রবিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪২

খাদ্য উৎপাদন কৃষকের একার দায়িত্ব কি?

সমীরণ বিশ্বাস
খাদ্য উৎপাদন কৃষকের একার দায়িত্ব কি?

মাছে-ভাতে বাঙালি’ এই তো আমাদের পরিচয়। খাদ্যই সংস্কৃতি, খাদ্যেই বিশ্বাসÑএই তো আমাদের আবশ্যিক আশ্রয়। খাদ্য শুধু পেটের প্রয়োজন নয়, আমাদের কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ের অভিব্যক্তি। প্রতিটি অঞ্চলের পাতে উঠে আসে তার ইতিহাস। রন্ধনপ্রণালী বলে তার সভ্যতার ভাষা। বাংলার প্রতিটি মৌসুম, প্রতিটি উৎসব, প্রতিটি পারিবারিক মুহূর্তেও খাদ্যই কেন্দ্রে। পান্তা-ইলিশ হোক বা পায়েস, লুচি-ছোলার ডাল হোক বা খিচুড়িÑসবকিছুতেই লুকিয়ে আছে একেকটি গল্প, একেকটি সংস্কৃতির অধ্যায়।

‘উত্তম খাদ্যে গড়ি আগামীর স্বপ্ন’Ñবাক্যটি শুধু একটি বার্তা নয়, একটি দায়িত্ব। যে খাদ্যে আছে পুষ্টি, গুণ, যত্ন, সেই খাদ্যই নির্মাণ করে সুস্থ শরীর, সজীব মন এবং আশাব্যঞ্জক আগামী। সেই উপাচারে যদি থাকে যত্ন আর শুভবুদ্ধি, তবে ভবিষ্যৎও হবে উজ্জ্বল আর উন্নত। আসুন, আমরা খাদ্যের প্রতি সচেতন হই, স্থানীয় ও মৌলিক খাদ্যকে গুরুত্ব দিই। পুষ্টিকর, নিরাপদ ও পরিমিত আহারে গড়ি একটি সুস্থ জাতি, সুস্থ সমাজ এবং উজ্জ্বল আগামীর স্বপ্ন।

বিশ্বে আজও কোটি কোটি মানুষ পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাবার পায় না। অন্যদিকে খাদ্যের অপচয়, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈষম্য সমস্যাকে আরও গভীর করছে। তাই খাদ্য শুধু মৌলিক অধিকার নয়, একটি টেকসই ভবিষ্যতের ভিত্তি। জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি প্রযুক্তি, টেকসই কৃষি, গ্রামীণ উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি।

উত্তম কৃষিচর্চা, উত্তম খাদ্য

মানবজীবনের অস্তিত্বের মূল ভিত্তি খাদ্য। সেই খাদ্যের গুণগত মান নিয়েই সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ। আধুনিক পৃথিবীতে শুধু পেট ভরানোই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন নিরাপদ, পুষ্টিকর এবং গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য। তাই উত্তম তথা নিরাপদ খাদ্য এখন কেবল একটি চাহিদা নয়, এটি হয়ে উঠেছে টিকে থাকার অনিবার্য শর্ত।

বাংলাদেশও উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে এসেছে উত্তম খাদ্য উৎপাদনের পথে। এরই মধ্যে সরকার প্রণয়ন করেছে ‘বাংলাদেশ উত্তম কৃষিচর্চা’ নীতিমালা। যার মাধ্যমে কৃষিকে শুধু উৎপাদনশীলতার সীমায় নয়, বরং নিরাপত্তা, গুণগত মান, পরিবেশ এবং সামাজিক মূল্যবোধের আলোকে সাজানো হয়েছে। এ নীতিমালার চারটি স্তম্ভ। নিরাপদ খাদ্য ও উন্নত মান, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, টেকসই পরিবেশ এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কৃষিকে দিয়েছে নতুন দিগন্ত। একই সাথে মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে কৃষকের ঘাম আর শ্রম থেকে উঠে আসা ফল ও সবজি হয় নিরাপদ, গুণগত মানসম্পন্ন, পরিবেশবান্ধব এবং কৃষি শ্রমিকের স্বাস্থ্য ও কল্যাণনির্ভর। এর মধ্য দিয়েই ফুটে উঠে একটি টেকসই কৃষির স্বপ্ন, যেখানে মানুষের পাশাপাশি প্রকৃতিও সমান মর্যাদায় রক্ষা পায়।

খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে সুস্থ জীবন, সুন্দর পৃথিবী কিংবা মানবতার অগ্রযাত্রা কোনোটাই সম্ভব নয়। তাই আসুন, আমরা সবাই উত্তম খাদ্যের চর্চা করি। মানব ও প্রাণীজগতের জন্যে গড়ে তুলি নিরাপদ আগামী। কারণ এ সংগ্রামই আমাদের বেঁচে থাকার চিরন্তন লড়াই।

হাতে হাত রেখে উত্তম খাদ্য উৎপাদন

মানবজীবনের প্রধানতম প্রয়োজন হলো খাদ্য। সুস্থ ও সুষম জীবনযাপনের জন্যে নিরাপদ, পুষ্টিকর এবং পর্যাপ্ত খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, জমির ক্রমহ্রাস, কৃষিজ উৎপাদনে রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এবং বাজার ব্যবস্থার অসামঞ্জস্য আমাদের খাদ্যনিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তাই আজকের সময়ে ‘হাত রেখে হাতে উত্তম খাদ্য উৎপাদন’ কেবল একটি স্লোগান নয়, বরং এটি এক বাস্তব প্রয়াস, যেখানে সমাজের প্রত্যেকটি স্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

খাদ্য উৎপাদন কেবল কৃষকের একার দায়িত্ব নয়। কৃষক বীজ বপন করেন, জমি প্রস্তুত করেন, শ্রম দেন, কিন্তু সঠিক প্রযুক্তি, আর্থিক সহায়তা, বিপণন ব্যবস্থা ও ন্যায্য মূল্য না পেলে তিনি টেকসই উৎপাদনে আগ্রহ হারান। অপরদিকে ভোক্তারাও নিরাপদ খাদ্য পেতে চান, যাতে বিষাক্ত কীটনাশক বা ভেজাল না থাকে। এই দু পক্ষকে সংযুক্ত করার জন্যে প্রয়োজন সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি উদ্যোগ এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত সহযোগিতা। অর্থাৎ সবার হাত একসঙ্গে যুক্ত হলে তবেই সম্ভব হবে উত্তম খাদ্য উৎপাদন।

প্রথমত, কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে। ড্রিপ ইরিগেশন, স্মার্ট ফার্মিং, জৈব সার, বায়োপেস্টিসাইড, জলবায়ু সহনশীল জাতের বীজ ইত্যাদি উদ্ভাবনগুলো কৃষক পর্যায়ে পেঁৗছে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার এবং এনজিওদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয়ত, খাদ্য উৎপাদনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। উৎপাদন থেকে ভোক্তার হাতে পেঁৗছানো পর্যন্ত পুরো সাপ্লাই চেইনকে ডিজিটালাইজেশন ও নজরদারির আওতায় আনলে ভেজাল ও অপচয় অনেকাংশে কমে যাবে।

তৃতীয়ত, কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য রোধ না করলে কৃষকের প্রাপ্য অংশ সে কখনোই পাবে না। এ জন্যে সমবায়ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থা, কৃষি ব্যাংকের সহজ ঋণ এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার কৃষকদের আয়ের নিরাপত্তা বাড়াতে পারে।

চতুর্থত, ভোক্তা পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করাও সমান জরুরি। নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা বাড়লে কৃষকও জৈব ও টেকসই উৎপাদনে আগ্রহী হবেন। পরিবার ও সমাজ যদি একত্রে নিরাপদ খাদ্যের দাবিতে এগিয়ে আসে, তবে কৃষি নীতি ও বাজার ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবেই।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলোÑখাদ্য উৎপাদন কেবল অর্থনৈতিক বা প্রযুক্তিগত বিষয় নয়, এটি সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্বও বটে। একজন কৃষকের পরিশ্রমকে সম্মান করা, প্রকৃতিকে রক্ষা করা এবং ভোক্তার স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়াÑতিনটির সমন্বয় ঘটাতে পারলেই আমরা প্রকৃত অর্থে ‘হাত রেখে হাতে উত্তম খাদ্য উৎপাদন’ বাস্তবায়ন করতে পারবো।

