প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:০৬
অনাকাক্সিক্ষত ভ্রমণ কাহিনি
‘এই মেয়ে, তোমার নাম কী? কোথা থেকে এসেছো? তোমার মা-বাবা কোথায়? তুমি কীভাবে এখানে একা একা এসেছো? তোমার বাড়ি কোথায়? তুমি কি তোমার বাড়ি চেনো? আমাদের দেখাতে পারবে?’ এমনই একগাদা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছিল তারা আমার দিকে। আমি তখন গোলাকার এক জটলায় অশ্রুসিক্ত নয়নে ফোলা ফোলা চোখে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। দিশেহারা আমার ক্লান্ত চাহনি বারবার অপরিচিত মুখগুলোর দিকে এক প্রাণহীন দৃষ্টি ফেলছিল। আমার ব্যাকুল অবচেতন মন সেই ভিড়ের মধ্যে খুঁজে বেড়াচ্ছিল এক পরিচিত মুখ, যেমন করে কোনো এক হতভাগ্য নাবিক সমুদ্রের ঝড়ের কবলে পড়ে কোনো অজানা দ্বীপে বসে উন্মুখ হয়ে চেয়ে থাকে সাগর পানে, যদি দেখা পায় কোনো কার্গো জাহাজ।
বলছিলাম আমার শৈশবের স্মৃতির এক অনাকাক্সিক্ষত ভ্রমণ কাহিনির কথা। ২০০৮ সাল, যখন আমার বয়স চার ছুঁই ছুঁই। আমি বাবার সঙ্গে রাজধানীতে মেজো খালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার চঞ্চল স্বভাব সেদিন আমায় সাক্ষী করেছিল এক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার। খালামণির বাসাটা রাজধানীর ঠিক কোথায় ছিল, তা আমার মনে পড়ে না। তবে মনে পড়ে তাদের বাসার এক পাশে ছিল প্রচুর কচুরিপানায় পূর্ণ একটি নদী এবং তার বিপরীত পাশেই বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার বহু সরু গলি। আমার মনে হতো, সে যেন আরেক অন্ধকার রাজ্য, যেখানে হারালে কেউ আমায় কখনো খুঁজে পাবে না। আমার শৈশবের সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা সেই অন্ধকার সরু গলিগুলোর একটি কেন্দ্র করেই।
একদিন সূর্যোদয়ের বেশ কিছু সময় পর সেই গলির একটি জায়গায় আমি আমার খালাতো বোনের সঙ্গে মাটিতে দাগ টেনে খেলছিলাম। কিছু সময় পর তাকে তার ছোট কাকা ডেকে নিয়ে গেলে আমি সেখানে আপুর জন্য অপেক্ষা না করে তার পিছু নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কিছু সময় তাকে অনুসরণ করার পর তাকে আমি হারিয়ে ফেলি একটি গলিতে এসে। আমি অস্থির হয়ে যাই। অবশেষে খুঁজতে খুঁজতে আমি বিশাল একটি মাঠের মাঝে চলে আসি। তবু আপুকে খুঁজে পাই না। এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা চোখের পানি মুষলধারে নামতে থাকে। আমার অবিরত দিশেহারা কান্নার শব্দে থমকে দাঁড়ায় বিভিন্ন পথচারী। তারা এগিয়ে আসতে থাকে আমার দিকে। অবশেষে কয়েক শত ভাবনার বেড়াজাল ডিঙিয়ে একসময় আমি দেখলাম, বহু অপরিচিত মুখের মধ্য থেকে একটি পরিচিত, পরম কাক্সিক্ষত প্রিয় একটি মুখ ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। ঝাপসা চোখে মুখখানা পরীক্ষা না করেই দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম পরমাত্মীয়া বাবার বুকে। তিনি হাঁটু গেড়ে আমায় জড়িয়ে ধরলেন। অনুভব করলাম বাবার বুকের অস্থির, অজানা এক হৃদস্পন্দন। বাবার শার্টখানা ভেজা মনে হলো। তাকালাম বাবার দিকে। বাবা তখনো আমায় জড়িয়ে কেঁদে যাচ্ছেন। আমি অন্য আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। এমন আকস্মিক এক ঘটনায় আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। বাকরুদ্ধ আমি বাবাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম যেন ভুলে যেতে চাইলাম চারপাশের অজানা অন্ধকার পরিবেশের অপরিচিত রাজ্যের অপরিচিত শত মুখ থেকে, শত শত অন্ধকার সরু গলি থেকে।
বাবা আমায় অনেক দূরে নিয়ে যান। কল্পনার রাজ্য থেকে একসময় অনুভব করলাম, বাবা আমায় কোলে নিয়ে বাসার দিকে হাঁটছেন। তখনও আমার ভয় কুঁকড়ে যাওয়া মুখখানা গুঁজে রেখেছিলাম পরম নির্ভয়ের আশ্রয় বাবার বুকে। তখন কানে এলো, আমার খালাতো ভাই-বোন পরস্পর ঝগড়ায় মেতে গেছে। আমি হারিয়ে যাওয়ায় তারা একে অপরকে দুষছিল। খালামণি তাদের চুপ করাতে ব্যস্ত। আপু বলছিল, ‘আমিই তো বাসায় গিয়ে সবাইকে বলেছিলাম, না হলে কখন তোমরা কীভাবে খুঁজতে?’ ভাইয়া বলছিল, ‘আপু আমায় কেন একা ছাড়ল?’ এভাবে তাদের বাকবিতণ্ডা চলতেই থাকল। আর বিপরীত দিকে বাবা হয়তো অনুভব করছিলেন, অতিরিক্ত কান্না করার দরুণ হেঁচকি দিয়ে আমার দেহখানা বারবার কেঁপে ওঠার কম্পন।
আমার মনে তখন নানা প্রশ্নের তোলপাড়। অনুতপ্ত মন বারবার বলছিল, ‘ভ্রমণের এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় যদি বাবা আজ আমায় খুঁজে না পেতেন, তাহলে গ্রামে ফিরে গিয়ে তিনি আম্মাকে কী জবাব দিতেন? কী জবাব?’