প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার চাঁদপুর সরকারি কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী। ১৯৭৯ সালে তিনি এ কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে এই কলেজে ১৯৮৮ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। দুই বছর সফলতার সাথে শিক্ষকতা করে পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত।
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য। এছাড়াও কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কমিটিসহ চাঁদপুর জেলার বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতি কমিটি ও এমপিও যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য।
‘চাঁদপুর সরকারি কলেজের ৭৫ বছরপূর্তি : প্রাক্তন শিক্ষার্থীর মুখোমুখি’ শীর্ষক দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার পর্বে আজ অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদারের কথা তুলে ধরা হলো।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলায়। রামগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করি। রামগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করি। এ দুটি প্রতিষ্ঠান আমার পূর্বপুরুষগণ প্রতিষ্ঠা করেন। রামগঞ্জ কলেজ (বর্তমানে রামগঞ্জ সরকারি কলেজ) থেকে ১৯৭৯ সালে এইচএসসি পাস করি।
এইচএসসি পরীক্ষার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চারুকলা ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগে উত্তীর্ণ হই। কিন্তু চট্টগ্রামে আর যাওয়া হয়নি। আমার জেঠিমা চাঁদপুর মাতৃপীঠ স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। তিনি আমাকে চাঁদপুরে নিয়ে আসেন। ১৯৭৯ সালে চাঁদপুর সরকারি কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হই। ১৯৮১ সালে আমি বিএসসি পাস করি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি পরীক্ষা দিই। সেখানে আমি প্রাণিবিদ্যা ও ভূগোলে সুযোগ পাই। যদিও আমার প্রিয় বিষয় ছিলো উদ্ভিদবিদ্যা। পরে আমি ভূগোল বিভাগে ভর্তি হই। ১৯৮৩ সালে মাস্টার্স পাস করি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কত সালে, কোন্ শ্রেণিতে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন?
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : ১৯৭৯ সালে চাঁদপুর সরকারি কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হই।
চাঁদপুর কণ্ঠ : সে সময় কলেজের পরিবেশ কেমন ছিলো?
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : সে সময় অসাধারণ এক শিক্ষার পরিবেশ ছিলো চাঁদপুর সরকারি কলেজে। এখন হয়তো অনেক ভবন হয়েছে, সে সময় এতো ভবন ছিলো না। তখন অনার্স কোর্স ছিলো না, ছিলো শুধু ইন্টারমিডিয়েট ও ডিগ্রি পাস কোর্স। ৪৭ জন শিক্ষক ছিলেন। ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে আমি শিক্ষক হিসেবে চাঁদপুর সরকারি কলেজে যোগদান করি। সে সময় সপ্তম বিসিএসে দশজন নতুন শিক্ষক যোগদান করেন। এর মধ্যে আমি একজন নবীন। এজন্যে তৎকালীন শিক্ষার্থীরা রসিকতা করে বলতো, ‘ওরা এগারো জন’। