শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪  |   ৩১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা গণফোরামের কর্মী সমাবেশ
  •   নিষেধাজ্ঞার প্রথম দিনে ফরিদগঞ্জে অবাধে ইলিশ বিক্রি
  •   পিকনিকে যাওয়া শিক্ষার্থীর মরদেহ মেঘনায় ভেসে উঠলো দুদিন পর
  •   নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি না করার শপথ করিয়েছেন এমএ হান্নান
  •   বিকেলে ইলিশ জব্দ ও জরিমানা

প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ১৮:৫৫

ধনুষ্টঙ্কার : কারণ ও প্রতিকার

ডা. পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
ধনুষ্টঙ্কার : কারণ ও প্রতিকার

ধনুষ্টঙ্কার কী

টিটেনাস বা ধনুষ্টঙ্কার একটি সংক্রমণশীল স্নায়ুতন্ত্রের রোগ যার জন্যে ক্লস্ট্রিডিয়াম টিটেনি নামক অবায়ুজীবী ব্যাক্টেরিয়া দায়ী। এই রোগকে অন্যকথায় ‘লক-জ’ নামেও ডাকা হয়। এই রোগে খিঁচুনির ফলে মাংসপেশির যে কম্পন তৈরি হয় তাকে ট্রিসমাস বলে। ধনুকের মতো দেহ বাঁকিয়ে নেয় বলে এর নাম ধনুষ্টঙ্কার। বর্তমানে ধনুষ্টঙ্কার নিরূপণের কোন পরীক্ষা নেই তবে লক্ষণ ও রোগীর দেওয়া বর্ণনা হতে ধনুষ্টঙ্কার সনাক্ত করা হয়।

ধনুষ্টঙ্কারের লক্ষণ

* সাধারণত খিঁচুনি দেখা দেয়। খিঁচুনি চোয়াল হতে শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে দেহের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি খিঁচুনির ব্যাপ্তি কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়।

* তিন থেকে চার সপ্তাহ ধরে প্রায়ই ঘন ঘন খিঁচুনি হতে থাকে। কখনও কখনও খিঁচুনির ধরন এত তীব্র হয় যে তা হাড়ে চিড়্ ধরার জন্য যথেষ্ট ।

* আক্রান্ত ব্যক্তি জ্বর, ঘাম, মাথাব্যথা, খাবার গলাধঃকরণে সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন দ্রুত হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয় ।

* লক্ষণগুলি সাধারণত দেহে জীবাণু সংক্রমণের তিন থেকে একুশ দিন পর দেখা যায়।

* এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মুখের পেশীগুলিতে খিচুনির প্রভাবে চেহারা এক বিশেষ আদল নেয়। একে রিসাস সার্ডোনিকাস বলে। বুক, ঘাড়, পিঠ, পেট এবং নিতম্বের পেশী ও প্রভাবিত হতে পারে। পিঠের পেশীর খিঁচুনির কারণে পিঠ ধনুকাকৃতি হয়ে যায়Ñযাকে অপিস্থোটোনাস বলে। কখনও কখনও খিঁচুনির তীব্রতার কারণে শ্বাসকষ্ট হয়।

রোগের কারণ

ক্লস্ট্রিডিয়াম টিটেনি নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে টিটেনাস হয়। এটি সাধারণত মাটি, লালা, ধুলো এবং ফলন বৃদ্ধির জন্যে ব্যবহৃত সারে পাওয়া যায়। এই ব্যাকটেরিয়াটি সাধারণত দূষিত বস্তুর দ্বারা সৃষ্ট কাটা বা খোঁচার মতো চামড়ার ক্ষতের মাধ্যমে মানব দেহে প্রবেশ করে এরা মানব দেহে এক প্রকার টক্সিন বা প্রতিবিষ তৈরি করে যা স্বাভাবিক পেশি সংকোচনে বিঘ্ন ঘটায়। রোগ নির্ণয়ে রোগীর বয়ান, লক্ষণ এবং উপসর্গের উপর নির্ভর করা হয়। এই রোগ ছোঁয়াচে নয়। ধনুষ্টঙ্কারের ইতিহাস

ধনুষ্টঙ্কার পৃথিবীর সব জায়গায় দেখা যায় তবে গরম এবং আর্দ্র জলবায়ুতে যেখানে মাটি উচ্চ জৈব উপাদান সমৃদ্ধ, সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর প্রায় তিরিশ জন ধনুষ্টঙ্কারে আক্রান্ত হয়, যাদের প্রায় সবার ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে তারা টিকা নেননি। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে হিপোক্রেটিস এই রোগের প্রাথমিক বর্ণনা দেন। উনিশশো চব্বিশ সালে ধনুষ্টঙ্কারের টিকা আবিষ্কৃত হয়।

নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কার বা নিওনেটাল টিটেনাস

একে ট্রিসমাস ন্যাসেন্টিয়ামও বলে। এটি হলো জেনারালাইজড টিটেনাসেরই একটি ধরন, যা নবজাতক শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। সাধারণত সেসব নবজাতকেরা আক্রান্ত হয়, যাদের মায়েরা ধনুষ্টঙ্কারের টিকা নেননি। যদি মায়েদের ধনুষ্টঙ্কার প্রতিরোধী টিকা দেওয়া থাকে, তাহলে তাদের নবজাতক শিশুরা আর ধনুষ্টঙ্কারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। সেফালিক টিটেনাস

