যাজিক দেখানো সম্ভব হয় না।
অয়নের বাবার কলেজ জীবনের এক বন্ধু আছে যিনি এখন প্রতিষ্ঠিত ম্যাজিশিয়ান। দীর্ঘদিন ধরে তিনি প্রবাসে জীবন-যাপন করছেন। কানাডার মতো শীতপ্রধান দেশে তিনি যে কী মজা পেয়েছেন তা ভাববার বিষয়। মানুষ বলার সময় বলে, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি। কিন্তু সবাই নিজের বেলায় বেছে নেয় ভিন্ন কিছু। অয়নের বাবার বন্ধুও নিজের বেলায় প্রবাসের উন্নত জীবনকে বেছে নিয়েছেন। অয়নের ম্যাজিক শেখার আগ্রহ দেখে অয়নের বাবা তার বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করলেন। তার বন্ধুর নাম রাজীব। পুরো নাম রাজীব রায়হান। সবাই তাকে ম্যাজিশিয়ান রাজ বলেই চিনে। ফোনে অয়নের বাবার সাথে তার বন্ধু ম্যাজিশিয়ানের একবার যোগাযোগ হয়েছে এর মধ্যে। ডিসেম্বরে তিনি আসবেন দেশে। তখন অয়ন ও তার বন্ধুদের তিনি জাদু শেখাবেন। বাবার মুখে এ কথা শুনে অয়ন ও তার বন্ধুরা খুশিতে ডগমগ করে উঠল। তারা কেবল দিন গুণতে থাকে। কখন ডিসেম্বর আসে। ক্যালেন্ডারের একটা দিন যায় তো তারা একটা দিন কাটে। এভাবে যেতে যেতে এক সময় পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। ছুটি শুরু হলো।
কিন্তু ছুটি শুরু হলে কী হবে, ম্যাজিশিয়ান রাজ-এর কোন খবর নাই। অয়নের বাবা ফোন দিয়েছিলেন। কিন্তু তার ফোন কেবল বেজেই চলেছে অথচ কেউ ধরে না। সবার একটু মন খারাপ হতে শুরু হলো। অতি আশা আসলে কাকের বাসা। মন খারাপের এই দিনগুলো উড়িয়ে দিয়ে একদিন হঠাৎ ম্যাজিশিয়ান রাজীব রায়হান এসে হাজির। অয়নদের বাসা হয়ে গেছে যেন হঠাৎ করেই এক উৎসব নগরী। তারা ঘনিষ্ট তিনজন বন্ধু মিলে শুরু করলো ম্যাজিকের ক্লাস। তবে রাজীব আঙ্কেল কিন্তু একদিনই ক্লাস নেবেন। তার নাকি কী কাজ আছে। তাই তিনি এখান থেকে আবার চীনে যাবেন। জাদুকরের একটু বর্ণনা দিতেই হয়। তার চেহারাটা খুব ফর্সা। এত বেশি ফর্সা যেন রক্ত নেই। মাথায় একটা বড়সড় হ্যাট। নাকের নিচে শুঁয়ো পোকার মত ঘন কালো গোঁফ। তার সাথে আছে একটা ঢাউস ব্যাগ আর একটা ট্রলি। তিনি তার ব্যাগ খুলে ধীরে ধীরে সব অ্যাপারেটাস নামাতে লাগলেন। দুইবাক্স তাস, একটা বাঁশি, একটা ধারাল ছুরি, একটা কাঁচের খালি গ্লাস ইত্যাদি আরও কত কী! তার কথাতে মনে হচ্ছে চন্দ্রবিন্দুটা বেশি আসে। মাঝে মাঝে ইংরেজিও বলেন তিনি। প্রথমে পরিচয়ের পালা তিনি সেরে নিলেন। তারপর কেন আমরা ম্যাজিক শিখতে চাই সে কথা জিজ্ঞেস করলেন। আমাদের ম্যাজিক শেখার আগ্রহ দেখে তিনি বেশ খুশি হলেন। তিনি এবার তার লেকচার শুরু করলেন। বললেন, দেখো মাই সানস্, ম্যাজিকের উদ্দেশ্য কিন্তু মানুষকে নির্মল আনন্দ দেয়া। একটা মানুষ যখন তোমার দেখানো ম্যাজিক-এর কারণে বিমল আনন্দ লাভ করে তখন সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং খুশি হন। কারণ মানুষকে আনন্দ দিতে পারা একটি মহাপুণ্যের কাজ। কারও বিরুদ্ধে কোন চক্রান্তের জন্যে ম্যাজিককে ব্যবহার করা যাবে না। যদিও ম্যাজিক হলো মানুষকে ঠকিয়ে আনন্দ দেওয়া। তবুও এই ঠকানোর মধ্যেও সততা আছে, অমলিনতা আছে। এই বলে তিনি ম্যাজিক শেখানোর কাজ শুরু করলেন।