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমি যে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণ করেছি, সেই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করা চাট্টিখানি কথা নয়! নিঃসন্দেহে অতুলনীয় ব্যাপার। যেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সান্নিধ্যে পড়াশোনা করেছি, তাঁরাই পরবর্তীতে আমার সহকর্মী হন-এ বিষয়টি আমাকে বিমোহিত করতো।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার প্রিয় শিক্ষক এবং সহপাঠী ছিলেন কারা? তাদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : স্কুলে পড়াবস্থায় আমাদের বাড়িতে একজন শিক্ষক থাকতেন। শ্রদ্ধেয় নারায়ণ স্যার। শুধু পাঠ্যবইয়ের পড়া নয়, জীবনমুখি নানা শিক্ষা আমি স্যারের কাছ থেকে গ্রহণ করি। স্যার বিএসসির শিক্ষক ছিলেন। আমাকে বাংলা, ইংরেজি ও সায়েন্সের বিষয় পড়াতেন। রামগঞ্জ কলেজে পড়াবস্থায় বাংলা বিভাগের বীরেন্দ্র স্যার ছিলেন আমার ভীষণ প্রিয়। স্যার ছিলেন অসাধারণ মেধা ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন নানা গুণের মানুষ। আসলে ও রকম শিক্ষক বর্তমানে কল্পনা করা যায় না। রামগঞ্জ কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ স্যার আমার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হওয়ার পর যাঁরা আমাকে পড়িয়েছেন তাঁরা আমার আইডল। শ্রদ্ধেয় তাজুল ইসলাম স্যার, শ্রদ্ধেয় বদিউর রহমান চৌধুরী স্যার, শ্রদ্ধেয় মোস্তাক স্যার, শ্রদ্ধেয় আকবর হোসেন স্যার এবং ভূগোল বিভাগের মোজাম্মেল স্যার ছিলেন অনুকরণীয়। শ্রেণিকক্ষে কীভাবে শিক্ষার্থীদের পড়াতে হবে, তা কিন্তু ওইসব স্যারের কাছ থেকে আমি শিখেছি। শ্রদ্ধেয় তাজুল ইসলাম স্যার ক্লাসে শুধু ড্রইং করতেন আর বুঝিয়ে দিতেন। ফলে বাসায় এসে আর পড়ার প্রয়োজন হতো না। শ্রদ্ধেয় আকবর হোসেন স্যারও একই। প্রাণিবিদ্যার মোস্তাক স্যার হাতে-কলমে শিখিয়েছেন। ড্রইং শিখিয়েছেন ধরে ধরে। শ্রদ্ধেয় বদিউর রহমান স্যার তো ছিলেন অসাধারণ। স্যার চোখ বুঁজে ক্লাস নিতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলে যেতেন। কোনো তাড়াহুড়ো ছিলো না। আর শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের মাঝেও একঘেঁয়েমি কাজ করতো না। বদিউর রহমান স্যার ও মোস্তাক স্যারসহ শ্রদ্ধেয় অনেক শিক্ষক জীবিত রয়েছেন। তাজুল ইসলাম স্যার প্রয়াত হয়েছেন। স্যারদের কথা আমি জীবনেও ভুলতে পারবো না। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবস্থায় বহু গুণী শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করেছি। যাঁরা আমার আইডল। বর্তমানে অনেকেই জীবিত আছেন, অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন। তন্মধ্যে প্রফেসর ড. এ কিউ এম মাহবুব স্যার (বর্তমানে গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি), নাসরিন আক্তার শিলু আপা (পরে ঢাকা বিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি হন), যিনি ক্লাসে অত্যন্ত যত্ন-আদর সহকারে পড়াতেন ও জোহরা আপা (বর্তমানে প্রয়াত) ছিলেন অসাধারণ মেধার অধিকারী মানুষ। তাঁরাই হলেন আমার অনুকরণীয়। বর্তমানে যা-ই করি, সব কিছু তাঁদের কাছ থেকে শেখা। ওই সমস্ত শিক্ষক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার!
