প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২১, ০০:০০
আমার বংশলতিকা ঘাঁটতে যাওয়ার চেষ্টা বৃথা। তাই আমি ঘাঁটিও না। শুধু এটুকু জানি, রবিবাবু আমার দাদু আর তাঁর মা আমার বড়মা। কীভাবে তিনি আমার বড়মা হলেন সে বিষয়ে বেশি প্রশ্ন কেউ আমাকে করলে আমি কোন উত্তর দিতে পারবো না।
আমি হলাম অমল। তবে ডাকঘরের অমল না। আমি যখন ছোট, মাত্র ছবি দেখতে শিখেছি, তখন বাবা একটা দেয়ালে টানানো ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন, ওই দেখো রবি দাদু। সেই থেকে তার মা আমার বড়মা। রবিদাদুর যেমন বয়স বাড়ে না তেমনি আমারও বয়স বাড়ে না। আমি সব সময় যেন নয় বছরের বালক। রবীন্দ্রনাথের মায়ের সাথে আমার মাঝে মাঝে কথা হয়। তিনি করো সাথে দেখা দেন না। শুধু আমাকে কখনও কখনও ডেকে নেন তাঁর কাছে। যেদিন বড়মা'র মনে গল্প জমে সেদিন তিনি আমাকে ডেকে পাঠান। আমার বড় মায়ের লাল পেড়ে সাদা শাড়ি খুব পছন্দ। তাই তিনি সব সময় ঘরে লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়ে থাকেন। রবি দাদুরা আসলে পনর ভাই। তবে শেষ ভাই বুধ দাদু জন্মের পর পরই মারা যান। তাই রবি দাদুই আমার বড়মা'র জীবিত ছোট সন্তান। রবি দাদু কিন্তু ছোটবেলায় মা'র কাছে বেশি থাকেননি। তিনি থাকতেন নিচের ঘরে। যখন পড়ায় ফাঁকি দিতে মন চাইতো তখন উপরের ঘরে গিয়ে বড়মা'র কাছে গল্প ফাঁদতো। বড়মাও তখন ছেলের স্নেহে কাতর হয়ে মাস্টারমশাইকে আসতে না করে দিতেন। সেদিন খুব খর রোদ। বড়মা'র মনে শান্তি নেই। বড়মা আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি খুব দ্রুত উপরে উঠে গেলাম। দেখি বড়মা ঘামছেন। ঘটনা কী বড়মা? তুমি ঘামছ কেন? বড় মা বললেন, যা তো, দেখে আয়,আমার রবিটা কোন বনে বাদাড়ে ঘুরছে তার একটু খবর নিয়ে আয়। শুনলাম সে নাকি আজ স্কুলে যায়নি। আমি বললাম, বড়মা, আমার কী পুরস্কার? বড়মা আমার কানটা মলে দিয়ে বললো যা, তোকে একটা সোনার মোহর দেবো। সোনার মোহরের লোভে আমি খুঁজতে শুরু করলাম রবি দাদুকে। পেয়ে গেলাম শেষমেষ নদীর কূলে। নদীর নাম কোপাই। কোপাই বললে কেউ চিনে না। বলতে হয় ছোটো নদী। এককালে নদীর নাম ছিলো কোপাই বটে। কিন্তু কালে কালে সবাই তা ছোটো নদী বলেই জানে। দাদুর সাথে দেখা হতেই বললাম, এই যে, স্কুল আর ফাঁকি দিতে হবে না। বড়মা ডাকছেন। আমাকে দেখে তিনি চিনতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। মুখে কী জানি বিড়্ বিড়্ করছেন। আমি এবার কান ফাটিয়ে বললাম, হয়েছে, স্কুল ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। বড়মা আপনাকে ডাকছেন। আমাকে ভালো করে ঠাহর করে বললেন, এসে গেছো বড়মা'র অবতার? চলো যাই। শান্তি নেই কোথাও। বললাম, কেন দাদু? দাদু বললেন, তোমাকে যে আমার পেছনে স্পাই লাগিয়ে রেখেছে তোমার বড়মা তা আমি বুঝে গেছি। তুমি আমার শান্তি হরণের কারণ। বাড়ি ফিরেই বড়মার চরণে প্রণাম নিবেদন করে আমি বললাম, রবি দাদু এখন নিচের ঘরে হাওয়া খাচ্ছেন। ডাকতে গেলাম দেখে তাঁর খুব রাগ। বড়মা মুচকি হাসলেন। বললেন, বুঝলি অমল, আমার এই ছেলেটার কিছু মর্জি মতো