প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৫, ১১:৫২
জলের ঊর্ধ্বমুখী জীবন

জন্মের দায় এড়িয়ে যেতে পারিনি বলে জড়বস্তুর মতো বড্ড অবহেলার মধ্যে কোনোরকম বেঁচে আছি। একজীবনে সহস্র ফুলের ঝরে যাওয়া দেখেছি। দেখেছি সবুজ পাতা এবং গাছের শাখা-প্রশাখার ফাঁকে চুপসে যাওয়া ফুলের বোবা আর্তনাদ। তেমনি নদীর জল শুকিয়ে গেলে জলজ প্রাণীদের কান্না শুনেছি। শেষ রাতে ডুবে যাওয়া তারাগুলো খুব অভিমানে নিজেদের লুকিয়ে ফেলে। আমিও শামুকের ভেতর বারবার লুকানোর চেষ্টা করেছি।
রাতের অন্ধকারে বাদুড়ের ওড়াউড়ির শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে লক্ষাধিকবার। পত্রিকার পাতা খুলতেই যখন বড় বড় অক্ষরের শিরোনামে কোনো নারীকে ধর্ষণের পর মেরে ফেলার ঘটনাপ্রবাহ চোখে পড়ে, তখন পরিবেশ-পরিস্থিতি আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু প্রকৃতির প্রতিশোধ বড্ড ভয়ানক। যারা এই কাজের সঙ্গে জড়িত, তারা দেরিতে হলেও উপযুক্ত শাস্তি অবলীলায় পেয়ে যায়। এখান থেকে বাঁচার কোনো পথ অবশিষ্ট থাকে না।
শীতের কুয়াশা ভেদ করে যখন সোনা রোদ উঁকি দেয়, তখন শরীরে খুব আরাম লাগে। সবার জীবনে রংধনুর দেখা মেলে না। আবার এমনও অনেকে আছে, যারা কখনো কল্পনার আকাশে উড়তে পারে না। সব মাটিতেই ফসল ফলে না। কিছু মাটি আছে তামাটে কয়লার মতো। যেখানে কোনো উর্বরতা নেই। সঙ্গীহারা কাক যেমন দ্বিতীয়বার জোট বাঁধে না, তেমনি কিছু মানুষের জীবনে কখনো প্রেম আসে না। অনুভূতি চুরি হয়ে গেলে মনুষ্যত্ববোধ কাজ করে না। আজ যাদের উপকার করি, কাল তারা ক্ষতি করার অপেক্ষায় থাকে।
মাঝেমধ্যে নিজেকে খুব বোরিং লাগে। তখন মনের ইচ্ছাশক্তি একদম উধাও হয়ে যায়। বসন্ত এলেই সবার জীবনে ফাগুন আসে না। এমন অনেক প্রাণী আছে, যারা জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি প্রবল কষ্টের মধ্যে পুরো জীবন কাটিয়ে দেয়। বর্ষণমুখর দিনের মতো কেউ কেউ অবিরত চোখের জলে বুক ভাসায়। শরতের সাদা মেঘের ভেলায় চোখ রেখে সব সময় অভিভূত হতে নেই। কখনো কখনো তা বিষণ্ণতার মাত্রা বাড়িয়ে দেয় মনের আকাশজুড়ে। প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতার মধ্যে যখন কেউ একান্ত সঙ্গ দেয়, তখন তাকে স্বয়ং ফেরেশতার মতো মনে হয়। নির্ঘুম রাতগুলোর যন্ত্রণা মৃত্যুর চেয়েও দুর্র্ধষ ভয়ানক। অনেক না পাওয়া যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তখন অভিশপ্ত মনে হয় মানবজীবন।
