শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৫৮

প্রিয়জন কিংবা প্রিয় ঠিকানা

তানভীর হাসান
প্রিয়জন কিংবা প্রিয় ঠিকানা

জানালার পর্দা তুলে আকাশের দিকে তাকাতেই হতভম্ব। এত সুন্দর আকাশও কি হতে পারে! গাঢ় নীল আকাশে আবছা সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। ঠিক যেন ভূমধ্যসাগরীয় কোনো অঞ্চলে এই মুহূর্তে অবস্থান করছি।

 

বিছানায় গা এলিয়ে ঘড়ির কঁাটার দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল ১০টা ৪২ মিনিট। আজ শুক্রবার। তাই অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই। গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে ব্যালকনিতে এসে দঁাড়ালাম। একটা পাখি ছোটাছুটি করছে। অশান্ত পাখিটিকে দেখে বড্ড মায়া হলো। প্রিয়জন হারিয়ে মানুষ যেভাবে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে, পাখিটির ঠিক একই দশা। হয়তো সেও হারিয়েছে কোনো প্রিয়জন কিংবা প্রিয় ঠিকানা।

 

আচ্ছা, পাখিরাও কি প্রিয়জন হারায়? তারাও কি প্রিয়জনের শূন্যতায় কঁাদে! হয়তো কঁাদে, আবার কঁাদে না।

 

ব্যালকনিতে নীরার ছোট্ট বাগানে গড়ে তোলা মানিপ্ল্যান্ট, লাকি ব্যাম্বো, পিস লিলি আর অর্কিড গাছগুলো বেমালুম বেড়ে উঠেছে। কতকাল যত্ন করা হয় না। অযত্নে আর অনাদরে পড়ে আছে গাছগুলো। এগুলো নীরার ভীষণ পছন্দের। আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে নীরাকে হুমায়ূন আহমেদের বই ‘তোমাকে’, ‘তেতুল বনে জোছনা’ আর ‘ময়ূরাক্ষী’এবং এই গাছগুলো উপহার দিয়েছিলাম। বই আর গাছ পেয়ে তার সেকি আনন্দ! নীরা প্রতিদিন সকালে গাছ ছেঁটে দেয়, গাছে পানি দেয়। ব্যালকনিটা কিছুদিনের মধ্যে সবুজ প্রাণে ভরে ওঠে। প্রতিদিন ভোরে পাখিদের কিচিরমিচির, ফুলের ঘ্রাণ পুরো বাড়িটাকে অন্য রকম রাঙিয়ে দিত। মৃতপ্রায় বাড়িটি কিছুদিনের মধ্যে সজীবতায় ভরে উঠল।

 

নীরা আমার স্ত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়তাম। পরিচয় হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কুয়াশা উৎসবে। আমি, লিলু, জয়ন্ত, অভি, হৃদি কলাভবনের সামনে দঁাড়িয়ে গল্প করছিলাম। উৎসব শুরু হয়েছে আরও আগেই। চারদিকে সবাই উৎসবে মাতোয়ারা। শাড়ি, পাঞ্জাবি আর বাঙ্গালিয়ানা পোশাকে সেজে সবাই হাজির। কিছুক্ষণ পর আমাদের দলে যোগ দিল আরও দুজন। অর্পিতা ও তার রুমমেট। অর্পিতা আমাদের সঙ্গে তার রুমমেটকে পরিচয় করিয়ে দিল।

-এই হলো নীরা। ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে আমাদের সেশনেই পড়ে। আমার রুমমেট। খুব ভদ্র মেয়ে।

সবাই হাসিমুখে নীরাকে অভ্যর্থনা জানাই।

সেদিন থেকে আমাদের পরিচয়। ধীরে ধীরে সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপর প্রণয় এবং সেখান থেকে পরিণয়। গ্র্যাজুয়েশনের পরপরই পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয় আমাদের।