চাঁদপুর সরকারি কলেজে পড়াবস্থায় ১০৫ জন সহপাঠী ছিলো আমাদের। এর মধ্যে ৭ জন ছিলো মেয়ে। ক্লাসের সবার সাথেই তো বন্ধুত্ব, এর মধ্যে বিশেষ করে আমার সাথে পানু গোপাল পাল (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরিরত), মনোজ আচার্যী (কৃষি ব্যাংকে চাকুরি করতো), সুমিত, সুভাষ (প্রাইমারি স্কুলে চাকুরি করে), রতন (সুইডেন প্রবাসী), সফিউল্লাহ, রবীন্দ্র, বোরহানউদ্দিন (কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে কর্মরত) এদের সাথে সত্যিকার অর্থে আত্মার সম্পর্ক ছিলো।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজ জীবনের উল্লেখযোগ্য কোনো সুখের এবং দুঃখের স্মৃতির কথা জানতে চাই, যা আজও আপনার মনে পড়ে।
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : সুখের অনেক স্মৃতি। মাত্র দু বছর চাঁদপুর সরকারি কলেজে পড়াশোনা করি। প্রত্যেকটা ক্লাসই ছিলো সুখের স্মৃতি। এখনো যদি সেই ক্লাসের পাশ দিয়ে যাই মনে পড়ে ফেলে আসা সোনালি স্মৃতির কথা। মনে শিহরণ জাগে। চাঁদপুর সরকারি কলেজে পড়াবস্থায় আমি গাঙ্গুলিপাড়ায় থাকতাম। যা ছিলো কলেজ থেকে হাঁটার দূরত্ব। উন্মুখ থাকতাম কখন ক্লাসে যাবো। স্যারদের ক্লাসের কথা সারাক্ষণ মাথায় ঘুরতো। অত্যন্ত অনুতাপের বিষয়, বর্তমানে দেখি অনেক শিক্ষার্থীই ক্লাসের প্রতি আগ্রহী না। কিন্তু সে সময় আমরা ছিলাম ক্লাসমুখি। কখন ক্লাসে বসে স্যারদের কথা শুনবো এই মনোবাসনা ছিলো আমাদের। সত্যিকার অর্থে বলতে এটাই ছিলো সুখের স্মৃতি। এছাড়া অনেক সুখের স্মৃতি আছে। বিরতির সময় আমরা একসাথে গান গাইতাম। জম্পেশ আড্ডা হতো। আড্ডা কখনো কলেজ মাঠে, কখনো ২১/২২ নম্বর রুমে। আমার বন্ধু মনোজ খুব ভালো গান গাইতো। হারমোনিয়াম বাজাতে পারতো না সে, খালি গলায় গান গাইতো। পরে সে বাংলাদেশ বেতারে গান গাইতো। ভালো শিল্পী হয়েছে। সে এখন বলে, কলেজ জীবনের সে গান গাওয়াই তাকে শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেছে। এগুলো আমার সুখের স্মৃতি। ল্যাব ক্লাসগুলোও আমার সুখের স্মৃতি। শ্রদ্ধেয় তাজুল ইসলাম স্যার, মোস্তাক স্যার আমাদের হাতে ধরে শিখিয়েছেন, যা আমার সুখের স্মৃতি। তাঁরা ছিলেন জাত (আসল) শিক্ষক। এখন আমরা যতোজন শিক্ষকতা করি, আমি জানি না, আমরা কতটুকু জাত (আসল) শিক্ষক। আমরা কতটুকু শিক্ষক হতে পেরেছি আমার জানা নেই। তবে আমার বিবেচনায়, ওই স্যারেরা ছিলেন জাত (আসল) শিক্ষক। সেটা ক্লাসে হোক কিংবা ক্লাসের বাইরে। শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে নার্সিং করা তৎকালে প্রতিটি শিক্ষকের প্রচেষ্টা ছিলো। ওই সমস্ত শিক্ষক বর্তমানে অকল্পনীয়। যতোই দিন যায়, ওই মানের শিক্ষক পাওয়া দুষ্প্রাপ্য হয়ে যায়।
দুঃখের স্মৃতির কথা যদি বলি, ১৯৮১ সালে বিএসসির তিন বিষয় পরীক্ষা দেয়ার পর অপ্রীতিকর এক ঘটনায় চাঁদপুর সরকারি কলেজ পরীক্ষা কেন্দ্রটি স্থানান্তর করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে বাকি পরীক্ষা আমাদেরকে সেখানে গিয়ে দিতে হয়েছে। চাঁদপুর থেকে ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষা দেয়া সহজ ছিলো না। খুবই কষ্টের ছিলো সে সময়টা। আমাদের ১০৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে শেষ পর্যন্ত মাত্র ৩৩ জন পরীক্ষা দিয়েছিলাম। এর মধ্যে পাস করেছি মাত্র ৫ জন। একমাত্র আমি সেকেন্ড ডিভিশন পাই। ধারণা ছিলো, আমি ফার্স্ট ক্লাস পাবো। এটি একদিকে যেমন সুখের, আবার দুঃখেরও।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজে পড়াবস্থায় নিজেকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখতেন?
