শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

একজন করোনাযোদ্ধার প্রস্থান ও স্মৃতিতে তার অবয়ব
কবির হোসেন মিজি

জন্মিলে মরিতে হবে, এইতো নিয়ম খোদার দুনিয়ায়, তুমি যেমনি করে চলে গেলে, তেমনি করে কেউ কি বলো যায়...? মৃত্যু চিরন্তন সত্য এমন গানের কথার মতোই। আজ শোকাহত মনে বলতে হচ্ছে, আপনি যেভাবে হঠাৎ চলে গেলেন। এভাবে চলে যাওয়াটা কখনো কাঙ্ক্ষিত ছিলো না প্রিয়। কেনো আমাদের সবাইকে অদেখা দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে এভাবে হঠাৎ নিরবে চলে গেলেন? কী এমন অভিমান জমা ছিলো আপনার মনে ? কী এমন তাড়া ছিলো বুঝতে কষ্ট হয়। বিধাতা যে এতো দ্রুত আপনাকে ডেকে নিবেন এমনটা ভাবিনি কখনো, কোনোদিন। তবে এ যাওয়া শেষ যাওয়া হলেও আপনি চিরদিনই স্মৃতিতে বেঁচে থাকবেন অগণিত মানুষের মনের মণিকোঠায়। আপনি একজন মানবিক চিকিৎসক, একজন করোনা যোদ্ধা, একজন সেবক, একজন সহযোদ্ধা, একজন ভাই কিংবা বন্ধু। আবার আপনি আমার এবং আমাদের কেউ নন। তবুও যেনো কতো আপন, ভালোবাসার নিবিড় বন্ধনে কতো গভীর সম্পর্ক জড়িয়ে আছে আপনার সাথে। আপনার হঠাৎ প্রস্থানে যেনো মনের গভীরে অনবরত ঝর্না ঝরে পড়ছে। আপনি নেই...! একথা ভাবতেই যেনো মনের ভেতর কী এক শূন্যতা বিরাজ করছে। যে শূন্যতা কখনো পূরণ হবার নয়। রুবেল ভাই বেঁচে নেই...! কী আশ্চর্য বিষয়--বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে। হাত-পাগুলো খাটো হয়ে আসছে, বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে বারংবার। মৃত মুখখানা চোখে পড়তেই মনে হচ্ছে আপনি ঘুমিয়ে আছেন। সময় মতো জেগে উঠবেন। আবার মানুষের সেবায় বাসা থেকে গাড়ি করে দ্রুত পৌছবেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। এপ্রোন পরে রোগীদের বুকের ওপর পেশার মেশিন রেখে পরীক্ষা শেষে প্রেসক্রিপশন লিখে দিবেন। রোগীরা সুস্থ হয়ে আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে আপনাকে দু’হাত ভরে দোয়া করবেন। হয়তোবা আমার মতো করে এমন কাল্পনিকভাবেই আপনি মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।

সেদিন আমি চাঁদপুরের বাইরে। প্রথম একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর কল পেয়ে জানতে পারলাম, রুবেল ভাইয়ের অবস্থা তেমন ভালো না। তিনি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। তখনই বুকের ভেতর কেমন কম্পন শুরু হলো। সাথে সাথে ডাঃ মাহমুদুন্নবী মাসুম ভাই, ডাঃ ফরিদ আহমেদ চৌধুরী এবং বন্ধু ডাঃ ফেরদৌস নূরকে কল দিলাম। কেউই রিসিভ করছিল না। রুবেল ভাইয়ের অবস্থার সঠিক খবরটা পেতে পাগলের মতো ক’জনকে নক করলাম। এক সময় ডাঃ ফরিদ ভাই কল দিয়ে বললেন, অবস্থা তেমন একটা ভালো না, তিনি লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন, শেষ চেষ্টা চলছে। তখনই আল্লাহর কাছে ভাইয়ের নেক হায়াত কামনা করে সকলের দোয়া চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। এর মাঝে একে একে সবাই তার মৃত্যুর সংবাদ পোস্ট দিচ্ছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না এবং সঠিক খবরটি পাচ্ছি না বলে কোনো পোস্ট দেইনি। কিন্তু ভাবিনি ১৫/২০ মিনিট পরেই আবার এই হাত দিয়ে ডাঃ রুবেল ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদের পোস্ট দিতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফরিদ ভাই কল করে জানালেন, রুবেল ভাই জীবিত নেই। কথাটা শুনতেই স্তব্ধ গয়ে গেলাম। চোখে মুখে হতাশার ছাপ, কান দিয়ে যেনো গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে। অবুঝের মতো অবলা হয়ে প্রিয় রুবেল ভাইয়ের প্রেফাইল থেকে একটি ছবি বেঁচে নিয়ে কোনোরকম পোস্ট করলাম। চলেই গেলেন প্রিয় ডাঃ সুজাউদ্দৌলা রুবেল ভাই। আর বেশি কিছু লিখতে পারলাম না। কী লিখবো তখন, তার কোনো ভাষা খুঁজে পাইনি। আমি যেনো এমন দুঃসংবাদে হতভম্ব হয়ে গেলাম।