মিরপুর-১-এ আম্মা আমি আর নীরা থাকি। তিনজনের সংসার। আম্মারও বৃদ্ধ বয়সে নীরার সঙ্গে খুব ভালো সময় কাটে। বউ-শাশুড়ি সারা দিন খুনসুটিতে মেতে থাকে। ব্যাপারটা খুব ভালো লাগে, ভীষণ উপভোগ করি। বিচ্ছেদ, বউ-শাশুড়ি কলহ, পারিবারিক দ্বন্দ্বের এই সময়ে নীরার আর আম্মার সম্পর্কটা দেখে অবাক যাই। সে যেন আম্মার এত দিনের মেয়ের অভাব পূরণ করেছে। আম্মার সবকিছু খেয়াল নীরা রাখে; খাবার, গোসলের পানি গরম করে দেওয়া, বিকেলে আম্মাকে নিয়ে হঁাটতে বের হওয়াÑসবকিছুই। চাকরির ফঁাকে আমি তেমন সুযোগ পাই না। সপ্তাহে একদিন ছুটির দিনে তাদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটে। কতবার আম্মাকে বলেছি, একটা কাজের লোক রাখি। কিন্তু তিনি কাজের লোক রাখতে দেবেন না। বউয়ের খুব কাছাকাছি মৃত্যুর আগপর্যন্ত থাকতে চায়, কাজের লোক রাখলে নাকি মধ্যেখানে দেয়াল তৈরি হয়ে যাবে। তিনি চান না, বউ-শাশুড়ির মধ্যেখানে দেয়াল তৈরি হোক। আম্মার এসব কথায় নীরা মুচকি হাসে।

 

অফিস থেকে বাসায় ফিরতেই আম্মা আমার রুমে আসেন। এসেই বউয়ের ভূয়সী প্রশংসা শুরু করে দেন।

-জানিস ইমন, আজকে নীরুমা আমায় কোথায় নিয়ে গিয়েছিল? সে আমায় অনেক দূরে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল। তুই তো আমাদের কোথাও নিয়ে যাস না। শুধু ব্যস্ততা।

-হয়েছে আম্মা, তোমার বউ থাকতে আমাকে লাগবে কেন! আমার তো শুক্রবার ছাড়া ছুটি নেই জানো, তবু তোমার আবদার।

 

এ ছাড়া আমার আর বলার মতো কিছু থাকে না। অফিসের কাজের চাপে নীরাকেও সময় দিতে পারি না, আম্মাকেও না। অবশ্য এ নিয়ে নীরার কোনো আক্ষেপ কিংবা অনুযোগ নেই। আম্মা মাঝেমধ্যে একটু শিশুসুলভ আচরণ করেন। মানুষ বৃদ্ধ হলে আবার শৈশবে ফিরে যায়।

একদিন দুপুরবেলা, অফিসে লাঞ্চ ব্রেক। খেতে যাব, ঠিক তখনই আম্মার ফোনকল।

-ইমন, তুই তাড়াতাড়ি বাসায় আয় বাবা। নীরুমার শরীর ভালো না।

 

কলটা কেটে খাবার টেবিলে রেখেই দৌড়ে অফিস থেকে বের হয়ে গেলাম। নীরাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে আমি তার মাথার কাছে বসে আছি। সে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে শুয়ে আছে। হাসপাতালে পেঁৗছার সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন। আমার ভীষণ অস্থিরতা। ঠঁায় দঁাড়িয়ে থাকতে পারছি না। কিছুক্ষণ পর একজন ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে এলেন। বললেন, ‘আপনার স্ত্রীর অবস্থা বেশি ভালো না। পেটে বাচ্চা নষ্ট হয়েছে। অতিরিক্ত রক্তপাত হচ্ছে। আল্লাহ আল্লাহ করুন। আমরা চেষ্টা করছি রোগীকে বঁাচানোর।’

আমি দঁাড়িয়ে আছি অপারেশন থিয়েটারের সামনে। ভেতরে যেতে পারছি না। ভেতরে যাওয়ার নিয়ম নেই। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়