রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৩৯

লাল পাহাড়ের দেশে রাঙ্গামাটি ভ্রমণ

লিখন সরকার
লাল পাহাড়ের দেশে রাঙ্গামাটি ভ্রমণ

মাহামুদা আক্তার একজন চা ও কফিপ্রিয় মানুষ। চা কিংবা কফির প্রতি নেশা আর ভালোবাসা সবসময়ই আগলে রয়েছেন তিনি। তাই এবারের পিকনিক আয়োজনে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে চাপাতা, কফি, চিনি, দুধ ও চায়ের কাপ নিয়ে নিয়েছেন মাহামুদা ভাবি। যেন চা-কফি খাওয়া নিয়ে কোথায়ও কোনোভাবে বিপাকে পড়তে না হয় থাকে! বলা যায়, কয়েকদিন ভাত না খেলেও চলবে, কিন্তু চা? চা-কফি কিন্তু অবশ্যই চাই! এক কথায় চা-কফি ছাড়া মানুষটি চলতেই পারেন না। বাসায় নিয়ম মেনেই প্রতিবেলায় চলে দুধ কপি ও চা পান! বাজারের প্রথম লিস্টেই থাকে চা পাতা, চিনি, কফি আর দুধের নাম। তাই সবসময়ই একরকম চায়ের আড্ডায় মেতে থাকেন মাহামুদা ভাবি। আরেকটুখানিক বলি, তারপরই যাবো লাল পাহাড়ের দেশ রাঙ্গামাটির গল্পে।

মাহমুদা ভাবির বাসা চাঁদপুর শহরের তরপুরচণ্ডীতে। যারা ওনার প্রতিবেশী বা কাছের সঙ্গী তারা অবশ্যই জানেন মাহামুদা ভাবির ‘এক কাপ চা কিংবা কফি’ কতখানি প্রিয়। হাসিখুশি থাকা, চঞ্চল ও বাঁধভাঙ্গা উল্লাস আর সাফল্যের আনন্দে থাকা চা ও কফিপ্রিয় এই মানুষটি এবার আমাদের সাথেই যাচ্ছেন লাল পাহাড়ের দেশ- ‘রাঙ্গামাটি’।

রাঙ্গামাটি প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্যের আধার। নীল জলরাশি, লাল ও সবুজ পাহাড়, শান্ত প্রকৃতির ছোঁয়া। রাঙ্গামাটি এমনই একটি জায়গা, যেখানে হৃদয় মিলে যায় প্রকৃতির সাথে। কাপ্তাই লেকের নৌকাভ্রমণ, পাহাড়ি পথের রোমাঞ্চ, শুভলং ঝর্ণার মনোমুগ্ধকর জল আর স্থানীয় আদিবাসী সংস্কৃতির বৈচিত্র্যÑসবকিছু মিলে এটি এক কথায় স্বপ্নের মতো। এমন নান্দনিক ও অপরূপ সৌন্দর্যের শহর রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে আমরা রওনা হলাম ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ মধ্যরাতে ‘পদ্মা এক্সপ্রেসে’ ফরিদগঞ্জ কালিরবাজার চৌরাস্তা থেকে ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর ও হাইমচরের একঝাঁক ভ্রমণপ্রিয়, প্রকৃতিপ্রেমী ও চাপ্রেমি মানুষদের নিয়ে।

ভোর ৫:২৫ মিনিটে রাঙ্গামাটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশেই থামলো পদ্মা এক্সপ্রেস। বাস থেকে নেমেই সবাই সবার মতো করে এদিক-সেদিক ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। সকাল হতেই আমরা কয়েকজন কাপ্তাই লেকে ফ্রেশ হয়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ট্রলারে করে খাবারের উদ্দেশ্য রওনা হলাম। কী চমৎকার বিশাল এই কাপ্তাই লেক! কী অসাধারণ এখানকার পাহাড়, বৃক্ষ, মাটি, জলÑযেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা এই রাঙ্গামাটি শহর!

দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় হ্রদ বাংলাদেশের কাপ্তাই লেক। মাত্র অর্ধশতাব্দী আগেও রাঙ্গামাটি জেলায় এই হ্রদের কোনো অস্তিত্বই ছিলো না। তবে মনুষ্যসৃষ্ট এই কৃত্রিম হ্রদটি দেখতে প্রতিদিনই দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসছে হাজার হাজার পর্যটক ও দর্শনার্থী।

রাঙ্গামাটি চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনে। এই জেলাটি আয়তনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জেলা। রাঙ্গামাটি বাংলাদেশের একমাত্র জেলা যার সাথে ভারত ও মায়ানমার দুটি দেশেরই আন্তর্জাতিক সীমা রয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আদিবাসীদেরও বসবাস। প্রাচীনকাল থেকেই চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, পাংফুয়াসহ বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জীবনচিত্র বর্ণে। রাঙ্গামাটি জেলার পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে মূলত ‘কাপ্তাই লেক’কে ঘিরে। কাপ্তাই শুধু বাংলাদেশেরই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় হ্রদ। কৃত্রিম এ হ্রদটির আয়তন প্রায় ২ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি। সমগ্র রাঙ্গামাটি জেলাজুড়েই এই জলধারা বিশ্রিত, যার অন্তর্ভুক্ত উপজেলা সম্ভব হলো রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, বরকল, নানিয়ারচর, লংগদু, জুরাছড়ি, বাঘাইছড়ি ও বিলাইছড়ি। কর্ণফুলী নদীর জল দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য তৎকালীন ইংরেজ সরকার ১৯০৬ সালে সর্বপ্রথম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই করেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে আমেরিকার অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করেন এবং ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ করেন। তবে ১৯৫৬ সালে যখন কর্ণফুলী নদীর উপর কাপ্তাই বাদ নির্মাণ করা হয় তার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ৩৬৯ মৌজার মধ্যে ১২৫টি মৌজা জলের নিচে চলে যায় তখনি রাঙ্গামাটি শহরের অধিকাংশ অঞ্চলসহ প্রায় ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি জলের নিচে ডুবে যায়। বাদ নির্মাণের পূর্বে মাত্র ২৫০ বর্গমাইল এলাকা ডুবে যাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হলেও বাদ নির্মাণ শেষে ৩৫০ বর্গমাইল ডুবে যায়। এছাড়া মোট কৃষি জমির ৪০ শতাংশ সরকারিভাবে সংরক্ষিত বনের ২৯ বর্গমাইল এলাকা ও অশ্রেণিভুক্ত ২৩৪ বর্গমাইল বনাঞ্চল জলেতেই ডুবে যায়। প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের ১ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। তবে ১৯৭০ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয় কর্ণফুলী প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করা হলেও পাকিস্তান সরকার মাত্র ২.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেন। বর্তমানে কাপ্তাই লেক রাঙ্গামাটি জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। কাপ্তাই লেক থেকে প্রতি বছরে ৭ হাজার টনেরও বেশি মাছ উৎপাদন করা হয়। কিন্তু গবেষকরা মনে করেন আনুমানিক ৯০ বছর পর হ্রদটির তলদেশে পলি পাথরের আস্তরণ জমে সম্পন্ন লেকটি মাছ চাষের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। তবে কাপ্তাই লেকের মাধ্যমে রাঙ্গামাটিজুড়ে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও দীর্ঘ জলপথের সৃষ্টি হয়েছে। এই হ্রদ সৃষ্টির পূর্বে যে সব স্থানে পাহাড়ি পথে পায়ে হেঁটে যেতে একদিনের বেশি সময় লেগে যেতো। সেখানে এখন মাত্র কয়েক ঘণ্টা লাগে স্প্রিডবোট, নৌকা বা লঞ্চ নিয়ে যেতে। এছাড়া সমগ্র হ্রদটি নৌবিহারের জন্যই পর্যটকদের কাছে একটি আর্কষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। যেতে যেতে একটি দ্বীপে গিয়ে থামলো আমাদের ট্রলারটি। কাপ্তাই লেকজুড়ে এ রকম বেশ কিছু ছোট-বড় দ্বীপ রয়েছে। সেসব স্থানে স্থানীয় লোকজন ও আদিবাসীদের রেস্টুরেন্টে ও বিভিন্ন দোকান রয়েছে। আমরা ট্রলার থেকে নেমেই চলে যাই ছাং পাং রেস্টুরেন্টে। খুবই চমৎকার ও অসাধারণ একটি স্থানে ছাং পাং রেস্টুরেন্টটি। খাবারের পর্ব শেষ করে এবার রওনা হলাম শুভলং ঝর্ণার উদ্দেশ্য।