যেভাবে এই প্রিয় মানুষটির সাথে আমার সু-সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো--

কোনো একদিন দ্বি-প্রহরে হঠাৎই জিন্সের পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটি বেজে উঠলো। একটি অপরিচিত নম্বর। রিসিভ করে সালাম দিয়ে অপর প্রান্তের কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পারলাম খুব প্রিয় এবং সুপরিচিত একজন মানুষ। ওপাশ থেকে বললেন, এই কবির, আমি ডাঃ সুজাউদ্দৌলা, কোথায় আছো তুমি...?-জ্বি ভাই আমি শহরেই আছি। তুমি একটু বেলভিউ হাসপাতালে আসো তো। তোমাকে একটা নিউজ করতে হবে। ওকে ভাই, আসতেছি। প্রায় আধাঘন্টা পর বেলভিউ হাসপাতালের তৃতীয় তলায় রুবেল ভাইয়ের চেম্বারের সামনে গিয়ে তার দরজা নক করতেই তিনি মৃদু হেসে বললেন, বসো। তারপর ভালো একটি সত্য সংবাদ করার জন্যে ভাই আমাকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে বললেন, তুমিও তোমার মতো করে সত্যটা যাচাই করে নিও। সেই থেকে নিজের মোবাইলফোনের গ্যালারিতে ডাঃ সুজাউদ্দৌলা রুবেল নামে তার নাম্বারটি সেভ করে রাখা হয়। ক’দিন পর ভাইয়ের দেয়া সেই তথ্য অনুযায়ী সংবাদটি প্রকাশিত হলে পত্রিকা নিয়ে তার কাছে গেলে তিনি আমার করা সংবাদটির বেশ প্রশংসা করে খুশি মনে আমাকে হাজার দুয়েক টাকা ধরিয়ে দিলেন। আমিও মহা খুশিতে সেদিন থেকেই ভাইকে ভীষণভাবে ভালোবেসে ফেলি। তারপর থেকেই ডাঃ রুবেল ভাইয়ের সাথে আমার সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। আমার ফোন নাম্বারটিও ভাইয়ের ফোনটিতে সেভ করা ছিলো। তাই প্রায় বিভিন্ন বিষয়ে তিনি আমাকে কল দিতেন। আমিও হাসপাতাল সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে লিখলে রুবেল ভাইয়ের বক্তব্য এবং পরামর্শ নিতাম। এভাবেই চলতে থাকলো কয়েকটি বছর।