প্রথমেই বললেন, তোমরা অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছো শুকনো মুখে তাই না? চলো তাহলে আমরা কিছু খাই। সবাই খেতে পারি কী? চানাচুর! নিশ্চয়ই সবাই চানাচুর পছন্দ করো। তাই না? দেখো আমার হাতে একটা গ্লাস। গ্লাসটা কাঁচের। এই কাঁচের গ্লাসভর্তি বালি। এই বালি ভর্তি গ্লাস যদি কাঁচের গ্লাস ভর্তি চানাচুর হয়ে যায় তাহলে কেমন হয়? ভালো। তাইনা? রাজীব আঙ্কেলের কথা শুনে সবাই হাতে তালি দিয়ে উঠলো। একটা টি টেবলে বালিভর্তি একটা কাচের গ্লাসকে নিয়ে একটা কালো পর্দা দিয়ে ঢেকে দিলো ম্যাজিশিয়ান। তারপর মন্ত্র পড়ার ভাণ করে হাতের ইশারা করলো কিছুক্ষণ। তারপর সবার চোখের দিকে চেয়ে রইলো। অয়নরা সবাই অধীর আগ্রহে জাদুর কৌশল ধরতে ব্যস্ত রইলো। কিন্তু কোন সুরাহা করতে পারলো না। খুব দ্রুত ম্যাজিশিয়ান এবার কালো কাপড়টা উঠিয়েই ডান হাতে টেবিলের দিকে নির্দেশ করলো। কী অদ্ভুত! নিমিষেই এক গ্লাস বালি এক গ্লাস চানাচুর হয়ে গেলো। সবার চোখ ছানাবড়া হলেও অয়নের বাবার মুখে ঝরছিল মুচকি হাসি। অয়নরা চানাচুর খেতে চাইলো। কিন্তু ম্যাজিশিয়ান আঙ্কেল বললেন, ওয়েট। এক মিনিট। এর মধ্যেই আবার তিনি কালো পর্দা দিয়ে ঢেকে দিলেন গ্লাসভর্তি চানাচুরকে। আবার মন্ত্র পড়ার ভঙ্গি করে কিছুক্ষণ এক ঝটকায় কালো পর্দাটা সরিয়ে নিলো। অমনি এক গ্লাসভর্তি চানাচুর আবারো এক গ্লাসভর্তি বালি হয়ে গেলো। ম্যাজিকটা দেখে মনে হলো খুব সহজ। এবার ব্যাখ্যার পালা।
ম্যাজিশিয়ান রাজ কাচের গ্লাসটা দেখালেন ঘুরিয়ে। ওম্মা! দেখা গেল কাচের গ্লাসের অর্ধেকটা বালি আর অর্ধেকটা চানাচুর লম্বালম্বিভাবে টায়টায় ভরা। এমনভাবে ভরানো যেন সামনে থেকে শুধু এক রকমের জিনিসই দেখা যায়। কালো পর্দাটাতে একটা গ্লাসের ঢাকনার আদলে হার্ডবোর্ড সেলাই করে লাগানো আছে যাতে ওই হার্ডবোর্ডে হাত দিয়ে ধরে বোকা বানিয়ে তলে তলে গ্লাসটা ঘুরিয়ে দেয়া যায়। সমগ্র কাজটা এতো দ্রুত করতে হয় যাতে মানুষের কিছু সন্দেহ না হয়। এভাবে বোকা বানিয়ে চানাচুরের জাদুটা দেখানো হয়। অয়ন ও তার বন্ধুরা এই চালাকি ধরতে পেরে ম্যাজিকের ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেললো।
রাজ আঙ্কেল আবার আরেকটা জাদু শেখানোর আয়োজন করতে শুরু করলো। এবার তিনি কাগজের চ্যাপ্টা ফিতা দশটা নিয়ে পাঁচটা পাঁচটা করে নিয়ে দুটো রিং বানালেন। একটার মাথার সাথে একটার লেজ গ্লু দিয়ে লাগিয়ে বড় বড় দুটো রিং লাগানো হলো। এবার দুটো রিংয়েরই মাঝ বরাবর লম্বালম্বি ছিঁড়তে শুরু করলেন। প্রথমে একটা রিং ছিঁড়তে আরম্ভ করলেন। ছিঁড়তে ছিঁড়তে দেখা গেল একটা রিং মাঝ বরাবর লম্বালম্বি ছিঁড়ে দুটো রিং এ পরিণত হলো। এবার অন্য রিংটা দেখিয়ে আঙ্কেল অয়নদের জিজ্ঞেস করলেন, এই রিংটা আগের মতো লম্বালম্বি ছিঁড়লে কয়টা রিং হবে? অয়নরা সবাই বললো, জ্বী, দুইটা রিং হবে। ম্যাজিশিয়ান আঙ্কেল দেখা যাক বলে ছিঁড়তে শুরু করলেন। ছিঁড়তে ছিঁড়তে মনে হলো রিংটা বোধ হয় পেঁচিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু না, রিংটা প্যাঁচায়নি। পুরোপুরি ছেঁড়ার পরে দেখা গেলো