শুভলং ঝর্ণা রাঙ্গামাটি সদর হতে শুভলং ঝর্ণার দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। শুকনো মৌসুমে শুভলং ঝর্ণায় খুবই সামান্য পরিমাণে জল থাকে। আমরা বেশকিছু সময় কাটিয়েছি এমন অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে। শুভলং ঝর্ণার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের সর্বদাই বিমোহিত করে তোলে। আমরা শুভলং ঝর্ণার শীতল জলে শরীরকে ভিজিয়ে নিলাম মনের বাঁধভাঙা আনন্দ আর উল্লাসে। এই ঝর্ণার জলধারা প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে নিচে আঁচড়ে পড়ে কাপ্তাই হ্রদের জলে! এমন সৌন্দর্যময় দৃশ্যগুলোকে স্মৃতি হিসেবে রাখতে আমরা কেউ ফটোগ্রাফি, কেউ বা টিকটক ও ইউটিউব ভিডিও করতে লাগলাম। সৃষ্টিকর্তার সাজানো প্রকৃতির এমন সৌন্দর্য আমরা উপভোগ করলেও আমাদের ভ্রমণসঙ্গী মনির ভাই দীর্ঘ এই লম্বা যাত্রায় অনেকটা অসুস্থ হয়েই পড়েন। শুভলং ঝর্ণায় অনেকটা সময় কাটানোর পর এবার আমরা রওনা হলাম আদিবাসী গ্রামের উদ্দেশ্যে।

রিংকি চাকমা বৌদ্ধ সম্পাদয়ের এক আদিবাসী তরুণী। আদিবাসী গ্রামের একজন পোশাক বিক্রেতা। এখানে অধিকাংশ নারীই দোকানদারি করেন। রিংকি চাকমার বিক্রির কৌশলটা বেশ ভালোই লেগেছিলো আমাদের কাছে! আমার মনে হচ্ছে রিংকি চাকমা আমাদের কাছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার বিভিন্ন পণ্যই বিক্রয় করেছেন! তার মধ্যে বিছানার চাদরের সংখ্যাটাই ছিলো বেশি। তবুও একটু পরপরই হাসি দিয়েই বলেন ‘লন লন, দশ টাকা লাভ হবে-বিশ টাকা লাভ হবে!’ যেন সবকিছুতেই তিনি একেবারেই মুখস্থ করে নিয়েছেন দশ টাকা-বিশ টাকার কথা। এর উপরে আর কোনো লাভেই হবে না! বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পর্যটকদের কাছে এখানকার আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে আদিবাসী গ্রামের পোশাক, আচার ও ফলের দোকানগুলো। রিংকি চাকমার হাসি উজ্জ্বল লাবণ্যময় মুখটা বারবারই স্বপ্নের মতো দোলা দিয়ে যাচ্ছিলো আমাদের আরো একজন ভ্রমণসঙ্গী জয় সরকারের মনে! মনে হয়, আগের জন্মে জয়-রিংকি চাকমাকে ফেলে এসেছিলেন পাহাড়ের কোন এক গুহাতে! কারণ জয় কাপ্তাই লেকে এসেই শুরু করে দিয়েছে ‘গুহা’ খুঁজতে! গুহার বিষয়টা ভিন্নশব্দ ব্যবহার করে তা নিশ্চিত করেছেন আমাদের তাজু স্যার ‘জয় এখন গুহাতে আছে!’ আমরা সবাই সৃষ্টিকর্তার কৃপায় সুন্দর ও আনন্দময় জীবন নিয়ে নিজ গন্তব্যে ফিরে আসলেও জয় এখন দুইদিনে ট্যুরে প্যাকেজ খুঁজতেছেন রাঙ্গামাটিতে যাওয়ার জন্যে। শুধুমাত্র রিংকি চাকমার টানে!

