প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২১, ০০:০০
ঈদ মানেই তো আনন্দ। তবু একটা বিশেষ ব্যাপার, ঈদের খুশিকে আরও বাড়িয়ে দিতে সব সময়ই থাকে আমাদের পরিবারের তালিকায়। সেটা হলো, ঈদের পর যেকোনো দিন কোনো একটা অদেখা জায়গায় ঘুরতে যাওয়া। সেবার জানতে পারলাম আমরা, মানে আমি আর আব্বু বেড়াতে যাব আমাদের গ্রামের বাড়িতে। যদিও গ্রামের বাড়ি আমার দেখা, তবে নতুনত্বও আছে। এর আগে কখনো ঈদের সময় গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাইনি আমি। আম্মুর কাছে জানতে চাইলাম, এবার ঈদের ছুটিতে আমরা গ্রামের বাড়ি কেন বেড়াতে যাচ্ছি। আম্মু বলল, ‘তোমার দাদির অবস্থা খুব খারাপ। তাই এবার আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে তুমি আর তোমার বাবা গ্রামে গিয়ে তোমার দাদিকে দেখে আসবে। তোমার দাদি তোমাকে দেখতে চেয়েছে।’
ঈদের তৃতীয় দিন রওনা দিলাম গ্রামে। গ্রামের যত কাছাকাছি আসছি, তত যেন উত্তেজিত হয়ে উঠছে মন। দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি দাদি খাটের এক কোণে পড়ে আছেন। দেখতে কেমন হয়ে গেছেন। মনে হয় যেন কঙ্কালের ওপরে চামড়া জড়ানো। সবাই পাশ থেকে বলছে, আপনার নাতি, চিনতে পারছেন? দাদি মাথা নাড়ানোর ভঙ্গিতে বললেন, ‘না।’
মনে পড়লো দাদির যখন দু-তিনটা দাঁত ছিলো, তখন পান ছেঁচে খাওয়াতাম। দাদি বারবার আমার হাতটা চেপে ধরেন আর বলেন, ‘তুমি কেডা।’ আমি নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। গ্রামে যাওয়ার পরদিন চাচাতো বোনের সঙ্গে আমার দাদার কবরের সামনে গেলাম। কবরের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর পাশে একটা বাতাবিলেবুর গাছ দেখতে পাই কবরের পাশে। সেই গাছে কতগুলো বাতাবিও ঝুলতে দেখি। তার মধ্যে একটা বাতাবি বেশ বড় ও আকর্ষণীয়। মন চাচ্ছিল এখনই পেড়ে খাই। পরে জানতে পারলাম ওটা এখনো পাকেনি। পাকতে এক মাস সময় লাগবে। এরপর বাসায় চলে আসার দিন, সবাইকে সালাম করে দাদির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আশ্চর্য বিষয় হলো, যে মানুষটা এত দিন ধরে আমাকে চিনতে পারলেন না, চলে আসার সময় তিনি ঠিকই আমার নাম ধরে ডাকছেন। দাদির হাতটা জাপটে ধরে বললাম, আপনি আমাকে চিনতে পারছেন দাদি? ‘পারছি’, বললেন দাদি। ‘আমারে তোগো লগে খুলনা লবি?’ আমি থেমে বললাম, অবশ্যই নেব। আপনি সুস্থ হয়ে গেলেই নেব। দাদি আমার হাতটা টেনে তাঁর ঠোঁটের সামনে নিয়ে অনেকগুলো চুমু খেলেন। ‘আসছি’ বলে দ্রুত চলে এলাম আমি। চোখ দিয়ে পানি পড়ার আগেই মুছে ফেললাম। বাড়ি থেকে চলে আসার এক মাস পর জানতে পারলাম দাদি আর নেই। আমার সবকিছু যেন অন্ধকার হয়ে গেলো। দাদিকে সেই বাতাবিলেবুগাছের তলে কবরো দেয়া হলো। আর কবর দেওয়ার সময় লক্ষ করলাম, এক মাস আগে যে বাতাবিটা পছন্দ করেছিলাম, সেটাও গাছে নেই। বাসায় চলে আসার দিন দেখলাম বাতাবিগাছটা জোরে জোরে দুলছে। যেন কিছু বলতে চাইছে।