পৃথিবীর বুকে জন্ম নেওয়ার মূল উদ্দেশ্য আজও খুঁজে পাইনি। অথচ আমার দায়ভারের বোঝা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। এহেন পরিস্থিতিতে নিজেকে প্রকৃতির বোঝা বলে মনে হয়। চতুর্দিকেই প্রগাঢ় অন্ধকার দেখি। চরম হতাশার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত। কোনোভাবেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছি না। আমি কখনো নাস্তিকতায় বিশ্বাসী নই। ঈশ্বরের প্রতি প্রবলভাবে আস্তিক। সে জন্য ধর্ম নিয়ে আমার বাড়াবাড়ি নেই। ইসলাম ধর্মের অনুসারী হলেও সব ধর্মের প্রতি সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু ধর্মের নামে গোঁড়ামি কখনোই ভালো চোখে দেখি না। পৃথিবীর সব ধর্মই মানুষকে সুপথে পরিচালিত করে। কিন্তু মানবজাতি তার উল্টোটা করে বসে থাকে। অধিকাংশ মানুষ স্বার্থ হাসিলের জন্য সদা তৎপর থাকে। অথচ এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। ক্ষণিকের জন্য পৃথিবীতে এসে কোনো অন্যায় কাজে না জড়ানোই উত্তম হিসেবে বিবেচ্য বিষয়।
আজকাল মানুষকে বিশ্বাস করাটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রায় সব মানুষ কমবেশি বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে তৎপর থাকে। কারও গোপনীয় বিষয় কেউ নিজের মধ্যে আটকে রাখতে পারে না। অন্যের গিবত করতে তাদের মুখে আদৌ বাধে না। আজকাল মানুষ হয়ে পড়েছে সবচেয়ে হিংস্র প্রাণী। এই মানুষরূপী হিংস্র প্রাণীর হাত থেকে বেঁচে থাকাটা ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। মৃত্যুর কথা চিন্তা করে না কেউ। অথচ মৃত্যু খুব নিকটে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ু ফুরিয়ে গেলেই লাশ হয়ে কবরে প্রবেশ করবে। মানুষকে ভালোবাসতে গিয়ে জীবনে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি। হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি মানুষ কতটা নিষ্ঠুর। জন্মের পর থেকে ক্রমাগত মৃত্যুর পথেই হাঁটছি। কখনো স্থির থাকার অবকাশ খুঁজে পাইনি। জানি না কতটা আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি! কখনো ভালো কাজ করেছি কি না, তা–ও জানি না। পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে অবিরাম বয়ে বেড়াচ্ছি।
এতটুকু জীবনে সুখী হওয়ার কোনো মন্ত্র খুঁজে পাইনি, যা পেয়েছি তা সীমাহীন কষ্টের যন্ত্রণা। লোহাকে কয়লার আগুনে পুড়িয়ে যেমন বিভিন্ন উপকরণ বানানো হয়, তেমনি আমিও প্রতিনিয়ত জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছি। একজীবনে এতটা কষ্টের দায়ে কাউকে অভিযুক্ত করতে পারিনি। সর্বক্ষণ মনে হয়েছে, আমার অক্ষমতা থেকে সব কষ্ট পেয়েছি। এখনো কোনো কাজে নিজেকে ঠিকভাবে মেলে ধরতে পারিনি। যে কাজেই হাত দিই, সেখানেই ব্যর্থতার হাতছানি আলিঙ্গনে ডুবিয়ে রাখে। কোনো সুসংবাদ বা সফলতার দেখা আজ অবধি পাইনি। বেঁচে থাকাটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। ভেবে উঠতে পারি না, আমার এখন কী করা উচিত!
