মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:০৫

স্মৃতিতে ঈদের নতুন জামা

খান-ই-আজম
স্মৃতিতে ঈদের নতুন জামা

ক্লাস থ্রিতে পড়ি। প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় ক্লাসে চুয়ান্নজন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম হলাম। এসবে আমার দৃকপাত নেই। আম্মা তাতেই সন্তুষ্ট। কিন্তু আব্বা কিছুতেই এ ফলাফল মেনে নিতে রাজী নন। তাঁর একই কথা বার্ষিক পরীক্ষায় এমনতর ফলাফল কিছুতেই চলবে না। যে করেই হোক আমায় ক্লাসে প্রথম হতেই হবে। আব্বা খুব রাগী মানুষ। আমরা ভাই-বোনেরা আব্বাকে ভীষণ ভয় পাই। তিনি আমাদেরকে সবসময় কঠোর অনুশাসনে রাখেন। কিন্তু আম্মা এক্ষেত্রে আব্বার সম্পূর্ণ বিপরীত। আম্মার কাছে সাতখুন মাফ। আম্মাকে বলি, আমি যদি বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হতে পারি তাহলে তোমরা আমায় কী পুরস্কার দেবে বলো? তিনি হাসিমুখে বলেন, আগে তো প্রথম স্থান অর্জন করো, তারপর দেখা যাবে। শুধু মুখে বললে তো আর হবে না কাজে পরিণত করে দেখাতে হবে। খেলাধুলা ও দুষ্টুমিটা কিছুদিনের জন্য কমিয়ে পড়াশোনার প্রতি অধিকতর মনোযোগী হও, তবেইনা প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জনে সক্ষম হতে পারবে। আম্মাকে আশ্বস্ত করার জন্য তাঁর গা ছুঁয়ে বলি, আম্মা তুমি দেখে নিও তোমার ছেলে বার্ষিক পরীক্ষায় ক্লাসে প্রথম হবেই হবে ইনশাআল্লাহ্। তবে আমার একটা শর্ত আছে। আম্মা বলেন কী শর্ত খুলে বলো। আমি আনন্দচিত্তে জানালাম, ছোট চাচির ভাইপো শাহ্জাহান ও শাহ্আলম দুভাই সাদা মোটা কাপড়ের যে শর্টপ্যান্ট, লাল রঙের টিশার্ট ও বাটার তৈরি চামড়ার টেডি জুতো পরে সেদিন শহর থেকে আমাদের বাড়ি বেড়াতে এলো আমায় সেসব কিনে দিতে হবে। আব্বা যেনো আবার ধমকের সুরে থামিয়ে না দেন। আম্মা বলেন, আচ্ছা ঠিক আছে যে করেই হোক তোমার আব্দার পূরণে তোমার আব্বাকে রাজী করাবো। এবার গ্লাসের সবটুকু দুধ খেয়ে পড়তে বসে যাও। তোমার আব্বার বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গেছে।

সুবোধ বালকের মতো পড়তে বসে যাই। কিন্তু পড়ার প্রতি তেমনকরে মন বসাতে পাচ্ছি না। মাথায় কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে সেই কবে বার্ষিক পরীক্ষা হবে, কবে ফল বেরুবে ততোদিন পর্যন্ত আমার স্বপ্ন পূরণের অপেক্ষার পালা। মনে মনে সংকল্প করি ঈদুল ফিতর ছুটির আগে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল বের হলে আমায় আর কে পায়। আব্বার সাথে চাঁদপুর গিয়ে প্যান্ট, শার্ট ও জুতোসহ ঈদের কেনাকাটা করে সবাইকে চমক দেখাবো।

দেখতে দেখতে বার্ষিক পরীক্ষা সম্পন্ন হলো। ঈদের ছুটির আগেই ফলাফল জানানো হলো। আমি ক্লাসে প্রথম হলাম। আনন্দে আটখানা হয়ে চটজলদি বাড়ি এসে আম্মাকে কদমবুচি করে আব্বাকে খুঁজতে থাকি। আম্মাকে বলি, এবার কিন্তু তুমি আব্বাকে বলে সব ব্যবস্থা করো। আমার কিন্তু আর তর সইছে না।

আব্বা বাড়ি এসে রাতের খাবার শেষ করা মাত্র আম্মা পানের বাটা এগিয়ে দিয়ে বলেন, তোমার ছেলের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ফলাফলতো পেলে এবার ওর সাধ-আহ্লাদ পূরণ করো। আব্বা অট্টহাসি দিয়ে আম্মাকে বলেন, তোমার ভাবখানা এমন তোমার ছেলে যেনো দিকবিজয়ী আলেক্জান্ডার, এই মাত্র বিশ্বজয় করে ঘরে ফিরেছে। আমি লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমের ভান করে আব্বা-আম্মার কথোপকথন শুনছি। অসাবধানতাবশত হঠাৎ সশব্দে হেসে উঠি। আম্মা বলেন, ওরে দুষ্টু ছেলে তুই এখনও ঘুমোসনি। আমার মুখের ওপর থেকে লেপ সরিয়ে কপালে চুমো খেয়ে আব্বা অনেক দিন পর আমায় আদর দিলেন। আনন্দের আতিশয্যে আমার কান্না চলে আসে।