ডাঃ সুজাউদ্দৌলা রুবেল ভাই বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি আড়াইশ’ শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসারের (আরএমও) দায়িত্বে থাকার কারণে প্রায়ই স্থানীয় সংবাদকর্মীরা বক্তব্য নেয়ার জন্য তার কক্ষে প্রবেশ করতেন। সবার সাথে আমিও তাই করতাম। এ সুবাদে তার টেবিলের সামনে বসে প্রায় বিভিন্ন গল্প কথা হতো। আর এমন ভালোবাসার সম্পর্কের কারণে মহামারী করোনাকালীন সময় প্রিয় রুবেল ভাই যে কতটা কষ্ট করে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন সে দৃশ্য প্রতিদিন কাছ থেকে তা দেখেছি। যখনই তার কক্ষে উঁকি দিতাম, তখনই দেখতে পেতাম হাজারো করোনার রিপোর্টের কাগজ তার সামনে টেবিল জুড়ে উঁচু হয়ে আছে। আর সেই কাগজগুলো তিনি একে একে মার্কার কলমের আঁচড়ে চিহ্নিত করতেন--কোন্টা নেগেটিভ আর কোন্টা পজিটিভ। এর মাঝে আমাদের মতো সংবাদকর্মী, আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিতজনদের তাগিদ থাকতো, যাতে তাদের রিপোর্টটি একটু আগে দেয়া হয়। এতো ব্যস্ততার মাঝেও কখনো কারো আবদার অধিকার তিনি এড়িয়ে যেতেন না। সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত এমন কঠিন ব্যস্ততার মাঝেও কখনো তিনি পরিচিতজনদের সাথে বিরক্তি দেখাতেন না। এমন ভয়াবহ মহামারীতে মানুষের কল্যাণে কাজ করতে দেখে তিনি হয়ে উঠেন একজন মানবিক চিকিৎসক। ধীরে ধীরে নির্দ্বিধায় মানুষের মনের গভীরে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। তাই হয়তো তার মৃত্যুর সংবাদ শোনার মুহূর্তেই চাঁদপুরবাসীর ফেসবুক জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তার মৃত্যুর খবর এবং তার প্রতি শোক ও শ্রদ্ধা। এ মৃত্যু যেনো কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি চিকিৎসক সমাজসহ চাঁদপুরবাসীও। এমন একজন মানবিক চিকিৎসকের মৃত্যুতে সেদিন সর্বত্র ছিলো গভীর শোকের ছায়া। যা এখনো অনেকের মনে দাগ কেটে যায়।

করোনাবালীন থেকে শুরু করে যখনই তার কক্ষের গ্লাসটা টেনে সালাম দিতাম, তখনই রুবেল ভাই মুচকি হেসে বলতেন, কি রে তোর খবর কি...? কিছু বলবি...? আচ্ছা তাহলে ফ্রি হলে আসিছ। আবার কখনো কখনো কোনো সংবাদের বিষয়ে বলতেন, তুই পরে কল দিস্, আমি জানিয়ে দিবো। এছাড়াও অনেক সময় তিনি নিজেও কল দিয়ে বলতেন, এই কবির একটু দেখা করিস তো। একদিন আমার একজন রোগীকে ঢাকা রেফার করার বিষয়ে ভাইয়ের সাথে দুটি কথা বলেছিলাম। তখন রুবেল ভাই আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো অধিকার খাটিয়ে চিকিৎসার বিষয়ে বুঝিয়ে বলে শাসনের মতো রাগারাগি করেছিলেন। আমি তাতে মোটেও কষ্ট পাইনি। তার ক’দিন পরেই একদিন তার এবং আমার পরিচিত একজন মানুষ নিয়ে তার চেম্বারে যেতেই বললেন, কবির তো আমার খুব কাছের মানুষ। ওরে ঐদিন অনেক বকা দিয়েছি। ওরে ভালোবাসি তো, তাই বকা দিলাম। এরে তুই কি রাগ করেছিস...?.. না ভাই মোটেও না। আমার হাসিমুখে এমন উত্তর শুনে রুবেল ভাই হেসে বললেন--ঠিক আছে তুই বস্, আমি একটু উনার সাথে কথা বলি। এসব স্মৃতি আজ বার বার হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে এসব ভাবতেই যেনো শরীর শিউরে উঠে। আর কখনো, কোনোদিন এমন করে কথা বলা হবে না প্রিয় মানুষটির সাথে। আর কখনো কোনো আবদার অধিকার নিয়ে তার সামনে দাঁড়াতে পারবো না। আর কখনোই দেখা হবে না প্রিয় মুখখানি।

ওপারে ভালো থাকবেন প্রিয়জন। আপনার ডাক্তারি জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এবং করোনাকালীন সময়ে যেসব মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন, এমন মানবসেবার উচিলায় যেনো মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনার জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়ে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করেন। -আমিন।

ফুল ফুটে ঝরে যায়, এই তো রীতি, মানুষ মরে যায়, রেখে যায় স্মৃতি.....! তেমনি ভাবে আপনি পৃথিবীর বাগান থেকে ঝরে পড়লেও আপনার রেখে যাওয়া ভালো কাজ এবং মানবসেবার জন্য মানুষের মনে স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।

কবির হোসেন মিজি : সংবাদকর্মী, গীতিকার ও লেখক, চাঁদপুর।

মোবাইল : ০১৭১৭৫২০২৭৩

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়