আদিবাসী গ্রামের আরো দুই তরুণী রুপনা চাকমা ও আরশি ত্রিপুরা দুজনেই খুব ভালো বন্ধু। পড়াশোনা করছেন রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে। রাঙ্গামাটি শহরেই থাকেন দুজনে। বিশেষ কোনো ছুটি অথবা শুক্র ও শনিবার হলেই চলে আসেন নিজ গ্রামে। তবে, তেমন একটা থাকা হয় না তাদের গ্রামে। গ্রামে আসলেই মায়ের দোকানে কিছুটা সময় দেন রুপনা চাকমা। রুপনা চাকমা ও আরশি ত্রিপুরা দুজনে খুবই বুদ্ধিমান ও চতুর! ওদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর বুঝলাম ওরা আসলেই খুব বন্ধুসুলভ, খুব সহজেই বন্ধুতো গড়ে তোলতে পেরেছেন আমাদের সাথে। বেশ মিষ্টিমুখ দুজনের। রিংকি চাকমা ও তার আশপাশে থাকা দোকানগুলো থেকে সবাই কেনাকাটা করলেও আমি বেশকিছু জিনিস রুপনা চাকমার মায়ের দোকান থেকেই কিনেছি। তার মধ্যে আমার পছন্দের একটি পোশাক হলো ‘থামি’। আমার সহধর্মিণীর জন্যে নিয়েছি। ‘থামি’ হচ্ছে মূলতো আদিবাসী নারীদের নিজস্ব একটি ঐতিহ্যবাহী পোশাক। চাকমা, মগ বা মারমা, ত্রিপুরা মেয়েরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে যে পোশাক পরে তা ‘থামি’ বা ‘পিনন’ নামে পরিচিত। এই থামি এখন অনেকেই পছন্দ করছেন এছাড়াও আদিবাসীদের পোশাকের সঙ্গে আধুনিকতার মিশেলে ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ হচ্ছে বাঙালি ফ্যাশন। যেহেতু আমি নাচ করি-শাস্ত্রীয় নৃত্য। তাই পাহাড়ি নৃত্যের জন্যে এই ধরনের পোশাক সত্যি খুবই চমৎকার। সেই চিন্তা থেকেই মূলত ‘থামি’টি কিনেছি। মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বললাম, তাহলে-চলে যাচ্ছি! একপলকে রুপনা চাকমা বলে উঠলো, ‘আবার আসবেন’ আর আরশি ত্রিপুরা বলে উঠলেন, অপেক্ষায় আছি!

কিছুপথ এগিয়ে আসতেই আরিফের সাথে দেখা। আরিফকে নিয়ে আরো একবার গেলাম রুপনা চাকমার মায়ের দোকানে। সেই দোকান থেকে আরো কিছু কেনাকাটা করলাম দুই বন্ধু মিলে। ততক্ষণে ওরা দুজনে রওনা দিয়েছেন বৌদ্ধ মন্দিরে উদ্দেশ্যে। কিছুসময় কথা বললাম রুপনা চাকমার মায়ের সাথে। আন্টি, সত্যিই অনেক ভালো মনের একজন মানুষ। আমাকে ও আরিফকে কয়েকবারই নিমন্ত্রণ করেছেন দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্যে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। কিছুক্ষণ পরই আমাদের পুরো টিম রওনা দিবে খাবারের উদ্দেশ্য। আর সেখানে তো আমাদেরকেও থাকতে হবে।