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : স্বপ্ন ছিলো চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় সে স্বপ্নপূরণ হয়নি। কিন্তু আমার দুজন সহপাঠী চিকিৎসক হয়েছেন। আগেই বলেছি, শিক্ষাজীবনে আমি অসাধারণ মেধাবী ও নিষ্ঠাবান শিক্ষকদের সান্নিধ্য লাভ করেছি। তাঁদের দেখে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আমার আগ্রহ জন্মে। তাঁরাই আমার আইডল। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই শিক্ষকতা পেশায় আছি। মূলত যে যেটা স্বপ্ন দেখে, সে সেটাই পায়। যেটা আমি আমাকে দিয়ে বুঝি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : শিক্ষকতা পেশার উল্লেখযোগ্য স্মৃতি সম্পর্কে জানতে চাই।
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : ১৯৮৩ সালে মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার পর রাজনৈতিক কারণে আমাদের ফলাফল পেতে সময় লাগে। সে সময় আমি চাঁদপুর থেকে বাড়ি চলে যাই। তখন চাঁদপুর কলেজ ‘সরকারি কলেজে’ রূপান্তর হয়ে যায়। তৎকালীন অধ্যক্ষ এ ডাব্লিউ এম তোয়াহা মিয়া স্যার পোস্টকার্ডে আমাকে চিঠি লিখলেন। সেখানে স্যার লিখলেন, ‘চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভূগোল বিভাগে একজন শিক্ষক প্রয়োজন। তুমি আগামীকালই এসে আমার সাথে দেখা করো’। পরদিনই আমি চাঁদপুরে এসে স্যারের সাথে দেখা করি। কলেজে স্যারের রুমে ঢুকে আমার বুকের কাঁপুনি ধরে গেলো। কেননা যাঁদের সান্নিধ্যে আমি শিক্ষাগ্রহণ করেছি, আজ সেই শ্রদ্ধাভাজন স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি শিক্ষকতা করবো এজন্যে। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, শ্রদ্ধেয় তাজুল ইসলাম স্যার, শ্রদ্ধেয় বদিউর রহমান চৌধুরী স্যার, শ্রদ্ধেয় শামসুদ্দিন স্যার, শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আজাদ স্যার বসে ছিলেন। স্যার বললেন, আমাকে ক্লাস নিতে হবে। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। সাথে সাথে আমাকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হলো। বেতন নির্ধারণ করা হয় আটশ’ টাকা। এটি ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসের ঘটনা। আমি ওইদিনই কলেজে যোগদান করলাম। স্যার আমাকে ক্লাসে নিয়ে গেলেন। চাঁদপুর সরকারি কলেজের তিনতলার ২২ নম্বর রুমে ভূগোল ডিপার্টমেন্টে নিয়ে স্যার আমাকে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস। প্রায় আড়াইশ’ শিক্ষার্থী ক্লাসে। শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আগেই বলেছি, তৎকালে কলেজে ভূগোল বিভাগের কোনো শিক্ষক ছিলেন না। প্রথম ক্লাসের সেইদিনের স্মৃতি আমার আজও মনে পড়ে। একজন নবীন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীরা আমাকে কীভাবে গ্রহণ করে এ নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলাম। যা হোক, আমি ক্লাস শুরু করি। ম্যাপ নিয়ে বোর্ডে কালার পেনসিল দিয়ে ড্রয়িং করলাম। পুরো ক্লাসে একেবারে পিনপতন নীরবতা। এই স্মৃতিটা আমার এখনো মনে আছে। ক্লাস শেষে অধ্যক্ষ স্যারের রুমে গেলাম। স্যার বললেন, ‘থ্যাংকস্। তোমার ভেতরে শিক্ষকতার গুণ রয়েছে’। দু বছর আমি সেখানে কর্মরত ছিলাম। পরে আমি পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি। বর্তমানে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজের ক্লাস এবং আড্ডাবাজির স্মৃতি সম্পর্কে কিছু বলুন।
