প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫৮
অভিভাবকহীন
‘মোবারক তুমি এটা কী করলে? এখন একটা কিছু হলে সামাল দেব কীভাবে? দ্রুত গিয়ে দেখো, মেয়েটা ঠিক আছে কি না।’ গাড়ির পেছনে বসে দৃঢ় কণ্ঠে ড্রাইভারকে শাসাল দীপক। ‘যাচ্ছি স্যার। কিন্তু আমি হার্ড ব্রেক না ধরলে আজ একটা দুর্ঘটনা হয়ে যেতৃ।’ কথা বলতে বলতেই মোবারক দরজা খুলে সামনে এগিয়ে গেল। পেছন পেছন দীপকও নামল।
না, মেয়েটার তেমন কিছু হয়নি। গাড়ির হালকা ধাক্কায় সামান্য আঘাত পেয়েছে শুধু। মেয়েটিকে হাতে ধরে নিয়ে গাড়িতে বসাল দীপক। গাড়িতে থাকা ফার্স্ট এইড বাক্স থেকে স্যাভলন আর তুলা বের করে কপালে থাকা সামান্য রক্ত পরিষ্কার করে দিল।
‘জল খাবেন? আপনার নাম কী?’
‘আমার নাম উর্মি। আমাকে আপনারা বাঁচালেন কেন?’ মুখে হ্যাঁ–বোধক ইশারা করে মেয়েটি বলল।
‘আমি বাঁচাইনি আপনাকে। আমার ড্রাইভার হার্ড ব্রেক করায় আপনি বেঁচে গেছেন। না হলে এই মাঝরাস্তায় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেত। যাহোক, সৃষ্টিকর্তা যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। আচ্ছা, আপনি এভাবে দ্রুত ছুটছিলেন কেন? তেমন কিছু হয়নি তো? এই নিন, জল খান।’
মেয়েটি বোতল নিয়ে জল খেল।
‘মোবারক, সামনে কোনো ফার্মেসি পেলে গাড়ি থামিয়ো। হাসপাতাল এখানে মনে হয় পাব না।’ তৎক্ষণাৎ মেয়েটি বলল, ‘না, না আমাকে ডাক্তার দেখাতে হবে না। আপনি শুধু আমায় এই ঠিকানায় নামিয়ে দিন।’
ঠিকানাটা হাতে নিয়ে দীপক বলল, ‘এই ঠিকানা আমি চিনি না। মোবারক, তুমি দেখো তো চেনো কি না।’
‘স্যার, ঠিকানা তো চিনি। কিন্তু আমরা ওইদিক দিয়ে যাব না। বিপরীত দিকে যাব। আর রাস্তাটাও বেশ দূরে।’
‘সমস্যা নেই। আগে তুমি এই ঠিকানায় যাও। ওনাকে নামিয়ে দিয়ে পরে যাব।’
‘ঠিক আছে স্যার’, বলে ড্রাইভার গাড়ি চালাতে লাগল।দীপক মেয়েটির দিকে তাকাল। বয়স ১৭ কি ১৮। কিন্তু বয়সের চেয়ে চেহারায় আতঙ্কের ছাপ বেশি স্পষ্ট। কয়েক ঢোকে মেয়েটি এক লিটার বোতলের অনেকখানি জল খেয়ে নিল। হয়তো প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে ভেবে দীপক বলল, ‘আপনি কিছু খেতে চাইলে বলুন, সামনে খাবারের দোকান পেলে কিনে নেব।’
