প্রকাশ : ০২ মে ২০২২, ১৪:৪৫
৫ লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ায় ৫০ লাখ টাকার মাছ নিধন
ঈদের আগে সবার ঘরে ঘরে যখন আনন্দের বন্যা বইছে তখন বুক ফাটা আর্তনাদ চলছে ফরিদগঞ্জের মৎস চাষী মোশারেফ হোসেন সুমনের ঘরে। প্রায় ৫০ লাখ টাকার পঁচা মাছ বুকে জড়িয়ে ধরে সুমনের বুক ফাটা কান্না স্তব্ধ করে দেয় যে কাউকে।
২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর এক বছরের জন্য ৪০ লাখ ২০ হাজার টাকায় ইজারা নেয়া ফরিদগঞ্জ মিরপুর গ্রামের ২৭০ নং সিএস ও ৯৭ নং বিএস এর ১শ' ১০ একর জমির চর ইজারা নেন মৎসচাষী মোশারেফ হোসেন সুমন। ইজারা নেয়ার পরের মাসে চরে ৬০ লাখ টাকার মাছ ফেলেন তিনি। স্বপ্ন ছিলো মাছ বিক্রি করে ঋণের টাকা পরিশোধ করবেন, পরিবারের মুখে হাসি ফোঁটাবেন। কিন্তু নিমিষেই সব শেষ হয়ে গেলো তার। ৩০ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত ৩ দিনে পঁচে ভেসে উঠে প্রায় ৫০ লাখ টাকার মাছ।
পঁচা মাছের গন্ধে পথচারীর দম বন্ধ হয়ে আসলেও সুমনের দম বন্ধ হয় না, পঁচা মাছের স্তুপে বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। হাজার হাজার মাছ মাটি চাপা দিয়েছেন নিজ হাতে। এ যেন নিজের হাতে লালিত স্বপ্নকে কবর দেয়া। ইজারাদার মোশারেফ হোসেন সুমনের দাবী, চর কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ জেহাদ হোসেন সপ্তাখানেক আগে তার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবী করেছিলেন। চাঁদা না দিলে চরের পানি কমিয়ে ফেলবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন। যেই কথা সেই কাজ।
চরের উঁচু জমির ধান নষ্ট হবে এমন কারণ দেখিয়ে সাধারণ সম্পাদক ইজারাকৃত চরে মেশিন লাগিয়ে পানি কমানো শুরু করেন। ক্রমাগত পানি কমতে কমতে পানির ঘনত্বের তুলনায় মাছের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় দেখা দেয় অক্সিজেন সংকট। ধানের উঁচু জমি থেকে ময়লা পানি চরে নেমে আসায় হতে থাকে পানি দূষণ।
পানি কমানোর দু'দিন পর কয়েকটি মাছ মারা যাওয়ায় ইজারাদার সুমন চরের পানি বাড়াতে পানির পাম্প লাগান। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। রাত প্রায় ১১টায় সাধারণ সম্পাদক মোঃ জেহাদ হোসেন দল বল নিয়ে ভেঙ্গে ফেলে পানির পাম্প। সাধারণ সম্পাদকের আপন ভাই ইমাম হোসেন কুঠার দিয়ে কুপিয়ে অচল করে ফেলেন পাম্প মেশিন। সে রাতেই ফের নিজেদের মেশিন লাগিয়ে চরের পানি আরও কমিয়ে ফেলা হয়। ফলে একের পর এক মাছ মারা যেতে থাকে।
এভাবে ৩০ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত নিধন হয়েছে অন্তত ৫০ লাখ টাকার মাছ! মাছগুলো প্রথমে ঘুরপাক খায় পরে কয়েকটি ডিগবাজি দিয়ে মারা যায়, চলে যায় পানির নিচে। একদিনের ব্যবধানে পঁচে ভেসে উঠছে পানিতে।
মাছ নিধনের এ কাজে চর কমিটির সভাপতির কোন সম্পৃক্ত ছিলো না বলে নিশ্চিত করেছেন ইজারাদার সুমন। তিনি বলেন, সভাপতি মোশারেফ হোসেন রুনু চেয়েছিলেন, ধানও বাঁচুক, মাছও বাঁচুক। কিছু সংখ্যক ধান রক্ষার জন্য ইজারাদারের লাখ টাকার মাছ নষ্ট করার পক্ষে তিনি ছিলেন না। সাধারণ সম্পাদককে ৫ লাখ টাকা দিতে পারেনি বলেই আজ তার এতো বড় সর্বনাশ হলো।