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : আমাদের সময় স্যারেরা যথাসময়ে ক্লাসে আসতেন। অত্যন্ত চমৎকারভাবে আমাদেরকে পড়াতেন। স্যারদের আমরা ভয় পেতাম, যে ভয়টা আসলে শ্রদ্ধার ভয়। একেবারে পেছনের সিটে বসা শিক্ষার্থী পড়া বুঝতে পারছে কিনা সেটিও খেয়াল করতেন। কেউ পড়া না বুঝলে শিক্ষকরা হাতে-কলমে বোঝাতেন। কিন্তু বর্তমান শিক্ষকদের সে দায়বদ্ধতা কতটুকু আছে সেটা আমার জানা নেই। সে সময়ের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন। কেননা শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের দায়বদ্ধতা না থাকলে শিক্ষার্থী ভালোভাবে পড়া বুঝতে পারে না। আমাদের সময় কলেজে নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। মঞ্চনাটকে অংশ নিতাম। চাঁদপুর সরকারি কলেজের অ্যাসেম্বলি রুমে আমরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতাম। এখন কি শিক্ষার্থীরা এসব করে? মঞ্চনাটক করে? আমার মনে হয়, এদিক থেকে আমরা অনেকটা পিছিয়ে গেছি। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা কমতে শুরু করেছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : বর্তমানে কলেজে এলে কোন্ স্মৃতি বেশি মনে পড়ে?
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : আমার বিরল সৌভাগ্য, যে কলেজে আমি পড়াশোনা করেছি, সেই কলেজে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এটি সবার ভাগ্যে হয় না। যখনই আমি কলেজে যাই, আমি মনে করি এটি আমার প্রাণের কলেজ। বর্তমানে আমি হয়তো পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ, কিন্তু আমার সেকেন্ড হোম চাঁদপুর সরকারি কলেজ। পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজের উন্নতি যেমন আমাকে অনুপ্রাণিত করে, ঠিক অবনতি আমাকে কষ্ট দেয়। ঠিক চাঁদপুর সরকারি কলেজের বেলায়ও একই। চাঁদপুর সরকারি কলেজের যে কোনো সাফল্য আমাকে অনুপ্রাণিত করে, আবার খারাপ কিছু আমাকে ভীষণ ব্যথিত করে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজের ৭৫ বছরপূর্তিতে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : অসাধারণ অনুভূতি। চাঁদপুর সরকারি কলেজের ৭৫ বছরপূর্তি, এটি কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়! এই কলেজের ইতিহাস বড় গৌরবের। এ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। যে কলেজে আমি পড়াশোনা করেছি, শিক্ষকতা করেছি, সে কলেজের ৭৫ বছরপূর্তিতে অংশীদার হতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার দৃষ্টিতে চাঁদপুর সরকারি কলেজ কেনো সেরা?
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : সন্তান তার মাকে শ্রেষ্ঠ মা-ই বলে। যে কলেজ আমাকে এতোটুকু দিয়েছে, সে কলেজ তো আমার মায়ের মতোই। আমি চাঁদপুর সরকারি কলেজেরই সন্তান। চাঁদপুর সরকারি কলেজ আমাকে যশ দিয়েছে, খ্যাতি দিয়েছে, পরিচিতি দিয়েছে। বলতে পারেন, স্কুল জীবন কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি তা দেয়নি? আমি বলবো, অবশ্যই দিয়েছে। কিন্তু চাঁদপুর সরকারি কলেজের দেয়া পরিচিতি আমার কাছে অমূল্য।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজটি নিয়ে আপনার প্রত্যাশা/স্বপ্ন কী?