খাবারের কথা শুনতেই মেয়েটি কেমন যেন করতে লাগল। বলল, ‘আমি কিছু খাব না। এই খাওয়া নিয়ে জীবনে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। আমার আর খাওয়ার ইচ্ছা নেই।’ বলতেই চোখে জল চলে এল তার। ‘আপনি শান্ত হোন, কাঁদবেন না। ড্রাইভার বলেছে, আপনার ঠিকানায় যেতে সময় লাগবে। এর মধ্যে আপনি চাইলে নিজের সম্পর্কে বলতে পারেন। না হলে থাক, বিশ্রাম নিন।’
মেয়েটি দীপকের অনেক প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছিল। তবু থেমে থেমে ওড়না দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে যা বলল তার সংক্ষেপ এই, সে ফেনীতে তার কোনো এক কাকার আশ্রয়ে থাকত। কয়েক বছর আগে বাসায় আগুন লেগে তার মা-বাবা মারা যায়। বড় ভাই আর সে কোচিংয়ে থাকায় তারা বেঁচে যায়। তারপর জব্বার কাকার ঘরে আশ্রয় নেয়। কাকি তাদের মেনে না নিতে না পারলেও কাকার ভয়ে সামনে কিছু বলতেন না। কিন্তু সারা দিন কাজ করাতেন উর্মি ও তার ভাইকে দিয়ে। খাওয়ার খোটা দিতেন প্রতিনিয়ত। গত বছর হঠাৎ বন্যায় কাকার বাড়িতে জল উঠলে, ভাই সিরাজকে রেখে সবাই অন্য আশ্রয়ে চলে যায়। যোগাযোগ রাখবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু দিন কয়েক পরে গিয়ে বাড়িতে সিরাজের লাশ পাওয়া যায়।
দীপক একটু সময় নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘উর্মি, কাকি আপনাকে এমন কী বলত যে কারণে খাবার শব্দটা শুনে আঁতকে উঠলেন? আমাকে বিশ্বাস করে বলতে পারেন।’
‘বিশ্বাস আমি কাউকেই করি না। তবু বলছি। ইট, বালু, সিমেন্টের ব্যবসা করা জব্বার কাকার এক ছেলে ছিল শুধু। অভাব-অনটন বলতে কিছু ছিল না সংসারে। তারপরও কাকি আমাদের দেখতে পারতেন না। অন্য কাকারা খবর নিতেন না। মামার বাড়িও ছিল না। যাওয়ার আর জায়গা ছিল না বলে ভাই-বোন মুখ বুজে সব সহ্য করতাম। গত চার-পাঁচ মাসে কাকির খারাপ ব্যবহার আরও বেড়ে গেল। খাবার দিয়েই বলতেন, “নেন নেন, খাবার খেয়ে আমায় উদ্ধার করেন। খাবার গেলা শেষ হলে জমানো কাজগুলা করেন।” কখনো কখনো বলতেন, “আমার কি জমিদারি আছে নাকি? এত খেলে পোষাবে না। সামনের বছর অন্য রাস্তা দেখো। আমি আর পালতে পারব না। যত সব অপয়া এসে আমার কপালে জোটে।” এগুলো ছিল কাকির নিত্য কথা। কাকা বেশির ভাগ সময় বাড়িতে থাকতেন না।’
দীপক বললেন, ‘আপনারা কাকাকে কিছু জানাতেন না?’