বিরল ধরনের ধনুষ্টঙ্কার হলো সেফালিক টিটেনাস যার প্রভাব মস্তিষ্কের স্নায়ু ও পেশিতে সীমাবদ্ধ থাকে। এটি সাধারণত মাথা ও তৎসন্নিহিত অংশে আঘাত লাগা যেমন : মাথার খুলি ফেটে যাওয়া, মাথার উপরিত্বক কেটে যাওয়া, চোখে আঘাত লাগা, যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত না করে দাঁত তোলা এবং ওটাইটিস মিডিয়া বা কানের সংক্রমণে দেখা দেয়। এই ধরনের ধনুষ্টঙ্কারে বেশির ভাগ ফেসিয়াল নার্ভ বা মুখের স্নায়ু পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়। ফলে লক-জ (দাঁতের চোয়াল কপাটি লাগা), মুখের স্নায়ুর পলসি (অবশ হওয়া) বা টোসিস (চোখের উপরের পাতা আপনা আপনি নেমে আসা) দেখা দেয়। সেফালিক টিটেনাস রোগ সব সময় মস্তিষ্কে সীমাবদ্ধ না-ও থাকতে পারে। যাদের ঠিকমতো টিটেনাসের টিকা দেওয়া হয়নি তারাই এ রোগে আক্রান্ত হয়। রোগের বিস্তার

ধনুষ্টঙ্কার বা টিটেনাস উষ্ণ ও স্যাঁতসেঁতে জলবায়ুতে জৈব-পদার্থে সমৃদ্ধ মাটিবহুল জায়গাতে বেশি দেখা যায়। জৈবসার দেওয়া মাটিতে জীবাণুর স্পোর থাকতে পারে। কারণ স্পোর ঘোড়া, ভেড়া ইত্যাদি গবাদি পশু; কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর, গিনিপিগ এবং মুরগির মতো বহু প্রাণীর অন্ত্রে ও মলে ব্যাপকভাবে উপস্থিত থাকে। কৃষি প্রধান অঞ্চলে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজেদের শরীরে এই জীবাণু বহন করে চলে।

ধনুষ্টঙ্কার সংক্রমণের কারণকে প্রায়ই মরিচা, বিশেষত মরিচা বা জং ধরা পেরেকের সাথে যুক্ত করা হয়ে থাকে। যদিও মরিচা নিজে টিটেনাস সৃষ্টি করে না, তবে মরিচা জমে থাকা বস্তুগুলি প্রায়শই বাইরে খোলা অবস্থায় থাকে বা অবাতজীবী (অ্যানেরোবিক) ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য আছে এমন স্থানে পাওয়া যায়। মরিচা ধরা লোহার খসখসে পৃষ্ঠে ক্লস্ট্রিডিয়াম টিটেনি মিশে থাকা ধূলো-ময়লার সাথে মিশে থাকে। মরিচা ধরা পেরেক ধারালো বস্তু হওয়ার কারণে সহজেই তা ত্বককে ছিদ্র করে ফেলে এবং ক্ষতস্থানের মাধ্যমে শরীরের গভীরে জীবাণুর এন্ডোস্পোর অনুপ্রবেশ করে। এন্ডোস্পোর হল জীবাণুর একটি বিশেষ অবস্থা যা চরম বিরূপ পরিবেশেও বেঁচে থাকাতে সক্ষম এবং অনুকূল পরিবেশ পেলে তা সুস্থ মানবদেহে সংক্রমণ ঘটায়। টিটেনাসে আক্রান্ত রোগীদের আলাদা করে রাখা হয় ও সংক্রামক ব্যাধির হাসপাতাল বা ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হয়। খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণে ডায়াজিপাম ইঞ্জেকশন ব্যবহার করা হয়।

ধনুষ্টঙ্কার প্রতিরোধ

ধনুষ্টঙ্কার প্রতিরোধে টিটেনাস ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়। যে কোন ক্ষত ভালভাবে পরিষ্কার করা উচিত এবং মৃত দেহকোষ ও টিস্যু অপসারণ করা উচিত। যাদের ক্ষতের পরিমাপ উল্লেখযোগ্য এবং তিনটির কম টিকার ডোজ নেওয়া রয়েছে, তাদের টিকা এবং টিটেনাস ইমিউনো গ্লোবিউলিন উভয়ই নেওয়া প্রয়োজন। সংক্রামিত ব্যক্তিদের চিকিৎসায়, টিটেনাস ইমিউনো খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণ করতে পেশি শিথিলকারী ঔষধ ( মাসল্ রিলাক্স্যান্ট) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কোন ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস প্রভাবিত হয়ে থাকলে প্রয়োজনে যান্ত্রিক বায়ুচলাচল বা মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখা যেতে পারে। নবজাতক অবস্থাতেই ধনুষ্টঙ্কার প্রতিরোধে সচেতন হওয়া উচিত। আজকাল শিশুদের জন্যে ইপিআই-এর আওতায় পেন্টাভ্যালেন্ট টিকার মাধ্যমে দেড় মাস, আড়াই মাস ও সাড়ে তিনমাসে তিন ডোজ টিটেনাস টিকা দেওয়া হয়। পনর থেকে ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সী নারীদের পাঁচ ডোজের শিডিউল মোতাবেক টিকা দেওয়া হয়। যারা এই পাঁচ ডোজের টিকা নেননি, তারা গর্ভকালীন ছয় মাস ও সাত মাসে দুই ডোজ টিটেনাস টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক। ধনুষ্টঙ্কারকে এড়াতে হলে ক্ষতস্থানে যাতে ধূলাবালি না লাগে সেদিকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি জং ধরা লোহায় যাতে কাটা না যায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়