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : চাঁদপুর সরকারি কলেজ নিয়ে আমার প্রত্যাশা অনেক। আগেই বলেছি, চাঁদপুর সরকারি কলেজের যে কোনো সাফল্য আমাকে অনুপ্রাণিত করে, আবার খারাপ কিছু আমাকে ভীষণ ব্যথিত করে। আমার প্রত্যাশা, চাঁদপুর সরকারি কলেজ বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। আমি বিশ্বাস করি, ভালো ফলাফলই একটি কলেজের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় বহন করে না, সর্বদিকে সাফল্য তথা উন্নতিই হলো শ্রেষ্ঠত্ব। মোটকথা, শিক্ষা উপযোগী উন্নত পরিবেশ ধারণ করে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গড়ে উঠতে হবে। এ রকম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমি চাঁদপুর সরকারি কলেজকে দেখতে চাই।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজ জীবনের উল্লেখযোগ্য অর্জন কী?
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : চাঁদপুর সরকারি কলেজে পড়াবস্থায় অসাধারণ শিক্ষকদের সান্নিধ্য লাভ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে মনে করি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে সেকেন্ড ডিভিশন অর্জন করায় অধ্যক্ষ এ ডাব্লিউ এম তোয়াহা স্যার তাঁর রুমে নিয়ে অন্য স্যারদের সামনে আমার প্রশংসা করেন, যা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কোন্ কোন্ সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন?
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : চাঁদপুর সরকারি কলেজে পড়াবস্থায় সায়েন্স ক্লাবের সাথে যুক্ত ছিলাম।
চাঁদপুর কণ্ঠ : নতুনদের উদ্দেশ্য কিছু বলুন।
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : একজন শিক্ষক হিসেবে নতুন প্রজন্ম নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। তাদেরকে স্বপ্ন দেখাতে চাই। এ প্রজন্ম ইচ্ছে করলে বাংলাদেশকে বদলে দিতে পারে। এজন্যে প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ। সে পরিবেশ নিশ্চত করতে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছে গেছেন। আর তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ জাতিকে এক অনন্য উচ্চতায় গিয়ে যাচ্ছেন। তার অংশদীরই আমরা এবং এই প্রজন্ম। এ প্রজন্মের প্রতি আমার কথা, প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ও মিশনের সাথে আমাদের নিজেদের সম্পৃক্ত করবো। আমরা বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্নের সোনার বাংলা দেখেছেন তা বাস্তবায়ন করবো। এখন আমাদের সামনে ভিশন-২০৪১ সাল, স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশে আমরা একটি স্মার্ট দেশ চাই, স্মার্ট সোসাইটি চাই, স্মার্ট হিউম্যানিটি চাই অর্থাৎ সবকিছু স্মার্ট চাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পারবেন, তিনি পেরেছেন। আমাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগীর ভূমিকায় থাকতে হবে। তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান, উন্নয়নের সারথি হয়ে বাংলাদেশকে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চাই।
চাঁদপুর কণ্ঠ : উল্লেখিত প্রশ্নের বাইরে আপনার কোনো কথা থাকলে বলুন।
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার : আমি একজন শিক্ষক। প্রজন্ম নিয়েই আমার কাজ। প্রজন্মের সামনে ভিশন রেখে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে পদ্মাসেতু হয়েছে। মেট্রোর যুগে বাংলাদেশ। কর্ণফুলী টানেল হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে। ফলে বহির্বিশে^ বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। পৃথিবীতে এতো সুন্দর দেশ আছে বলে আমার জানা নেই। আমাদেরকে উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু অপশক্তির কারণে আমরা পিছিয়ে যাই। এই প্রজন্মের কাছে আমার আহ্বান, কোনো প্রকার অপশক্তির কাছে পরাজিত হওয়া যাবে না। সকল প্রকার অপশক্তি প্রতিহত করে আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।