পরিস্থিতি সামাল দিতে দিতে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কোনো কিছু আঁকড়ে ধরে টিকে থাকতে পারছি না। বুকের ভেতর অথই জ্বালাপোড়া সতত বেড়েই চলেছে। চোখের পাতায় কোনো ঘুম নেই। হাসতে ভুলে গেছি পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে ওঠার আগেই। সারাক্ষণ মানসিক চাপ ও হতাশার মধ্যে অবস্থান করছি। এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায়ান্তর খুঁজে পাচ্ছি না। জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্নগুলো ফ্যাকাশে মলিন হয়ে গেছে। প্রাপ্তির খাতায় কোনো সফলতা নেই, যা আছে তা শুধু মরীচিকার বীভৎস আস্ফালন। মাঝেমধ্যে চিৎকার দিয়ে কান্না করতে ইচ্ছা করে। সেটাও করতে পারি না। পৃথিবীর বুকে আমাকে বোঝার মতো মানবিক মানুষ খুঁজে পাইনি। কেউ আমার সঙ্গী হতে কখনো আগ্রহ বোধ করেনি। আজকাল নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়। মনে হয় পৃথিবীতে জন্ম নেওয়াটা সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। যদি তাই না হবে, তাহলে জীবনটা এত কঠিন হতো না।
হাঁপিয়ে গেয়েছি বিস্তীর্ণ বন্ধুর পথে একাকী হাঁটতে হাঁটতে। এমন একটা জীবন নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি, যার কোনো পরিবর্তন নেই। একভাবেই পেরিয়ে যাচ্ছে জীবন নামের রেলগাড়ি। আঁধারে ঢেকে গেছে জীববৈচিত্র্যের চারপাশ। ঝলমলে আলোর অনুপ্রবেশ নেই এখানে। করুণ মৃত্যুর আহাজারি খুব কাছ থেকে শুনতে পাই। দেখতে পাই রক্তাক্ত গোলাপের কাঁটা। হাসপাতালে পড়ে থাকা অসুস্থ রোগীর অন্তিমযাত্রার প্রাক্কালের মতো মৃত্যুর প্রহর গুনে চলেছি। কেউ এগিয়ে আসেনি সাহস জোগাতে। বাঁকা চোখে সবাই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখেছে। যাকেই আপন ভাবতে গিয়েছি, সবাই আঘাত দিয়েছে। আমার প্রতি কখনো কাউকে মানবিক হতে দেখেনি। জীবনে কারও ক্ষতি করা তো দূরের কথা, কখনো কারও খারাপ চাইনি। সবাইকে সমান চোখে দেখেছি।
মানুষ হিসেবে কতটা মানানসই জানি না৷ তবে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য কখনো চেষ্টার ত্রুটি করিনি। তবু অমানুষ থেকে গেলাম কারও কাছে। এত শত অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত আমি। বিনিময়ে পেতে ইচ্ছুক যাবতীয় শাস্তি। এরপরেও আমি মানুষ হতে চাই। মানবিক মানুষ। প্রয়োজনে ভুলের পথ ধরে হেঁটে যাব গন্তব্যহীন জলের ঊর্ধ্বমুখী জীবনের গতিপথে। তখন মুক্তির গান গেয়ে হাসিমুখে বিদায় নেব কল্লোলিত নদীর বুকে মাথা রেখে এক চিলতে কোমল নমনীয়তায়।
আহা রে জীবন, তুই বড়ই অদ্ভুত! তোর নেই কোনো সুবিচার। কেবল কষ্টের আগুনে সারা জীবন আমাকে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিলি। হেরে গেলাম তোর কাছে। কোনো আত্মসংযম কাজে এল না। সব না পাওয়ার আক্ষেপ আমাকে কুরে কুরে নিঃশেষ করে দিয়েছে। বেঁচে থাকার মতো পরিবেশ কোনো দিন পাইনি। জন্ম থেকেই কষ্টের গ্লানি টেনে মৃত্যুর দিকে ক্রমাগত ধাবিত হচ্ছি। এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার উপায়ান্তর নেই। কেবল হতাশা আর আক্ষেপ নিয়েই একটা জীবন অতিবাহিত হয়ে গেল। কিছুই করতে পারলাম না। কেবল অন্ধকারেই থেকে গেলাম। কেউ আমার দিকে কখনো ফিরেও তাকায়নি। বাড়িয়ে দেয়নি ভালোবাসার হাত। কেউ বুকে টেনে নেয়নি পরম মমতায়। আলিঙ্গনে জড়ায়নি রোমাঞ্চকতার মায়াজালে। ভালোবাসা এবং সুখ তুমি কত দূর, তুমি কত দূর!