না হলে বেগড়বাই করে। আচ্ছা তুই বলতো, এই খরা দেওয়া রোদে ঘুরলে অসুখ করবে না? আমি বললাম, তা ঠিক বড়মা। আচ্ছা এবার আমার মোহর দাও দেখি। আমার তাড়া আছে। আমার বলার ধরন দেখে বড়মা হেসে দিলেন। বললেন, তুই আবার কোন আকাশের উল্কা, যে তোর তাড়া থাকবে? বড়মা আমাকে চোখ বন্ধ করতে বললেন। আমি চোখ বন্ধ করলাম। বড়মা চোখ বন্ধ করা অবস্থায় তাঁর হাতের একটা আঙুল দেখিয়ে বললেন, বলতো এখানে কটা আঙুল? বললাম, দুটো আঙুল। বড়মা নিশ্চিত হলেন আমার উত্তরে। আমি যে দেখছি না তা নিশ্চিত হয়ে তিনি গোপন জায়গা থেকে আমাকে একটা মোহর বের করে দিলেন। আমি আগে কখনো মোহর দেখিনি। এই প্রথম মোহর হাতে পেলাম। মোহর পেয়ে নিজেকে গুপ্তধন পেয়েছি বলে মনে হলো। আমি এখন ধনীদের একজন। মোহর দেওয়ার সময় বড়মা বললেন, এটা কিন্তু হারাবিনে। এটা তোকে দেয়া আমার আশীর্বাদ। আমার কি আর অতো কথা কানে যায়! আমি মোহর নিয়েই মৌমাছির মতো ছুটে বেড়াই।
একদিন বুড়ো হয়ে ওঠা সকালের দিকে আমি দোতলায় উঠতে গিয়ে সিঁড়িতে দেখি, রবি দাদু সপাং সপাং রেলিংকে ধরে মারছেন। দাদুকে বললাম, দাদু, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে গো? বেচারা রেলিংদের এমন ইংরেজদের মতো বেতাচ্ছো কেন? ওরা কি আফ্রিকার কালো দাস? আমার কথায় দাদু বললেন বেশ বেড়ে বলেছো অমল। ওরা খুব ফাঁকিবাজ। গতকাল পড়া দিয়েছিলাম। ওরা আজ তা করেনি। এরকম ফাঁকিবাজদের তো শাসন না করে পারি না। আমার স্কুলের মাস্টারমশাইরা আমাদের তো এভাবেই পড়ান, তাই না? আমি সায় দিলাম মাথা নেড়ে। কথা মিছে নয়। বললাম, কাল থেকে যদি তোমাকে ভয় পেয়ে রেলিংগুলো আর ক্লাসে না আসে তবে? আসবে না মানে! আসতে তাদের হবেই। শিক্ষে না নিলে যে ওরা বড় হবে না। রবি দাদুর সাথে কথা শেষ করে আমি রাস্তায় বের হয়ে পড়ি। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। কালকের বাতাসকেও আমার এমন খুশি খুশি লাগেনি। অথচ আজকের আকাশটাও কেমন হাসি হাসি মুখ। ঠাকুরবাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কার জানি মিষ্টি গলার গানের কলি শোনা গেল।
পথে যেতে যেতে একটা হাওয়াই মিঠাঅলার দেখা পেলাম। বললাম আমাকে একটা হাওয়াই মিঠাই দাও। তুলতুলে গোলাপি হাওয়াই মিঠাই। মুখে দিলেই গলে যায়। আহা! বড়রা যদি একবার এটা খেয়ে দেখতো তবে তো আমরা ছোটরা চান্সই পেতাম না। ভাগ্যিস্ বড়রা খায় না। হাওয়াই মিঠা তো খেলাম। এবার টাকা দেওয়ার পালা। টাকা দেব কীভাবে। আমার তো কেবল একটা সোনার মোহর আছে। বড়মা'র দেওয়া সোনার মোহর। এটা দেখানোর আগেই হাওয়াই মিঠাইঅলা বললো, তোমার টাকা দিতে হবে না অমলবাবু। তোমার মুখে সাক্ষাৎ বিধাতার আলো ফুটে উঠেছে। ফাও হাওয়াই মিঠাই খেয়ে যেমন ভালো লাগছে তেমনি আবার বিনে পয়সায় খাওয়ায় মনে খচ্ খচ্ করছে। ইচ্ছে ছিলো আজকে মালাই কুলপি খাবো। কিন্তু তার আর হলো না। আজকে আবার রবি দাদুকে গান শেখাতে বিহারীলাল আসবে। বিহারীলালের গানের গলা যা সুন্দর! আমি তাড়াহুড়ো করে ঠাকুরবাড়িতে ফিরে এলাম।
