শনিবার, ২৮ জুন, ২০২৫  |   ৩২ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৫, ০৭:৫৮

তসলিম হোসেন হাওলাদার একজন কবির প্রতিকৃতি

খান -ই- আজম
তসলিম হোসেন হাওলাদার  একজন কবির প্রতিকৃতি

দীর্ঘদিনের শারীরিক অসুস্থতাজনিত কোন সভা-সমাবেশ, সামাজিক আচারানুষ্ঠান এমনকি সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক কোনো অনুষ্ঠানেও যোগ দিতে পারিনি। একপেশে একটা স্থবির জীবন যেন স্বগৃহে পরবাসী হয়ে কাটাচ্ছি। জানি না কবে এর অবসান হবে কিংবা আদৌ হবে কি না। প্রতিদিন নিয়ম করে পূর্বাকাশে সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে নতুন দিনের সূচনা হয় আবার একই নিয়মে দিনশেষে পশ্চিম আকাশে সূর্য ডোবার মধ্য দিয়ে রাতের আগমন ঘটে। এ নিয়মের ব্যত্যয় কখনো ঘটেনি। অনাদিকাল থেকে মানুষ তা দেখে আসছে। ফেলে আসা জীবনের পরিধিজুড়ে এসব তেমন করে ভেবেছি বলে মনে হয় না। কিন্তু এখন বার্ধক্যে এসে মনে হচ্ছে একেকটি দিন তো নয় যেন একেকটি যুগ চোখের সম্মুখ দিয়ে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। জীবনের হিসেব মেলাতে গিয়ে দেখি কী পেয়েছি কী পাইনি-র চেয়ে শূন্যতাটাই বড় বেশি দৃশ্যমান।

মনে হয় এইতো সেদিন নিত্যদিনের সহচর সুহৃদ কবি ইকবাল পারভেজ ফোন করে জানালেন চাঁদপুর সাহিত্য সমাজের অন্যতম পুরোধা কবি ও লেখক তসলিম হোসেন হাওলাদার আমাদের মাঝে আর নেই। তঁার আকস্মিক মৃত্যুর তারিখ ১৫ মে বর্ষপরিকমার্য় আবার আমাদের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। তসলিম ভাইর মৃত্যুর পর চাঁদপুরে একটা স্মরণ সভা হয়েছিল। সাহিত্যপ্রেমী অনেক আলোচক প্রয়াত তসলিম ভাইয়ের ব্যক্তিগত গুণাবলি ও সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। আমি যতোটা জানি তঁার জীবদ্দশায় তিনিও অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে কখনো জয়ী হয়েছেন আবার কখনো বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন।

এ নিরহংকার আটপৌড়ে জীবনযাপনে অভ্যস্ত সাদামাটা মানুষটাকেও আমাদের মতো চারপাশের মানুষের দ্বারা নিগৃহীত হতে দেখেছি। তিনি নিরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলেছেন কিন্তু কোনরূপ প্রতিকার চাওয়াতো দূরের কথা কাউকে অভিসম্পাত পর্যন্ত করেননি। তসলিম ভাইয়ের সাথে পরিচয় হবার পর তঁার সাথে কথা বলতে, আড্ডা দিতে ও সময় কাটাতে খুব ইচ্ছে হতো। মনে আছে একদিন তিনি কর্মজীবনে আমার সর্বশেষ পদবী ও মাসিক পেনশন সম্পর্কে জানতে চান। আমি খোলামনে জানানোর পর তিনি আমায় অবাক করে দিয়ে বলেন, আমার কর্মকালীন মাসিক বেতনের পরিমাণ আপনার মাসিক পেনশনের চাইতেও কম ছিলো। তঁার এ স্বভাবসুলভ সারল্য আমি কোনদিন বিস্মৃত হবো না। তঁার ছেলে মেয়ে ও পারিবারিক নানান বিষয়ে অনেক কথা হতো। বয়সের দিক থেকে আমার সবচাইতে নিকটতম ব্যক্তি তসলিম ভাই। সম্ভবত সে কারণে তাঁকে আমার খুব কাছের মানুষ মনে হতো। অনেক সময় দুষ্টুমী করে তাঁকে চা-নাস্তা খাওয়াতে বললে তিনি বলতেন অন্য কোনোদিন। এ নিয়ে তাঁর সাথে অনেক হাসি তামাসা হতো। আমি কখনো তাঁকে রেগে যেতে দেখিনি। বন্ধুমহলের সবধরনের অত্যাচার তিনি হাসিমুখে উড়িয়ে দিতেন। অনেক পীড়াপিড়িতে তাঁর জীবদ্দশায় একবার পুরাণবাজারের বাসায় গেলাম সংখ্যায় আমরা সাহিত্য সমাজের ৫/৭ জন। তাঁর আন্তরিকতা ও আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ হলাম। বিদায়ের সময় তিনি আমাদের অটোস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দেন। দ্বিতীয় বার আমরা দলেবলে তসলিম ভাইয়ের বাড়িতে যাই এবং আঙিনায় শামিয়ানার নিচে একসঙ্গে বসে তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী জিয়াফতের খানা খাই। বার বার মনে হতে থাকে তসলিম ভাইয়ের মতো হৃদয়বান মানুষের সঙ্গ পেতে না জানি আরও কতোকাল প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে হয়।

তসলিম ভাইÑজানি আর কোনোদিন তোমাকে আমাদের মাঝে ফিরে পাবো না। কিন্তু তোমার নীতি, আদর্শ, মানবিক মূল্যবোধ এবং সর্বোপরি সৃজনশীলতা আমাদেরকে যুগযুগ ধরে অনুপ্রেরণা যোগাবে। তুমি আমাদের মানসপটে চিরভাস্বর হয়ে বিরাজ করবে। তছলিম ভাইর কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ পাঠে আমরা তঁাকে নিত্য খুঁজে পাই। পোকা, রাস্তাসহ সবগুলো কবিতা বারবার পাঠ করি। তুমি এ কোন রাস্তা ধরে চলে গেলে কবি! মাঠের যোদ্ধা চাই প্রবন্ধ গ্রন্থে রাজনীতির বিষয়াদি তুলে এনেছো। আজ মনে হচ্ছে সত্যিই মাঠ ফাঁকা হয়ে পড়েছে। একজন মাঠের যোদ্ধা বড়ো প্রয়োজন।

তঁার সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘অনপেক্ষ’ প্রকাশ হবে না হয়তো। তিনি খুব বেশি সংখ্যক লেখার পক্ষে ছিলেন না। একটি উপন্যাস লেখার আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন। লেখা হয়ে উঠেনি। সময় তঁাকে সে সুযোগ দেয়নি। তছলিম হোসেন হাওলাদার এক অসমাপ্ত উপন্যাস হয়ে রয়ে গেলেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়