একটা রিং ছিঁড়ে আগের মতো আর দুটো হয়নি। একটাই রিং হয়েছে। তবে আকারে এই রিংটি আগেরটার দ্বিগুণ। এরকম জাদু দেখে আবারও সবার মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেলো। অয়নরা একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি শুরু করলো। এবার জাদুটা ব্যাখ্যার পালা। ম্যাজিশিয়ান বললো, এই জাদুর মূল বিষয় হলো কাগজের টুকরোগুলো জোড়া দেওয়ার পর শেষ জোড়টায় প্যাঁচ দেওয়া। যেটায় দুটো রিং হয় সেটাতে সরাসরি আঠা দিয়ে জুড়ে দিতে হয় শেষাংশ। আর যেটায় একটা বড় রিং হয় সেটাতে শেষ জোড়ের আগে একটা প্যাঁচ দিয়ে আঠা লাগাতে হয়। ফলে সরাসরি যেটা জোড় দেওয়া হয় তাতে কোন প্যাঁচ থাকে না, আর যেটা একটা মোচড় দিয়ে জোড়া লাগানো হয় সেটা ছিঁড়তে গেলে মনে হয় প্যাঁচ খেয়ে গিঁট বোধ হয় লেগেই গেলো। কিন্তু না। আদতে গিট লাগে না, তবে রিংটা একটা বড় রিংয়ে পরিণত হয়।
একদিনেই রাজ আঙ্কেল অয়নদের দশটার মতো ম্যাজিক শিখিয়ে দিলেন। তারপর কীভাবে হাতের সাফাই করতে হয় তাণ্ডও বাৎলে দিলেন। তবে কঠিন ম্যাজিকগুলো এখন না করে পরে করতে বললেন। কারণ ভালো ভাবে হাত সাফাইয়ের কাজ না পারলে কঠিন ম্যাজিকগুলো করতে গিয়ে ধরা খেতে হবে। প্রায় একটানা চারঘন্টা ম্যাজিক শিখিয়ে রাজ আঙ্কেল বিদায় নিতে চাইলেন অয়নদের বাসা হতে। কথাছিল অয়নদের বাসায় দুদিন থাকবেন ম্যাজিশিয়ান আঙ্কেল। কিন্তু তার কী জানি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ আছে। তাই আজ আর অয়নদের বাসায় থাকতে পারবেন না। অগত্যা অয়নের বাবা তার ম্যাজিশিয়ান বন্ধুকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিদায় দিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই চারঘন্টার সেশনে ম্যাজিশিয়ান আঙ্কেল না এক ফোঁটা পানি খেলেন, না এক কাপ চা খেলেন।
ম্যাজিশিয়ান আঙ্কেল চলে যাওয়ার পর থেকে অয়নরা মহাসমারোহে ম্যাজিক প্র্যাকটিস করা শুরু করলো। পরদিন সকালে চায়ের টেবিলে অয়ন, অয়নের মা আর বাবা মিলে ম্যাজিশিয়ানকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অয়নের মা বললো, তোমার বন্ধুকে এবার কেমন যেন একটু পর পর মনে হলো। অয়নের বাবা মাথা নাড়লেন। কথা সত্যি। বন্ধুটা মনে হয় একটু পাল্টে গেছে আগের চেয়ে। তাদের আলোচনার এক ফাঁকে বুয়া আন্টি সকালের পত্রিকাটা অয়নের বাবার হাতে দিয়ে গেলো। অয়নের বাবা পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছেন আর চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। একটা সময় এসে একটা খবরে তার চোখ আটকে গেলো। তার মুখের কথা আটকে গেলো। হাতের চায়ের কাপ পড়ে গেলো হাত থেকে। তার এ অবস্থা দেখে অয়নের মা খবরের কাগজটা কেড়ে নিলো। হাতে নিয়েই তার চোখ চড়ক গাছ! জোরে জোরে তিনি এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেলেন খবরটা, বিশিষ্ট ম্যাজিশিয়ান রাজীব রায়হান গত পরশু কানাডায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘনায় তৎক্ষণাৎ মৃত্যু বরণ করেছেন। মায়ের কণ্ঠে খবর শুনে অয়নের গোঙানি শুরু হয়ে গেল।