উত্তম খাদ্য উন্নত আগামীর পথ

মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে শুধু পেট ভরানোই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ। উত্তম খাদ্য শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষায় নয় বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতিতেও বড়ো ভূমিকা রাখে। তাই বলা যায়, ‘উত্তম খাদ্যই উন্নত আগামীর পথ।’

একজন মানুষ যদি প্রতিদিন প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও চর্বি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করেন, তবে তার শরীর শক্তিশালী হবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং মানসিক সতেজতাও বজায় থাকবে। অপরদিকে, নিম্নমানের বা ভেজালযুক্ত খাদ্য দীর্ঘমেয়াদে নানা ধরনের অসুখ, যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অপুষ্টি কিংবা ক্যানসারের মতো জটিল রোগ সৃষ্টি করতে পারে। তাই সঠিক খাদ্যাভ্যাসই ব্যক্তির কর্মক্ষমতা ও সুস্থ জীবনের ভিত্তি।

সমাজের ক্ষেত্রে উত্তম খাদ্যের গুরুত্ব আরও স্পষ্ট। একটি সুস্থ প্রজন্মই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। শিশুদের সঠিক বিকাশের জন্যে পুষ্টিকর খাদ্যের বিকল্প নেই। একটি শিশু যদি শৈশবেই পর্যাপ্ত ভিটামিন ও খনিজ না পায়, তবে তার শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফলস্বরূপ, ভবিষ্যতে সে কর্মক্ষম নাগরিক হয়ে উঠতে পারে না। তাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের পাশাপাশি খাদ্যের মান নিশ্চিত করাও সমান জরুরি।

অর্থনীতির দিক থেকেও উত্তম খাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সুস্থ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীই একটি দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়। কৃষক যদি নিরাপদ ও মানসম্পন্ন খাদ্য উৎপাদনে সচেষ্ট হন এবং জনগণ যদি সচেতনভাবে সেসব গ্রহণ করে, তবে দেশীয় খাদ্যশিল্পও সমৃদ্ধ হবে। এতে আমদানি নির্ভরতা কমে যাবে, রপ্তানি বাড়বে এবং জাতীয় অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।

অন্যদিকে, খাদ্যে ভেজাল একটি বড়ো সমস্যা। রাসায়নিক পদার্থ, ফরমালিন, কৃত্রিম রং ও কীটনাশকের অবাধ ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যে হুমকিস্বরূপ। শুধু ভোক্তাই নয়, উৎপাদক কৃষকেরাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সরকার, উৎপাদক (কৃষক) ও ভোক্তাÑতিন পক্ষকেই দায়িত্বশীল হতে হবে।

উত্তম খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য কিছু বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, জৈব ও প্রাকৃতিক উপায়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। অর্থাৎ উত্তম কৃষিচর্চার মাধ্যমে কৃষিপণ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, খাদ্য সংরক্ষণ ও পরিবহন প্রক্রিয়ায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। তৃতীয়ত, জনসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যকর্মীদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আনতে হবে। অযথা ফাস্টফুড বা জাঙ্কফুডের প্রতি আসক্তি না বাড়িয়ে দেশীয় শাক-সবজি, ফল-মূল, মাছ ও দুধকে খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। স্থানীয় খাদ্যের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি পেলে কৃষকেরাও লাভবান হবেন এবং গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।

সবশেষে বলা যায়, উত্তম খাদ্য কেবল সুস্থ শরীর গঠনে নয় বরং উন্নত, সচেতন ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্তমান প্রজন্ম যদি স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণে মনোযোগী হয়, তবে আগামী প্রজন্ম পাবে একটি সুস্থ ও কর্মক্ষম সমাজ। তাই আজই আমাদের শপথ নিতে হবে, উত্তম খাদ্যের মাধ্যমে গড়বো উন্নত আগামীর পথ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়