‘না, জানাতাম না। কারণ, কাকি কেমন, তা কাকা জানতেন আর আমরা অসহায় ছিলাম। তাই কিছু বলার সাহস ছিল না। ভাই-বোন মিলে মানিয়ে নিতাম। কিন্তু ভাই মারা যাওয়ার পর আমি একা আর পারছিলাম না। তাই পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।’
‘কিন্তু এখানে আপনি কার কাছে যাবেন? তিনি যে আপনাকে সাহায্য করবেন, তার নিশ্চয়তা কী? তার চেয়ে ভালো, আপনি আমার সঙ্গে চট্টগ্রামে চলুন। একটা এনজিওর মাধ্যমে আপনার থাকা ও কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারব।’
‘না, তা হয় না। আপনি আমাকে একবার বাঁচালেন, এর জন্য সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব। এই ঠিকানা আমার বাবার এক ছাত্রীর দেওয়া। বাবা হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। গত রোজার ঈদে পাশের বাসায় এই আপু বেড়াতে এলে আমি ওনার খোঁজ পাই। তারপর তিনি ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন, কখনো কোনো দরকার হলে নিঃসংকোচে চলে যেতে। তিনিও তার কাকার বাসায় থেকে বড় হয়েছেন আর আমার বাবার কাছে প্রাইভেট পড়তেন। আপাতত এটাই আমার শেষ ভরসা। বাকিটা ওপরওয়ালা জানে। কপালে যা আছে, মেনে নেব।’
ঠিকানায় পৌঁছে গেলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে উর্মি। বিপদে কাজে আসতে পারে এমন ভেবে কিছু টাকা দীপক দিতে চাইলেও সে নেয়নি।
দীপক ভাবছে, উর্মি যখন বলছিল, ‘আমি কাউকে বিশ্বাস করি না’, তখন যুক্তি দিয়ে সে বলতেই পারত, যার কাছে যাচ্ছেন সাহায্যের আশায়, তাকে তো বিশ্বাস করছেন বলেই যাচ্ছেন। কিন্তু দীপক কিছুই বলেনি। সব সময় সব যুক্তি সব জায়গায় খাটে না। তারও দীর্ঘদিন হলো মা-বাবা গত হয়েছেন। তাই অভিভাবকহীন জীবন কেমন, তা সে জানে।‘স্যার, গোকর্ণ ঘাট এসে গেছি। আপনি নেমে দাঁড়ান। আমি গাড়িটা সাইড করে আসি।’ মোবারকের কথায় দীপকের হুঁশ ফিরে এল। গাড়ি থেকে নামতেই ফোনটা বেজে উঠল। মৃণ¥য়ী কল দিচ্ছে। সে আসবে দেখা করতে। তাদের আজ প্রথম দেখা। দুই পরিবার থেকে বিয়ের জন্য আলোচনা হয়েছিল। আজকের সাক্ষাতের পর বাকি আলোচনা এগিয়ে যাবে। দীপক পেশায় ব্যাংকার। ব্যাংক থেকে ছুটি নিয়ে সে এ কারণেই চট্টগ্রাম থেকে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় এসেছে।
মৃণ¥য়ী দূরসম্পর্কের এক মামার কাছে বড় হয়েছে। তবে তার মা-বাবা মারা যায়নি। মেয়ে বলে দুই বছর বয়সে তাকে রেখে কোথাও চলে গেছেন তাঁরা। পরে নাকি আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। মামা-মামির নিজেদের সন্তান নেই বলে মৃণ¥য়ীকে মেয়ের মতো করে বড় করেছেন।
এই সম্পর্কের আলাপ করেছে দীপকের দূরসম্পর্কের এক কাকাতো বোন। ভাইকে সাংসারিক করার কঠিন দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে নিয়েছে। ‘না’ করতে করতে একসময় রাজি হয়েছে দীপক। উর্মির মতো তারও মানুষের প্রতি বিশ্বাস কাজ করে না। কিন্তু বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় নেই। মোবারক বলল, ‘স্যার, এখানে ভালো রেস্টুরেন্ট নেই। সামনের মোড়ে একটা ক্যাফে আছে। সেখানে বসতে পারেন।’
মৃণ¥য়ী আবার কল দিয়েছে। এবার দীপক কলটা রিসিভ করল। ‘হ্যালো, মৃণ¥য়ী, আপনি মেইন রোডের ইষ্টিকুটুম ক্যাফেতে চলে আসেন। আমরা সেখানেই বসব।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’ বলে লাইনটা কেটে দিল মৃণ¥য়ী।
ড্রাইভারকে গাড়ির কাছাকাছি থাকতে বলে দীপক এগিয়ে গিয়ে ক্যাফেতে বসল। অপেক্ষা করতে লাগল মৃণ¥য়ীর জন্য।