প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:১৪
চাঙা হচ্ছে ব্যাংক ও আর্থিক খাত
*বাড়ছে রেমিট্যান্স ও ব্যাংক লেনদেন
* গতি ফিরেছে শেয়ারবাজারেও
➥ ব্যাংকিং খাতে মানুষের আস্থা ফেরানো একটা চ্যালেঞ্জ -অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ
➥ বৈদেশিক মুদ্রার পর্যাপ্ত জোগানে ব্যবস্থা নিতে হবে -ড. জাহিদ হোসেন, সাবেক প্রধান, বিশ^ব্যাংক ঢাকা কার্যালয়
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ ও কারফিউর মধ্যে বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকে আমদানি-রপ্তানি। বন্ধ হয়ে যায় ব্যাংকিং লেনদেনও। কমে যায় রেমিট্যান্সের গতি। স্থবির হয়ে পড়ে বাণিজ্যি খাত। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন সরকার গঠন পর্যন্ত প্রায় দেড় মাস কার্যত অচলাবস্থা ছিল এই খাতে। নতুন সরকার গঠনের পর এখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত। পাশাপাশি বেড়েছে আমদানি-রপ্তানি এবং পণ্য সরবরাহ। নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে বৈদেশিক মুদ্রা। আবারও নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে শেয়ারবাজার। এই ধারাবাহিকতায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করতে জোর দেওয়া প্রয়োজন। বিপর্যয় নেমে আসা অর্থনীতিকে টেনে তুলতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবৃদ্ধির চিন্তা না করে আগে অর্থনীতিকে সচল করতে হবে। যা আছে, তা ঠিকমতো চলছে কি না, সেটা আগে নিশ্চিত করতে হবে। এত দিন ইকোনমিক অঙ্গগুলো বিকল হয়ে ছিল। সেগুলোকে আগে সচল করতে হবে। এছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দখল-পাল্টা দখল নিয়ে সৃষ্ট অস্থিরতাও দ্রুত কাটিয়ে ওঠার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
দীর্ঘদিন পর আবার গতি ফিরেছে শেয়ারবাজারে। প্রায় দুই বছর পর গতকাল রোববার প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) দুই হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে সবকটি মূল্যসূচক। তবে দাম বাড়ার থেকে দাম কামার তালিকায় স্থান হয়েছে বেশি প্রতিষ্ঠানের। অন্য শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) দাম বাড়ার তালিকায় বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠান স্থান করে নেওয়ার পাশাপাশি মূল্যসূচকের বড় উত্থান হয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে লেনদেনের পরিমাণ। এর মাধ্যমে হাসিনা সরকার পতনের পর শেয়ারবাজারে লেনদেন হওয়া চার কার্যদিবসেই সূচক বাড়ল।
আগের মতো নতুন গতিতে ব্যাংকগুলো তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। কারণ জানতে চাইলে সন্ধানী অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মীর আরিফুল ইসলাম বলেন, বিনিয়োগকারীদের উচ্ছ্বসিত মনোভাবে শেয়ারবাজার চাঙা হয়েছে। যখন সরকার পরিবর্তন হয়, তখন বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। তারা মনে করেন, নতুন সরকার বাজার পরিস্থিতির উন্নতিতে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন করবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, সর্ববৃহৎ পদক্ষেপ হওয়া দরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, যা জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য এবং সাধারণ মানুষের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার ব্যবস্থাপনায় যেটা বড় সমস্যা তা হলো চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট, সেটা বন্ধ করতে হবে। এখন চাঁদাবাজি না থাকায় কম দামে বিক্রি করলেও বেশি লাভ করছেন বিক্রেতারা। তাই মূল্যস্ফীতি কমাতে চাঁদাবাজি মনিটর করতে হবে। টাকা ছাপিয়ে বাজেটে অর্থায়ন করা বন্ধ করতে হবে। এ ধরনের কাজ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলে মানুষও খুশি হবে, এটা প্রবৃদ্ধির জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।বৈদেশিক মুদ্রার জোগান যাতে পর্যাপ্ত থাকে, সেটার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। আর্থিক খাতে যে দুর্দশা আছে, তা দূর করতে সংস্কার শুরু করতে হবে। দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। আর পরিসংখ্যানগুলোকে ঠিক করতে হবে। আসলে আমাদের প্রবৃদ্ধি কত হচ্ছে, সেটাই আমরা ঠিকমতো বুঝতে পারি না। আমাদের প্রবৃদ্ধির সংজ্ঞাগুলো দূষিত, এক্সপোর্ট দূষিত এবং জিডিপির সংজ্ঞাগুলো দূষিত। এগুলো দূষণমুক্ত না করতে পারলে আসলে অর্থনীতির চিত্র কী, সেটা বোঝা যাবে না। এটা বোঝা না গেলে সঠিক নীতিও গ্রহণ করা যাবে না।
বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমানের মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে না। দেশের মূল্যস্ফীতি কমাতে গেলে মুদ্রানীতি যথাযথভাবে কাজ করতে হবে। এ জন্য সব সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মনিটারি পলিসি টাইট রাখতে হবে। বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখতে হবে। বাজারে হানা দিয়ে জরিমানা করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সুদহার বাজারভিত্তিক যেটি আছে, সেটিই রাখতে হবে। পারলে বাড়তে দিতে হবে। জোর করে সুদহার আটকে রাখলে, ক্রেডিট বাড়িয়ে দিলে, টাকা ছাপালে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। বেশি লিকুইডিটি সাপোর্ট দেওয়া যাবে না। বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করে উচ্চ পর্যায়ে রাখতে হবে। বর্তমান পলিসি যেটি আছে সেটি ঠিক আছে। এই জায়গায় বেশি নাড়াচাড়া করা যাবে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিভিন্ন কারণে দেশের অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। আমাদের লক্ষ্য হবে যত দ্রুত সম্ভব অর্থনীতিকে গতিশীল করা। কারণ অর্থনীতি স্তব্ধ হয়ে গেলে সেটা চালু করা বেশ কঠিন। আমরা স্তব্ধ হতে দিতে চাই না। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনা হবে জানিয়ে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে মানুষের আস্থা ফেরানো একটা চ্যালেঞ্জ। এ খাত পুনরুদ্ধারে মনোযোগ দিতে হবে এখনই। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করতে হবে। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে কাজ করা হবে।