প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৮
অনন্যার মনকথা
নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলেন অনন্যা রহমান। কল্পনার জগতে বিচরণ করেন তিনি। কখনো বেলকনিতে, কখনো আবার চাঁদের আলোয় ছাদে হাঁটাহাঁটি করতে করতে কল্পনার জগতে ডুব দেন!
উদার আকাশ ভাবে, এ কেমন মেয়ে! একা একা কথা বলে! বেলকনির গাছগুলোও নিশ্চয়ই মিটিমিটি হাসে!
অনন্যা একদিন মাঝরাত অবধি বেলকনিতেই নির্ঘুম কাটিয়ে দিল প্রিয় সুমন্তর সঙ্গে কাটানো কিছু মুহূর্তের সঙ্গে গল্প করে।
সুমন্ত, কেমন আছ? অনেক দিন পর তোমাকে একনজর দেখলাম এক বন্ধুর ফেসবুক আঙিনায়। কিছুটা ঝিমিয়ে গেছ। যেমন ছিলে প্রাণবন্ত, ঠিক যেন তার উল্টোটা মনে হলো। জানি না, হয়তো ভুলও হতে পারে আমার। জানো, এখনো স্মৃতির পাতায় ভাসি আমি। মনে হয়, কত কিছুই তো নিয়ম ভেঙে চলছে। আমি, আমরা পারিনি কেন? আসলে আমরা বোধ হয় নিয়ম ভাঙার দলে নাম লেখাতে পারিনি, তাই না!
মনে আছে তোমার! ওই যে, আষাঢ়ের এক দুপুরে মুষলধারে বৃষ্টিতে নিউমার্কেটে যেদিন আটকে পড়েছিলাম। হঠাৎ তোমার ফোন। আমি হ্যালো বলতেই তুমি নিজের মতো করে একনিশ্বাসে বলতে থাকলে, ‘কেমন আছ অনন্যা? নিজের জন্য ভাবো কি তুমি? কতবার বললাম, সময়টাকে কাজে লাগাও। চারপাশে তাকাও; সবাই কেমন ছুটছে। সবাই সময়কে কাজে লাগাচ্ছে, আর তুমি সাতকাহন নামক সংসারেই আটকে আছ।’
আমি ধীরে ধীরে বললাম, ‘আমি বাইরে। বৃষ্টিতে আটকে পড়েছি নিউমার্কেটে।’ তুমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘কোথায়? কোন নিউমার্কেট?’ আবার আস্তে বললাম, ‘তোমার শহরে।’ ‘আমি আসছি অনন্যা!’
বিশ থেকে পঁচিশ মিনিটের মধ্যে আবার তোমার ফোন, ‘অনন্যা গাড়ি নিয়ে এসেছি, তুমি কোথায়?’
‘আমি নিউমার্কেটের দুইতলায়, আসছি নেমে।’
তুমি বললে, ‘ছাতা আছে তোমার সঙ্গে?’
‘না নেই!’
‘দাঁড়াও, আমি আসছি।’
সেদিন আমি পুরো সাদা রঙের থ্রি–পিস পরেছিলাম। শ্যাম্পু করা খোলা চুল, চোখভরা কাজল আর ঠোঁটে ন্যুড লিপস্টিকÑএই সাজে। আর একটু গুচি ব্র্যান্ডের পারফিউম স্প্রে করেছিলাম।
বৃষ্টিতে ভিজতে মন সায় দিচ্ছিল না, নোংরা হওয়ার ভয়ে। সাদা আমার ভীষণ পছন্দের রং। অনেকেই বলে, সাদায় নাকি আমাকে সাদা পরির মতো সুন্দর লাগে। হয়তো বেশি বেশি বলে, বানিয়ে বানিয়ে বলে খুশি করার জন্য।
যাকগে, গল্পে ফিরিÑ
আমি একটু উঁকি দিতেই অবাক হলাম! তুমিও সাদায় সেজেছ। সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা, ধবধবে ফরসা তোমাকে স্বর্গ থেকে নেমে আসা দেবদূত মনে হচ্ছিল।
‘জলদি এসো অনন্যা। এসো এসো, ভিজে যাবে তো।’ একই ছাতার নিচে নিজেকে একটু গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তুমি বললে, ‘অনন্যা, এভাবে ভাবছ কেন? বুঝতে পারছ না, তুমি ভিজে যাচ্ছ!’
