প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:১১
লোভনীয় প্রস্তাবে সর্বনাশ!
অনলাইনে বিয়ের পাত্রী খুঁজতে সর্বস্ব হারাচ্ছেন অনেকে
ইতালি ফেরত একজন মেয়ের জন্যে পাত্র খোঁজা হচ্ছে ফেসবুকে। পাত্রীর বয়স ২৯ এবং নিজের নামে দোতলা বাড়িসহ ৪ বিঘা জমি আছে। তিনি ইতালিতে একটি কফিশপেরও মালিক। বিয়ের পর পাত্রকে ইতালিতে নিয়ে যাবেন। যোগাযোগের জন্যে ওই ফেসবুক পোস্টের কমেন্টে দেয়া হয়েছে একটি লিংক। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, ওই লিংকে ক্লিক করলে সেটি বারবার চলে যাচ্ছে বিদেশি মুদ্রা (ফেরক্স) ক্রিপ্টোকারেন্সি বেচাকেনা এবং বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার সাইটে।
স্বাধীন গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাব বলছে, তারা গত জুলাই থেকে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে অন্তত ৩৫টি পোস্টে এই ইতালি ফেরত পাত্রীর জন্যে পাত্র খোঁজার বিবরণ পেয়েছে। তবে কোথাও বয়স বদলেছে, কোথাও পাত্রীর জমির পরিমাণ, আর কোথাও ছবি বদল করা হয়েছে।
‘পাত্র চাই’ পোস্টগুলোতে বিভিন্ন রকমের পাত্রীর বিবরণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১২টি বাক্য বা কি-ফ্রেজকে নমুনা হিসেবে নিয়ে ফেসবুকে সার্চ করে মোট ৪৩০টি পোস্ট পেয়েছে ডিসমিসল্যাব।
সংস্থাটি বলছে, গবেষণার নমুনা হিসেবে গৃহীত ৪৩০টি পোস্টের মধ্যে ৩৯৭টি, অর্থাৎ ৯২ শতাংশই জুয়া বা বিদেশি-মুদ্রা লেনদেনের সাইটে নিয়ে গেছে। এই প্রচারণার সঙ্গে একাধিক নেটওয়ার্ক বা চক্রে বিভক্ত একশ'র বেশি ফেসবুক পেজ, প্রোফাইল ও গ্রুপের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
অ্যাফিলিয়েট গ্যাম্বলিং প্রচারণায় মূলত একটি লিংকের সাহায্যে গ্রাহকদের অনলাইন জুয়ার সাইটে নিয়ে আসা হয়। এই লিংকগুলোকে বলা হয় রেফারেল লিংক, যার প্রতিটিতে একটি পরিচিতিমূলত কী (কবু) থাকে। রেফারেল লিংকে কেউ ক্লিক করলে প্রচারণাকারী (যিনি রেফারেল লিংকটি তৈরি ও প্রচার করেছেন) সেখান থেকে আয় করতে পারেন। এদের মধ্যে কয়েকটি লিংক আবার ফিশিং বা তথ্যচুরির সাইটেও নিয়ে যায়।
গত সপ্তাহে ডিসমিসল্যাবের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪৩০টি পোস্ট ১১ হাজারের বেশিবার শেয়ার হয়েছে এবং তাতে হাজার হাজার মন্তব্য এবং দু’লাখের বেশি রিয়্যাকশন রয়েছে। পোস্টগুলোতে অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন। সাইবার প্রতারণার জগতে ছদ্মবেশে ডেটিং কিংবা বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ব্যবহারকারীদের ফাঁদে ফেলা ‘হানিট্র্যাপ’ নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী এ ধরনের প্রচারণা সমস্যাজনক। ব্যাংকের নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, অনলাইন জুয়া এবং ফরেক্স ও ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ অবৈধ।
এ ছাড়া এ ধরনের প্রচারণা মেটাও সমর্থন করে না। মেটা বলছে, এ ধরনের প্রচারণা স্প্যাম (প্রতারণামূলক) ও ক্লোকিং (লিংকে মূল গন্তব্য গোপন করা) নীতিমালা পরিপন্থী।
ডিসমিসল্যাব জানিয়েছে, তাদের গবেষণায় বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে এমনভাবে প্রচারণা চালানোর নজির পাওয়া গেছে, যা মেটার নীতিমালা অনুযায়ী কো-অর্ডিনেটেড ইনঅথেন্টিক বিহেভিয়র বা সমন্বিত বিরূপ আচরণের সঙ্গে মেলে। কিন্তু প্রায়-বিশ্বাসযোগ্য গল্প এবং সর্ট (সংক্ষিপ্ত) লিংক ব্যবহার করে, এই প্রচারণাটি ফেসবুকের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।
ডিসমিসল্যাবের গবেষণায় আরও দেখা গেছে, পাত্র চাওয়া পোস্টগুলোতে ব্যবহৃত একই লিংকগুলো একেকবার একেক সাইটে নিয়ে যায়। বেটিং সাইটগুলোর মধ্যে রয়েছে : ক্রিকিয়া, জিতবাজ, বাবু ৮৮, বাজি, সিক্স৬ বিডি, সিক্স৬ এসবিডিটি অনলাইন ইত্যাদি। এর বাইরে কোটেক্স ও পকেট বাইন্যান্সের মতো ক্রিপ্টো ও ফরেক্স ট্রেডিং সাইটও রয়েছে।
প্রচারণার আসল লিংকগুলোকে গোপন করতে টাইনি ইউআরএল, কাটলি, ইউক্লিক.লিংকের মতো বেশ কিছু ইউআরএল শর্টনার দিয়ে ছোট করা হয়েছে।
এসব সাইটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ভিজিটরের ক্লিক বা ট্রাফিকের মাধ্যমে আয় করা। এ ধরনের ওয়েবসাইটগুলো সাধারণত বিভিন্ন বিজ্ঞাপন নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে কাজ করে এবং ব্যবহারকারীদের রিডাইরেক্ট করিয়ে বা বিভিন্ন পপ-আপ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন সাইটে নিয়ে যায়।
ডিসমিসল্যাব বলছে, অনুসন্ধানে বিভিন্ন ডোমেইনের মোট ১৯টি ভিন্ন রেফারেল কী নাম্বার (লিংকের শেষে পরিচিতমূলক কী) পাওয়া গেছে। ৫৪টি পেজ ও প্রোফাইল ঘুরে ফিরে এসব ডোমেইন ও কী নাম্বার ব্যবহার করেছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা এনগেজ মিডিয়ার ডিজিটাল নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আশরাফুল হক বলেন, এই কী নাম্বারগুলো মূলত অ্যাফিলিয়েট গ্যাম্বলিংয়ে জড়িতদের পরিচয় বহন করে।
গবেষণায় অন্তত চারটি চক্র বা নেটওয়ার্ক দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন একই পোস্ট ও একই লিংক শেয়ার করে থাকে। যেমন, এমএন মিডিয়া, ক্রিয়েটিভ মাইন্ডস, মুনমুন, আজাইরা পিপল, রিনা আক্তার, গোল্ডেন ভিউ, স্নেহা পল, গোল্ডেন ভিউ পেজগুলো প্রতিদিন খুব কাছাকাছি সময়ে পাত্রচাই প্রচারণার পোস্টগুলো করে থাকে।