এ বিষয়ে চর কমিটির সভাপতি মোশারেফ হোসেন রুনু চাঁদপুর কণ্ঠকে জানান, আমরা যেহেতু স্ট্যাম্পের উপর সাইন দিয়ে ৪০ লাখ টাকার বিনিময়ে ১ বছরের জন্য সুমনকে চর ইজারা দিয়েছি কাজেই আমরা চাইলেই তার চাষাবাদে হন্তক্ষেপ করতে পারি না। বিষয়টি সমাধানের জন্য আমি সাধারণ সম্পাদক জেহাদকে আমার সাথে দেখা করতে বলেছিলাম। সে দেখা করেনি। জেহাদ যদি সুমনের কাছে টাকা চায় তবে তা যেমন অন্যায়, তার চর থেকে পানি কমানো বা পাম্প মেশিন ভেঙ্গে ফেলাটাও চরম অন্যায়। আমি অসুস্থ থাকায় এ বিষয়ে কিছুই অবগত ছিলাম না।
ইজারাদার সুমনের কাছে সেক্রেটারি জেহাদ ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবী করার সময় উপস্থিত ছিলেন প্রজেক্ট ম্যানাজার মোঃ মিছির আলী। তিনি চাঁদপুর কণ্ঠকে বলেন, সেক্রেটারি আমার সামনে ইজারাদারের কাছে ৫ লাখ টাকা দাবী করে। টাকা না দেয়ায় তিনি এমন জঘণ্য কাজ করেছেন। বিগত দিনেও তিনি এমন কাজ করেছেন। আমার কাছ থেকে একবার ২৫শ' টাকার মাছ নিয়ে আমাকে ২৫ পঁসাও দেয় নাই। টাকা চাইলে সেক্রেটারির পাওয়ার দেখায়।
অভিযুক্ত মোঃ জেহাদ হোসেন মুঠোফোনে চাঁদপুর কণ্ঠকে বলেন, সুমনের পাম্প মেশিন ভাঙ্গার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। মূলত কৃষকদের ধান যেন নষ্ট না হয় সে জন্য আমি কৃষকদের পক্ষে ছিলাম। 'ইজারা দেয়ার সময় যখন ৪০ লাখ টাকা নিয়েছিলেন সেই চুক্তিনামায় ধান রক্ষার কোন শর্ত ছিলো কি-না?' - জানতে চাইলে তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে জানান ছিলোনা।
'জানুয়ারি মাসে ইজারাদার ৪০ লাখ টাকা দেয়ার পর এপ্রিল মাসে আবার ৫ লাখ টাকা চাঁদা চাইলেন কেন?' -এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি কোন চাঁদা চাইনি। 'আপনি যাদের সামনে ৫ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছেন তারা সাক্ষি দিয়েছে। সবাই কী মিথ্যা বলছে?' - এমন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মোবাইলের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। তারপর পূনরায় তাকে ফোন দিলেও কল রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলা মৎস কর্মকর্তা মোসাঃ ফারহানা আক্তার রুমা বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। এই মাছগুলো ঘিরে একজন মৎসচাষীর কত শত স্বপ্ন থাকে। অথচ নিমিষেই সব শেষ। ৫ তারিখ অফিস খুললে আমরা বিষয়টি সরেজমিন তদন্ত করবো। আপাতত ভুক্তভোগী থানায় একটি জিডি করে ইউএনও স্যারকে লিখিত অভিযোগ দিয়ে রাখলে ভালো হয়।
ফরিদগঞ্জ থানা অফিফিসার ইনচার্জ মোঃ শহীদ হোসেন বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি। তবে এখন পর্যন্ত লিখিত কোন আবেদন পাইনি। ভুক্তভোগী আবেদন করলে অবশ্যই প্রকৃত দোষীকে আইনের আওতায় আনা হবে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসলিমুন নেছা চাঁদপুর কণ্ঠকে জানান, আমি ফরিদগঞ্জ থানায় ফোন করে বলছি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। আমার কাছে লিখিত অভিযোগ আসলে অবশ্যই এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।