মনে মনে বললাম, খুব বুঝি! তোমার যত্ন আমার ভীষণ ভালো লাগে, লোভাতুর হই! এমন যত্নসম্পন্ন মানুষের জন্য কত স্বপ্ন দেখেছি দুচোখ ভরে একসময়; কিন্তু এই যে বর্তমানে দাঁড়িয়ে, সময়টা সত্যি দুর্ভাগ্য আমাদের দুজনের জন্যই।
গাড়িতে গিয়ে পেছনের সিটে বসলাম। তুমি অনেকবার সামনের সিটে বসতে বললেও আমি পেছনের সিটেই বসি। গাড়ি চলছে, হালকা আওয়াজে গান বাজছে। এরই ফাঁকে ফাঁকে কথা চলছে আমাদের।
‘ওহ্ অনন্যা, তোমার জন্য চিপস, চকলেট, কোক এনেছি।’ মনে মনে বললাম, আমি যেন এখনো ছোট্ট খুকি। আমার জন্য চিপস, চকলেট, কোক এনেছে! তুমি হাত বাড়িয়ে পেছনে দিলে আমাকে।
আমি চিপসের প্যাকেট খুলে তোমার হাতে দিচ্ছি। তুমি খাচ্ছ, সঙ্গে আমিও। হঠাৎ কী হলো, তোমাকে চিপস এগিয়ে দিতেই আমার হাতটা ধরে ফেললে, আলতো করে হাতে চুমু দিয়ে বসলে।
লজ্জায় রাঙা হয়ে আমি মুখ নিচু করে কতক্ষণ যে থাকলাম! তুমিও তখন চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছ। ভীষণ বৃষ্টি! ভীষণ! গাড়ির জানালার সামনের কাচ বৃষ্টির পানিতে ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। কী মনে করে তুমি গাড়ি থামালে! মুহূর্তেই দরজা খুলে পেছনের সিটে চলে এলে।
বললে, ‘ভয় করছে?’
‘হুমম, একটু একটু!’
‘কেন? কিসের ভয়?’
আমি বললাম, ‘মানুষের ভয়!’
তুমি বললে, ‘আমি আছি। তোমার কোনো ভয় নেই। অনন্যা, তুমি কি বোঝ, আমি তোমাকে কতটা পছন্দ করি? তুমি ভীষণ আদুরে, লক্ষ্মী একটা মেয়ে।’
‘হুম, একটু একটু বুঝি। তবে ভাগ্য খারাপ আমাদের। কখনোই সম্ভব নয়।’
আমাকে
বললে
, ‘একটু সরে বসো।’
আমিও লক্ষ্মী মেয়ের মতো জায়গা করে দিলাম তোমাকে।
ওমা, জায়গা করে দিয়ে যেন ভুলই করলাম। আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লে। আশপাশ নীরব, হঠাৎ দু–একটা গাড়ি ছুটছে। আর তুমি-আমি! তুমি বলে উঠলে, ‘মনে হয়, তোমাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে শুধু তুমি আর আমি থাকব, আর সুন্দর প্রকৃতি থাকবে। আমরা দুজন প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হব। প্রকৃতিকে ঘিরেই হবে আমাদের জীবন।’
‘তা-ই বুঝি! প্রতিদিন প্রকৃতি দেখতে ভালো লাগবে?’
‘লাগবে লাগবে, তুমি পাশে থাকলে সবই ভালো লাগবে। প্রকৃতি হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর শক্তিশালী বন্ধু। যে বন্ধু কখনো ক্ষতি করে না। বুঝলে অনন্যা, আমি চাই তুমি ভালো থাকো।’
আমি বললাম, ‘পৃথিবীতে সব ভালো থাকাকে লোকচক্ষু ভালোভাবে নেয় না।’
এরপরÑ
তোমার সঙ্গে আরও দু–একদিন দেখা হয়েছিল। সব কটা দেখা করার দিনই ছিল পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া। সব সময় সব দিন তোমার চোখে আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি। আর বিশ্বাস অফুরন্ত। তবু বাস্তবতা মেনে নিয়ে সম্পর্কটা চালিয়ে যাওয়া উচিত নয় ভেবে গুটিয়ে নিলাম নিজেকে। শামুকের খোলসের ভেতর ঢুকে গেলাম যেন। জীবনভর বয়ে বেড়াচ্ছি এই বুকভরা কষ্ট।
জানো সুমন্ত, আমি একবুক কষ্ট মেনে নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে অন্ধকারে কথা বলতে ভালোবাসি। নিজের সঙ্গে কথা বলে সুখের কিনারায় ঘুরি–ফিরি। এটাই বা কজন পারে বলো! সত্যি আমি মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে মুঠোফোনে নম্বর বন্ধ করে দিলাম। কখনোই আর যোগাযোগ করিনি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও। তবে আজ কেন জানি তোমার জন্য মন কাঁদছে। ফিরে আসছে সব স্মৃতি। ভাসছি হারানোর ব্যথায়।
নাহ্ আর না। আর নয় গল্প, ফিরে যাও সুমন্ত। যদি পারো, ক্ষমা কোরো আমায়।