প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৫, ১১:০৫
ফুলকুমারির ঈদ

চাঁদের আলো যখন আকাশজুড়ে মিটিমিটি হাসে। শহরের অলিগলিতে যখন ঈদের চাঁদের ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে। তখন ছোট্ট ফুলকুমারীর হৃদয়ে একরাশ আবেগের ঢেউ খেলে যায়। সবাই যখন আনন্দে মেতে ওঠে, নতুন পোশাকের গল্প করে। তখন ফুলকুমারির মুখটা ভার হয়ে আসে। তার ঈদ মানে যেন অন্যরকম কিছুÑউৎসবের রঙে মিশে থাকা এক টুকরো ক্লান্তি, কিছু না পাওয়ার ব্যথা, আর অসীম এক প্রত্যাশার আলোর রেখা।
মাত্র নয় বছর বয়সী ফুলকুমারি। কচি হাতে ছোট ছোট মালা বুনে শহরের মোড়ে মোড়ে ঘোরে। সে ফুল বিক্রি করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি শহরের ট্রাফিক সিগন্যালে, দোকানের সামনে, পার্কের গেটেÑযেখানে মানুষ, সেখানে তার পথচলা। প্রতিটি মালার প্রতিটি ফুল যেন তার জীবনসংগ্রামের প্রতীক। তার মুখে একটি নরম হাসি লেগে থাকে, যদিও চোখে লুকিয়ে থাকে ক্লান্তির ছায়া।
কিছুদিন আগেও তার জীবন ছিল একটু অন্যরকম। বাবা ছিলেন রিকশাওয়ালা। কষ্ট করতেন, কিন্তু পরিবারের মুখে হাসি ছিল। মা অনেক আগেই চলে গেছেন। বাবা আর মেয়ের সংসার ছিল ছোট, কিন্তু উষ্ণ। প্রতিদিন বিকেলে বাবা ফুলকুমারিকে নিয়ে গল্প করতেন, কখনো লজেন্স এনে দিতেন। ঈদের সময় ছোট্ট একটা জামা, একটু সেমাইÑতাতেই তাদের ঈদ হতো রঙিন। কিন্তু এক ভয়ংকর দিন সবকিছু পাল্টে যায়। বাবার রিকশা এক বেপরোয়া ট্রাকের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে যায়। বাবার দুটো পা চিরতরে অচল হয়ে পড়ে। সেই থেকে বিছানাই তার ঠাঁই। জীবন থমকে যায় ফুলকুমারির। কোনো আত্মীয় নেই, প্রতিবেশীরাও দিন গেলে এক গ্লাস পানি দেয় না। তখন থেকেই ফুলকুমারি শুরু করে তার ফুল বিক্রির সংগ্রাম।
ঈদ আসছে। শহরজুড়ে আনন্দের হাওয়া বইছে। কিন্তু ফুলকুমারির জীবনে ঈদের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবুও, তার একটা ছোট্ট ইচ্ছে আছেÑএবার ঈদের দিন বাবার মুখে হাসি ফুটাতে হবে। বাবার শরীর খুব দুর্বল, ওষুধ কিনে টাকা থাকে না খাবারের জন্য। কিন্তু ঈদের দিনে অন্তত একটা বড় মাছ কিনে বাবার সামনে রাখতে চায় সে।
এই ইচ্ছেই তার চলার শক্তি। ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকে সে আরো বেশি করে মালা বানায়। দড়িতে গাঁথে গাঁথে রজনীগন্ধা, গাঁদা আর বেলিফুল। তার হাতে ফুলের সৌরভ, আর মনে অদম্য সাহস। কেউ মালা কিনে বলে “কি সুন্দর!”, কেউবা কড়া ভাষায় তাড়িয়ে দেয়। কেউ দাম দিয়ে বেশি টাকা দেয় না, কেউ একেবারেই দেয় না। তবুও ফুলকুমারি দমে না। সে ভাবে, বাবার মুখে হাসি ফোটানো চাই-ই চাই।
একদিন হঠাৎ এক দয়ালু নারী একটি গাড়ি থেকে নেমে তার মালা দেখে থমকে যান। মেয়েটির চোখে ক্লান্তি আর মুখে হাসির মিশ্র অনুভূতি মহিলার মন ছুঁয়ে যায়। তিনি সব মালা কিনে নেন, আর বলেন, “এই ঈদটা তোমার ভালো কাটুক, মা।” অতিরিক্ত ৫০০ টাকা হাতে দিয়ে দেন। ফুলকুমারির চোখে আনন্দের জল চলে আসে। সে ভাবে, এবার হয়তো বাবার জন্য বড় মাছ কেনা সম্ভব।
ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় সে বাজারে যায়। অনেক দর কষাকষির পর এক দোকানদার তাকে একটি বড় রুই মাছ কম দামে দিয়ে দেয়। হাতে আর কয়েকটা টাকা থাকে, সে বাবার জন্য আধা কেজি চাল আর একটু ডাল কিনে আনে। ঈদের দিনের জন্য ছোট্ট একটা পরিকল্পনা তার মনজুড়ে।
ঈদের দিন সকালে, ভোরের আলোয় বাবার মুখে ঘুমন্ত শান্তি দেখে সে ধীরে ধীরে রান্না শুরু করে। চাল ধোয়া, ডাল ফুটানো, আর মাছ ভাজার সময় সে বাবার মুখের প্রতিটি রেখা কল্পনায় আঁকেÑযেখানে থাকবে অবাক হওয়া, ভালোবাসা আর গর্ব।
বাবা খুড়িয়ে খুড়িয়ে বসে, আর তার সামনে সাজানো হয় ফুলকুমারির প্রস্তুত করা সেই ঈদের খাবার। বড় মাছটা দেখে বাবার চোখ ছলছল করে ওঠে। তিনি শুধু বলেন, “তুই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার, মা। তোর মতো মেয়ে পেয়ে আমি ধন্য।”
সেই ঈদে ফুলকুমারির জন্য নতুন জামা ছিল না, কারো দাওয়াত ছিল না, সেমাই ছিল না। ছিল কেবল পিতার চোখের অশ্রু, ছিল তার মুখের প্রশংসার ছায়া, আর ছিল সন্তুষ্টির এক অদ্ভুত আলো। এই আলো তার ঈদকে করে তোলে সবচেয়ে আনন্দময়, সবচেয়ে পূর্ণ।
আজো শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় ছোট্ট সেই ফুলকুমারি। কিন্তু তার চোখে এক দীপ্তি, মনে এক অহংকারÑসে একজন সংগ্রামী কন্যা, এক নিঃশব্দ নায়িকা। ঈদ শুধু উৎসবের নাম নয়, ঈদ মানে ভালোবাসার ছোঁয়া, ত্যাগের সৌন্দর্য, আর হৃদয়ের বিজয়।