এতো তাড়াতাড়ি আজ দুপুরের খাবার হয়ে যাবে ভাবিনি। দেখলাম রবি দাদু মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর ঘরে। কি গো দাদু, মুখে মেঘ করলো কেন? দাদু আমার দিকে কটমট করে এমনভাবে তাকালেন যেন তার মুখে আমিই কালি মেখে দিয়েছি। ঘটনা কী? ঘটনা আর কী। ঐ ব্যাটা ব্রজেশ্বর। কেন, কী করেছে ব্রজেশ্বর? আমি আজ দুটো লুচি চেয়েছিলাম। লুচিগুলো আজ খেতে বেশ হয়েছে। কিন্তু আমাকে না দিয়ে বলে , আর দোবো কি? আরে ব্যাটা, তুই যদি দিতিস্ তো এমনি এমনি দে। লুচি লুকিয়ে রেখে বলবি কেন আর দোবো কি। আমার হাসি পেলো। আহারে বেচারা! একটু লুচি খেতে চেয়েছিল। এ আর এমন কী। আমি এই ঘটনা খুব বেশি পেটে ধরে রাখতে পারলাম না। দ্রুত উপরে উঠে বড়মা’র ঘরে গেলাম। বড়মাকে একটু রোগা রোগা মনে হলো। বড়মা আমাকে দেখে বললেন, কিরে অমল, আবার কী সুসংবাদ নিয়ে হাজির হলি? না বড়মা। তেমন সুসংবাদ নয়। তোমার ছোট ছেলের আজ মুখখানা গোমড়া দেখলাম তো তাই জানাতে এলাম গো। কেন কী হয়েছে? ঐ যে ব্রজেশ্বর। ঐ কংসটা দাদুকে লুচি খেতে দেয়নি। দেয়নি মানে? মানে আজকে রবি দাদুর লুচি খেতে খুব ভালো লাগছিলো। একটা খেয়ে দ্বিতীয়টা চাইতে যাবে এমন সময় ব্রজেশ্বর চোখ কটমট করে বললো, আর দোবো কি? তার বলার ভঙ্গি দেখে ভয় আর বিরক্তিতে দাদু আর লুচি চায়নি। আমার কথা শুনে তো বড়মা'র মনে কষ্ট হলো। উনি তাড়াতাড়ি ব্রজেশ্বরকে খবর পাঠালেন। বললেন, আজ রাতে যেন রবিকে লুচি করে খাওয়ানো হয়। আমাকে বললেন, অমল, তুই এবার খেলতে যা বাপ। আমার আজকে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। শোন, আমার কিছু হলে তুই তোর দাদুকে দেখে রাখিস্। বড়মা কোনদিন এরকম কথা বলেননি। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। নিচে এসে গেলাম। আমি রাতে ঠাকুর বাড়ির বাইরে আমাদের বাড়িতে থাকি। দিন হলে সারাক্ষণ ঐ বাড়িতেই আমার তীর্থ। এরকম আনন্দে ভরা তীর্থ আমি হারাতে চাই না। রাতে এসে মাকে বললাম বড়মা'র কথা। মা-ও অবাক হলো। বাবাকে বড়মা'র দেয়া মোহরটা দিলাম। বাবা বললো, এটা অনেক দামী জিনিষ। ঐতিহাসিক। আমি অতোশত বুঝি না। রাতের খাবার খেয়েই ঘুম। সকালে ঘুম ভাঙে কান্নার শব্দে। কী ব্যাপার! কাঁদছে কে? উঠে দেখি, ঠাকুর বাড়ির ভৃত্য রামচরণ কাঁদছে। কর্তামা মারা গেছেন। আমি তড়াক করে লাফ দিয়ে দৌড় মারি ঠাকুর বাড়িতে। আমার বড়মা নেই! বলে কী? আমি সরাসরি দোতলার ঘরে উঠে গেলাম। দেখি, সাদা কাপড়ে ঢেকে রেখেছে বড়মা'র দেহ। মেয়ে ভৃত্যরা চারদিক ঘিরে আছে। রবি দাদুকে এখনও দেখতে দেওয়া হয়নি। কিছু রীতিনীতি পালন করা শেষ হলো। এবার ডাক পড়লো নিচতলার লোকেদের। রবি দাদু এলেন। তাঁর মায়ের মুখখানি দূর হতে দেখে নেমে গেলেন। আমিও তাঁর সাথে সাথে গেলাম। দাদু বললেন, অমল, মরণ কী জিনিষ রে? আমি বললাম তা তো আমিও জানিনে। তুই দেখিস নি, মা ঘুমোচ্ছে? ঘুম থেকে মা ঠিকই জেগে উঠবে। বুঝলাম, রবি দাদু এখনও বুঝে উঠতে পারেনি, বড়মা মারা গেছেন। সকল রীতিনীতি শেষে এবার শুরু হলো শবযাত্রা। রবি দাদু আর আমি পাশাপাশি চলছি। এই প্রথম রবি দাদু আর আমার মনে হলো, মৃত্যু মানেই শেষ যাত্রা। মৃত্যু মানে মানুষটা আর নেই, যে কালকেও ছিলো।