প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
খাল ভরাট : ১১ বছর ধরে জলাবদ্ধতা ॥ হুমকিতে চাষাবাদ
বর্ষাকালে এক সময় যে খাল দিয়ে ছোট ও মাঝারি আকারের নৌকা চলাচল করতো, যে খালটিতে একসময় নদী থেকে জোয়ার-ভাটার পানি আসতো, বর্ষার পানির সঙ্গে পলি এসে বাড়তো জমির উর্বরতা, যে খাল দিয়েই সরতো আশপাশের এলাকার অতিরিক্ত পানি, যে খালটির ওপর নির্ভর করে প্রতি বছর তিন ফসলের আবাদ করতেন খালের পাশের কৃষকগণ, সে খালটি আজ খালের প্রকৃত অবয়বে নেই।
চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০নং লক্ষ্মীপুর (সাবেক সাখুয়া ইউনিয়ন)-এর সিআইপি বাঁধবেষ্টিত পশ্চিম রামদাসদী গ্রামে অবস্থিত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী রামদাসদী-সাখুয়া ওয়াপদা খাল। এটি সরকারি খাল নামেই পরিচিত। শতবর্ষী খালটি মেঘনা নদীর সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত ছিল । খালটি মৃতপ্রায় এক যুগ ধরে । খালনির্ভর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকা, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, নিরাপদ পানির যোগান হুমকির মুখে পড়েছে ।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রামদাসদী-সাখুয়া ওয়াপদা সরকারি খালটি রামদাসদী মৌজায় জেএল নং ৯৪ আরএস দাগ ২৭৭ সহ আশেপাশের অনেক দাগের মধ্যে অবস্থিত । মেঘনা নদীর সাথে সংযুক্ত খালটি ড্রেজার দ্বারা বালু ভরাট করার কারণে খালের (উত্তর-দক্ষিণ) সামনের একাংশে মিজান রাজের বাড়ি থেকে মেঘনা নদীর পাড় পর্যন্ত দুশ মিটারে পানিপ্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে । আর বাকি অংশ নাব্যতা হারানোয় পানিপ্রবাহ হচ্ছে চরম বাধাগ্রস্ত এবং নদীর সাথে পানি প্রবাহ না থাকায় খালের বাকি অংশে বছরের পর বছর জলাবদ্ধতা থেকে যায় । ফলে খালের দূষিত পানি জলজ স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্যের জন্যে ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
জানা যায়, ১০নং লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের আট নং ওর্য়াডের পশ্চিম রামদাসদীতে মেঘনা নদীর পাড়ে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ২০১৩ সালে রামদাসদী আশ্রয়ণ প্রকল্প নামে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শুরু করা হয় । কিন্তু প্রকল্প এলাকার অভ্যন্তরে নির্ধারিত জায়গায় ড্রেজার দ্বারা বালু ভরাট করার সময় খালের পূর্ব পাশে কোনো সুরক্ষা বাঁধ (গাইড ওয়াল) তৈরি না করে খালটির একাংশ প্রকল্প ঠিকাদার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আঁতাত করে জোরপূর্বক রাতের আঁধারে ভরাট করে ফেলেন । এতর খালের সঙ্গে মেঘনা নদীর যে যোগাযোগ ছিল তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । এখানে পূর্বে যে খাল ছিল তা এখন বোঝার উপায় নেই । এমনকি তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের মন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও তার ভাই ডা. জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদ টিপুর ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তৎকালীন ১০নং লক্ষীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ৫ আগস্ট গণপিটুনিতে নিহত সেলিম খান (বালু সেলিম) অবৈধভাবে খালের সামনের অংশে বাঁধ তৈরি করে ফেলেন, যা এখন পরিত্যক্ত । এ ছাড়া ভরাটকৃত খাল খনন না করায় অত্র এলাকায় জন্মেছে আগাছা ও গাছগাছালি।
স্থানীয় সমাজসেবক বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্যাংকার মোঃ মুজিবুর রহমান বলেন, শতবর্ষী খালটি খননের মাধ্যমে সংশিষ্ট এলাকার জলাবদ্ধতা স্থায়ীভাবে নিরসন করতে হবে। এতে একই সঙ্গে ঐতিহ্য ও পরিবেশ রক্ষা পাবে। তিনি সিএস ম্যাপ অনুযায়ী জরুরিভাবে যাতে খাল খনন ও সংরক্ষণ করা হয় সেই দাবি জানিয়েছেন । এ ছাড়াও খালের মুখে যে বাঁধ তৈরি করা হয়েছে তার অপসারণ চেয়েছেন ।
খালটির ওপর নির্ভরতার প্রসঙ্গ তুলতেই স্থানীয় পশ্চিম রামদাসদী গ্রামের কৃষক মোতালেব গাজী, উত্তম মজুমদার সহ আরো অনেকে বলেন, যুগ যুগ ধরে কৃষিকাজ করছি। জমিতে তিন পর্যায়ে আলু, শাকসবজি, ধান, পাট এবং জ্বালানি হিসেবে ধইঞ্চা ইত্যাদি চাষ করতাম । অত্র এলাকায় ফসল উৎপাদনে খালটি আমাদের একমাত্র ভরসা ছিল। কিন্তু বৃষ্টির সময় আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে বালু আবাদি জমিতে প্রবেশ করে এবং সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে । বছরের অধিকাংশ সময় ফসলি জমিতে জলাবদ্ধতা রয়ে যায়। গত কয়েক বছর আর তিন ফসল করা যাচ্ছে না। এমনকি শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে বীজতলা তৈরি করতে অনেক সমস্যা হচ্ছে ।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, ২০-২৫ ফুট চওড়া খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১.৫ কিলোমিটার । দোকানঘর বাজারের সাথে সংযুক্ত চাঁদপুর-হাইমচর সিআইপি বেড়িবাঁধের পশ্চিমণ্ডদক্ষিণ একাংশ ও দোকানঘর রামদাসদী আশ্রয়ণ প্রকল্প হয়ে রহিম হাওলাদার বাড়ি, বানিয়া বাড়ি, মনা মেম্বার বাড়ি, বীর মুক্তিযোদ্ধা দুলাল কর বাড়ি, আবদুল্লাহ মিজি বাড়ি, ইন্দ্র মোহন মজুমদার বাড়ি, আবুল জমাদার বাড়ি, খালেক মেম্বার বাড়ি, রহমান পাটওয়ারী বাড়ি, কালু পাটওয়ারী বাড়ি, মিজান খান বাড়ি হয়ে শতবর্ষী খালটি মেঘনা নদীর সঙ্গে মিশেছে। অত্র এলাকাবাসী এবং কৃষকগণ শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই রামদাসদী-সাখুয়া ওয়াপদা সরকারি খালটি রক্ষায় দ্রুত পুনঃ খননপূর্বক পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।