ঈদের আর মাত্র দুদিন বাকি। সকাল বেলা আব্বা আমাকে প্রস্তুত করার জন্য আম্মাকে তাগিদ দেন। সকাল ন’টার ট্রেনে তিনি আমায় নিয়ে চাঁদপুর শহরে যাবেন এবং ঈদের কেনাকাটা সেরে নেবেন। ট্রেন থেকে নেমে আব্বা আমায় নিয়ে শহরের নামকরা ওয়ান মিনিট রেস্টুরেন্টে ঢুকে রসগোল্লা ও সন্দেশ খাওয়ান। অতঃপর শহরের বিভিন্ন বিপণী ঘুরে তিনি পরিবারের সবার জন্য ঈদের সাজপোষাক কেনাকাটা শেষ করে এক হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে বড় খালার বাসায় যান। দুপুরের খাবার সেরে আমরা খানিকটা বিশ্রাম নিই। বিকেল চারটার ট্রেনে পুনরায় যথারীতি বাড়ি ফিরি। আমি যে তখন কতোটা রোমাঞ্চিত তা বলে শেষ করা যাবে না।

দাদির জন্য সাদা শাড়ি, আম্মার টাঙ্গাইলের শাড়ি ও স্যান্ডেল, ভাইবোনেদের জন্য আনা সাজপোষাকের একটি পর একটি প্যাকেট খুলে আম্মা পরিবারের সবাইকে দেখাচ্ছেন। ইত্যবসরে শার্ট, প্যান্টের প্যাকেট ও জুতার বাক্স ছোঁ মেরে নিয়ে আমি সোজা দাদির ঘরে। দাদির ঘরে চৌকির নিচে রাখা পুরানো দিনের ট্রাঙ্কের ভেতর আমার অমূল্য সম্পদ লুকিয়ে রাখি যাতে এখনই তা কারো নজরে না আসে। উদ্দেশ্য ঈদের দিন সকাল বেলা সুগন্ধি সাবান গায়ে মেখে গোসল সেরে নতুন পোষাক পরে সবাইকে চমকে দেবো। ভাইবোন থেকে শুরু করে বাড়ির আমার সমবয়সী ছেলেমেয়ে ও খেলার সাথিরা ঈদের সাজপোষাক কী কেনা হলো তা দেখে কৌতুহল মেটাতে চায়। আমি মৃদু হেসে বলি, এখন নয় ঈদের দিন সকাল বেলা ঈদগাহে যাবার সময় সব দেখতে পাবে।

ঈদের নতুন জামা, প্যান্ট ও জুতো পাওয়ার আনন্দে উদ্বেল হয়ে রাতে ঘুমুতে যাই। মনের মাঝে খুশির ঢেউ খেলে যায় আর ভাবি কখন ভোর হবে, কখন দাদির ঘরে সযতনে ট্রাঙ্কের ভেতর লুকিয়ে রাখা ঈদের নতুন জামা, প্যান্ট ও জুতো বের করে এনে সবাইকে চমকে দেবো।

ভোরের পাখির কিচির মিচির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ কচলাতে কচলাতে দাদির ঘরের দিকে ছুটে যাই। দাদিকে নামাজরত দেখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। নামাজ শেষ করে দাদিজান বলেন, দাদু ভাই কী ব্যাপার ভোর না হতেই তোমার আগমনের হেতু জানতে পারি কি? আমি বলি, দাদু তোমার চৌকির নিচে ট্রাঙ্কে রাখা আমার ঈদের নতুন জামা, প্যান্ট ও জুতো নিতে এসেছি। দাদিজান বলেন, ঠিক আছে আমি এখনই বের করে দিচ্ছি। তিনি উবু হয়ে চৌকির নিচে নজর দেয়া মাত্র দেখেন তাঁর বিয়েতে পাওয়া শখের ট্রাঙ্ক সেখানে নেই। ঘরের পেছন দিকের বেড়ার নিচে গর্তের মতো দেখা যায়। তিনি মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার করে বলেন, দাদুভাই সর্বনাশ হয়ে গেছে। রাতের কোন এক প্রহরে ঘরে সিঁদেল চোর ঢুকে ট্রাঙ্ক নিয়ে গেছে। এখন উপায় কী হবে!

আমি নির্বাক, নিরুত্তর। আমার স্বপ্ন, ঈদের আনন্দ সব চুরি হয়ে গেছে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়