বিকেল সাড়ে চারটায় আমরা এসে পোঁছালাম বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি রাঙ্গামাটির ‘ঝুলন্ত ব্রিজে’। রাঙ্গামাটি ভ্রমণ করতে এসে কেউ ‘ঝুলন্ত ব্রিজ’ দেখবেন না তা কি কখনো হতে পারে! কাপ্তাই হ্রদের উপর নির্মিত ৩৩৫ ফুট লম্বা এই ব্রিজটি সবার কাছে ‘সিম্বল অব রাঙ্গামাটি’ নামে পরিচিত। সবসময়ই এখানে পর্যটকদের ভিড় জমে থাকে। ব্রিজ থেকে ওপারে গিয়ে উঠলাম। সেখানেও বেশকিছু দোকানপাট রয়েছে। আমরা কয়েকজন ‘আনারস’ কিনে খেলাম। পাহাড়ি আনারসগুলো অনেক মিষ্টি। পরিবেশটাও বেশ ভালোই ছিলো। কিন্তু এখানে জিনিসপত্রে দামটা একটু বেশি ছিলো। ছবির মতোই সুন্দর ছিলো এখানকার সমস্ত দৃশ্যগুলো। অল্পকিছু সময় কাটিয়ে এবার আমরা রওনা হলাম রাঙ্গামাটির আরো একটি চমৎকার স্থান ‘পলওয়েল’ পার্কে। যাবার সময় ট্রলারে ছাদে পাহাড়ি গানের সাথে কয়েকজন নাচ করলেও মণি কিশোর কাকার নাচটাই খুব সুন্দর ছিলো আমাদের কাছে। শ্রী মণি কিশোর চক্রবর্তী জেটিআইতে কর্মজীবনের পাশাপাশি তিনি এখন ‘টিকটক’ ও ‘ফেসবুক পেজ’ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। বিনোদন-প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণপ্রিয় এই মানুষটি রাঙ্গামাটির বেশ কিছু স্থানের ভিডিও সংগ্রহ করে রেখেছেন। পরবর্তীতে পেজে পোস্ট করার জন্যে। ভিডিওতে বেশকিছু ‘স্টার’ জমা পড়েছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই তিনি ভালো কিছুর সাফল্যটা অর্জন করবেন।

পলওয়েল পার্ক প্রায় তিন দশক আগে ১৯৯৫ সালে শহরের ডিসি বাংলোর পাশে গড়ে তোলা হয়। প্রথমে তেমন একটা সাফল্যের ছোঁয়া না পেলেও এখন খুবই জমজমাট। পাহাড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এই জায়গাটি দীর্ঘদিন পর্যটক স্পট হিসেবে তেমন একটা পরিচিত লাভ করতে না পারলেও সদ্যবিদায়ী রাঙ্গামাটি জেলার পুলিশ সুপার আলমগীর কবিরের সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনায় ২০১৮ সাল থেকেই বদলে যায় পুরো ‘পলওয়েল পার্কে’র দৃশ্য। বৈচিত্র্যময় ও নান্দনিক নির্মাণ-শৈলী পার্কে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। কৃত্রিম ঝর্ণা, কলসি ঝর্ণা, গ্রাম বাংলার নান্দনিক ভাস্কর্য দেখে যেন চোখ জুড়িয়ে গেল।

লাভ পয়েন্ট বাংলাদেশের প্রথম ভালোবাসার প্রতীক! ‘লাভ পয়েন্ট’ নিয়ে রয়েছে একটি করুণ ইতিহাস। সেই বিষয়ে এখন যাচ্ছি না। আমরা ছোট ঝুলন্ত ব্রিজ ও ক্যাফেটেরিয়াতে কিছু সময় কাটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসলাম মেইন রাস্তায়।

সন্ধ্যা ৭টায় রাঙ্গামাটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে রওনা দিলাম কুমিল্লায়। ক্লান্ত শরীর, চোখে ঘুম ঘুম, পদ্মা এক্সপ্রেসের সিটেই শুয়ে পড়লাম কিছুক্ষণের জন্যে। পথ চলতে চলতেই হঠাৎ রাস্তার পাশে থমকে দাঁড়ায় আমাদের বাসটি! যান্ত্রিক সমস্যার সৃষ্টির কারণে অনেকটা সময় পথেই দেরি হয়ে যায় আমাদের। খুব বিরক্তিকর লাগছিলো তখন। আর ভালো লাগছিলো না, কখন যে কুমিল্লাতে গিয়ে পোঁছাবো। রাতের ডিনার ‘কাবাব এক্সপ্রেসে’ অর্ডার করা ছিলো।

কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামে অবস্থিত কাবাব এক্সপ্রেস একটি আধুনিক রেস্টুরেন্ট। লতা-পাতা বাহারি গাছ আর ফুলে ফুলে ভরা কাবাব এক্সপ্রেসের সৌন্দর্য। নানান ধরনের বৃক্ষ ও বাঁশের নান্দনিক জারবাতি, লাল-নীল-হলুদ লণ্ঠন। রাতের অন্ধকারে যতটুকু দেখেছি, ততটুকুই ভালো লেগেছিলো এখানকার মনোমুগ্ধকর দৃশ্যগুলো।

রাত ২টায় আমরা এসে পোঁছালাম কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম ‘কাবাব এক্সপ্রেস রেস্টুরেন্টে’। এই শীতে দীর্ঘ সময় নিয়েই আমাদের জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন কাবাব এক্সপ্রেসের ওয়েটাররা। কুমিল্লাতে তখন ভীষণ শীত পড়ছিলো। কষ্ট হলেও যে তারা আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন তার জন্যে কিছুটা হলেও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতেই হচ্ছে। রাতের ডিনার শেষ করে কিছুটা সময় কাটালাম একটু এদিক-সেদিক ঘুরে দেখার জন্যে। অন্ধকারে বিভিন্ন রঙের বাতি ও নান্দনিক লণ্ঠনের আলোতে যতটুকু সম্ভব দেখেছি। তারপর আবারও উঠে বসলাম পদ্মা এক্সপ্রেস বাসটিতে।

কল্পনার এক ভিন্ন জগতে চলে গেলাম কিছুক্ষণের জন্যে। এবার মনে হচ্ছে, শীত গায়ে লাগছে! পুরো রাঙ্গামাটির শহর ঘুরেও শীত তেমন একটা অনুভব না করতে পারলেও কুমিল্লাতে এসে শীতের হাওয়াটা অবশ্যই গায়ে বেঁধেছে। চুপটি করে বসে রইলাম আরো বেশকিছু সময় নিজ গন্তব্যে ফেরার অপেক্ষা নিয়ে।

ততোক্ষণে কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম থেকে ফেনী ও লক্ষ্মীপুর হয়ে ফরিদগঞ্জে এসে থামলো আমাদের বাসটি। আমরা যারা ফরিদগঞ্জের ছিলাম তারা সবাই ফরিদগঞ্জেই নেমে পড়লাম। ভোর চারটা বাজে তখন। বাস থেকে নেমেই বিদায় নিয়ে আমাদের প্রথম ও দ্বিতীয় বাসটি রওনা দিলো চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে। পদ্মা এক্সপ্রেসে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা থেকে অবশেষে মুক্তি পেলাম। তারপর আমাদের সুবিধা অনুযায়ী একে-অপরের কাছে থেকে বিদায়ই নিয়ে রওনা হলাম নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

এই যে আমাদের এই রাঙ্গামাটি ভ্রমণ। পাহাড়ি পথে দল বেঁধে হাঁটার অনুভূতি! কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্য, শুভলং ঝর্ণার শরীর জুড়ানো শীতল জল, আদিবাসী গ্রামের কেনাকাটার বাহিরেও আনন্দ, খুশি ও দুষ্টুমির বিশেষ বিশেষ কিছু মুহূর্ত, ট্রলারের ছাদে নাচ-কাপ্তাই লেকে ট্রলারে বসে গানের সুর তোলা, প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য নিয়ে ক্যামেরাবন্দি, পলওয়েল পার্কের মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং কুমিল্লার কাবাব এক্সপ্রেসের সৌন্দর্য এই সবকিছুই এখন আমাদের কাছে আনন্দমুখর অনুভূতি আর স্মৃতি। এই ভ্রমণে আমাদের অনেকেরই অনেক ধরনের অনুভূতি ও আনন্দময় মুহূর্তের স্মৃতিগুলো প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত হয়ে থাকবে! সেই সকল অনুভূতি ও স্মৃতিগুলো নিয়ে আগামীর পথচলা আরো সুন্দর ও শুভ হোক সেই প্রত্যাশা করছি। ভালো থাকুক, সকল ভ্রমণ পিপাসুর মন। প্রস্তুতি নেওয়া হোক পরবর্তী ট্যুরÑপৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ‘কক্সবাজার’ যাওয়ার জন্যে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়