শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫  |   ৩৪ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে নেতাকর্মীদের ঢল

প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৫, ০৭:১০

বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার খেলায় অতিষ্ঠ ফরিদগঞ্জে পল্লী বিদ্যুতের দেড় লক্ষাধিক গ্রাহক

যে বাতাসে লুঙ্গি উড়ে না, সে বাতাসেই বিদ্যুৎ চলে যায়’

প্রবীর চক্রবর্তী
বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার খেলায় অতিষ্ঠ ফরিদগঞ্জে পল্লী বিদ্যুতের দেড় লক্ষাধিক গ্রাহক

জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে প্রাকৃতিকভাবেই ক্রমশ আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে। শীতের সময় শীত পড়ছে না, গরমের সময় ধারণার চেয়ে বেশি গরম পড়ছে। বৃষ্টিও হচ্ছে না সময়মতো, যাতে অন্তত দুর্বিষহ গরম থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতো মানুষগুলো। সপ্তাহের শেষদিন বৃহস্পতিবার (১৫ মে ২০২৫)। সকাল থেকেই সূর্যের উত্তাপ ভালোভাবেই গায়ে লাগা শুরু হয়। আগের দিন বুধবার (১৪ মে ২০২৫) বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি কিছুটা স্বস্তি এনে দিলেও পরদিন সকালে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। যদিও বিকেলের দিকে সূর্য আড়ালে চলে যাওয়ায় তীব্র গরম থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পাওয়ার কথা। কিন্তু ভ্যাপসা গরম তা হতে দেয়নি। ফলে নাভিশ্বাস উঠে জনজীবনে।

এর সাথে নিত্যদিনের সঙ্গী বিদ্যুতের ভেল্কিবাজি। সরকারি অফিস এবং জনগুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলো থাকায় উপজেলা সদরে অপেক্ষাকৃত বেশি বিদ্যুৎ পেলেও বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার ভেল্কিবাজি তাদের হরহামেশা দেখতে হচ্ছে। বৃহস্পতিবার (১৫ মে ২০২৫) সকাল থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অন্তত ১৪/১৫ বার উপজেলা সদরের লাইনটি ট্রিপ করেছে--এই আসে এই যায়। একই অবস্থা চলছে প্রায় একমাস ধরেই। দিনে-রাতে একই অবস্থা, আসা-যাওয়ার খেলা চলছেই। তবে শহর ছাড়িয়ে গ্রামের অবস্থা আরো ভয়াবহ। গ্রামাঞ্চলের লোকজন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় থাকেন। ফলে তারা গরমে ঘামে একাকার হয়ে যায়। যদিও চাঁদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর আওতাধীন কামতা সাবস্টেশন ওভারলোডের কারণে তারা চাহিদার তুলনায় ৬০ ভাগ বিদ্যুৎ পাচ্ছে এবং বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দিতেও হচ্ছে বলে জানায়। অপরদিকে ফরিদগঞ্জ জোনাল অফিস বলছে, তারা চাহিদা অনুযায়ী পুরো বিদ্যুৎই পাচ্ছে। শুধুমাত্র লো-ফ্রিকোয়েন্সির কারণে বাধ্য হয়ে পর্যায়ক্রমে শাটডাউন করতে হচ্ছে।

আবহাওয়া দপ্তরের সূচি অনুযায়ী, সারাদেশে চলছে দাবদাহ। সেই অনুযায়ী ফরিদগঞ্জে টানা তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলছে তাপমাত্রা বাড়ার প্রতিযোগিতা। প্রচণ্ড খরতাপে পুড়ছে প্রকৃতি। সূর্যের প্রখরতায় তপ্ত কড়াইয়ের মতো তেঁতে উঠেছে পথঘাট। এরই মধ্যে তাপমাত্রার পারদ ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁই ছুঁই। এই অসহনীয় গরমের মধ্যে বিদ্যুতের আসা-যাওয়া খেলার ভোগান্তিতে উপজেলার দেড় লক্ষাধিক বিদ্যুতের গ্রাহক। গড়ে দিনে-রাতে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। বিঘ্ন হচ্ছে হাটবাজার ও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা। তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষগুলো।

চাঁদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর ফরিদগঞ্জ জোনাল অফিস সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৬ লক্ষাধিক মানুষের বসবাসের এই উপজেলাটিতে ফরিদগঞ্জ জোনাল অফিস ও একই উপজেলার আওতাধীন কামতা জোনাল অফিস মিলিয়ে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার বিদ্যুৎ গ্রাহক রয়েছে। এর মধ্যে ফরিদগঞ্জ জোনাল অফিসের ২১ মেগাওয়াটের চাহিদার তারা সবটুকুই পাচ্ছে। অন্যদিকে কামতা জোনাল অফিসের চাহিদার ১৩ মেগাওয়াটের বিপরীতে ওভারলোডের চাহিদার তুলনায় ৭/৮ মেগাওয়াট পাচ্ছে। যদিও মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন। দিনেরাতে বিদ্যুতের আসা-যাওয়া চলছেই। কখনো কখনো এক ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ৪/৫ বার আসা-যাওয়া করছে। এপ্রিল মাস থেকেই পর্যায়ক্রমে তা বেড়ে চলছে।

পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক গাজীপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. মমিনুল ইসলাম বলেন, দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা ঠিকমতো ৫ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। একটু বাতাস দেখলেই টানা কয়েক ঘণ্টা আমাদের বিদ্যুৎ সেবার বাইরে থাকতে হয়। যে বাতাসে লুঙ্গি উড়ে না, সে বাতাসের ভয়েই বিদ্যুৎ চলে যায়।

শাহজাহান গাজী নামে পশ্চিম পোয়া এলাকার আরেক গ্রাহক বলেন, সারাদিনে কতবার যে বিদ্যুৎ যায়, তার হিসেব নেই। দিনে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টাও আমরা বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। লোডশেডিংয়ের কারণে বাচ্চাদের পড়ালেখার অনেক ক্ষতি হচ্ছে।

কলেজ পড়ুয়া আব্দুর রহমান ও স্কুল পড়ুয়া তাওহীদুল ইসলাম বলেন, গরমের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে কোথাও পড়তে বসতে পারি না। বিদ্যুতের সমস্যা দ্রুত সমাধান করা জরুরি।

পৌর এলাকার কাউসার আলম, ইকবাল হোসেন, শাহাদাত হোসেনসহ আরো কয়েকজন গ্রাহক বলেন, আর কতো সহ্য করবো আমরা! বিদ্যুৎ আসে আর যায়। এতে আমাদের ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী নষ্ট হচ্ছে। এর দায় কে নেবে?

সাথী আক্তার, মোহছেনা বেগম, পিংকি আক্তারসহ কয়েকজন গৃহবধূ বলেন, আগে বিদ্যুতের লোডশেডিং হলেও আমাদের এমন কষ্ট হতো না। রাতের বেলা বিদ্যুৎ চলে গেলে বাচ্চারা গরমে কান্না শুরু করে দেয়। বাচ্চাদের সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়। এভাবেই চলছে প্রতিদিন।

বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জনবহুল ফরিদগঞ্জে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে আরো কয়েকটি সাবস্টেশন নির্মাণ করতে হবে। গত কয়েক বছর পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ গৃদকালিন্দিয়া ও রূপসাসহ ৩/৪টি স্থানে অন্তত ৪টি সাবস্টেশন নির্মাণের জন্যে জায়গা খুঁজলেও অদ্যাবধি তারা খুঁজে পায়নি (!)। ফলে লো-ফ্রিকোয়েন্সি ও ওভারলোডের যন্ত্রণায় বাড়ছে বিদ্যুতের শাটডাউন। তাদের ভাষ্যমতে, আরো কয়েকটি সাব-স্টেশন নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুতের ফিডারগুলোর আরো বেশি বিভাজনের মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু কবে নাগাদ হবে, তা কেউই বলতে পারছে না।

সম্প্রতি রূপসা জমিদার পরিবারের সদস্য ও বর্তমান মোতাওয়াল্লী সৈয়দ মেহেদী হাসান চৌধুরী রূপসা এলাকায় পল্লীবিদ্যুতের সাব-স্টেশনের জায়গা বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে জানান, একটি জায়গা তাদের দেখিয়েছিলাম। তারা সেখানে ২২ শতক কিনলেও আমি নিজে ১০ শতক দান করার কথা বলেছি। কিন্তু তাদের থেকে রেসপন্স অদ্যাবধি পাইনি।

এদিকে বিদ্যুতের বর্তমান অবস্থার বিষয়ে ফরিদগঞ্জ জোনাল অফিসের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ নাজির উল্লাহ বলেন, আমাদের চাহিদা ২১ মেগাওয়াটের বিপরীতে ২১ মেগাওয়াটই পাচ্ছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে লো-ফ্রিকোয়েন্সির কারণে বিদ্যুৎ শাটডাউন করে। এছাড়া এই কারণে জাতীয় গ্রিড থেকেও লাইন বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।

কামতা জোনাল অফিসের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার অনিক নাথ বলেন, আমাদের কামতা সাব-স্টেশনের বিদ্যুতের চাহিদা ১৩ মেগাওয়াট, যা রামগঞ্জ গ্রিড থেকে প্রদান করা হয়। বর্তমানে রামগঞ্জ গ্রিডে চাহিদা ১৫৫ মেগাওয়াট থাকলেও ওভারলোডের কারণে তারা ১১৫ মেগাওয়াট পর্যন্ত নিতে পারে। পরে রেশনিং করে আমাদের বিদ্যুৎ দেয়ায় আমাদের লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিগত রমজানের সময় কিন্তু আমরা লোডশেডিং মুক্ত ছিলাম।

পল্লী বিদ্যুতের ফরিদগঞ্জ জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. সাইফুল আলম বলেন, আমি এই স্টেশনে মাত্র যোগদান করেছি। তাই এই এলাকার বিষয়ে সবটুকু জনি না। তবে বিদ্যুৎ পাওয়া না পাওয়ার বিষয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ আংশিক সত্য। আমাদের বিদ্যুৎ ঘাটতি নেই। লো-ফ্রিকোয়েন্সির কারণে বিদ্যুতের বারংবার শাটডাউন হচ্ছে। এছাড়া উপজেলায় আরো কয়েকটি বিদ্যুতের সাব-স্টেশনের জন্যে জায়গার বিষয়ে কাজ চলছে। এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়