প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
ফারুক হোসেন। সাবেক সচিব, শিশু সাহিত্যিক ও ছড়াকার। তিনি চাঁদপুর সরকারি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। ১৯৭৮ সালে তিনি এই কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই কলেজের দু বছরের জীবন তাঁর ভাষায় তাঁর সেরা সময়ের অন্যতম। তিনি মনে করেন, চাঁদপুর কলেজ তাঁর বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিদ্যাপীঠ।
ফারুক হোসেনের জন্ম ১৯৬১ সালের ১ জানুয়ারি হাজীগঞ্জের প্রতাপপুর গ্রামে। প্রতাপপুর প্রথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা ও বলাখাল জেএন হাইস্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। চাঁদপুর কলেজে শিক্ষা শেষে তিনি বিএসসি অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা পানি ও জলবায়ু বিভাগ থেকে। এরপর বিসিএস সচিবালয় (পরবর্তীতে প্রশাসন) ক্যাডারে ১৯৮৫ ব্যাচে (৭ম ব্যাচ) যোগদান করেন ১৯৮৮ সালে।
সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব ফারুক হোসেন সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান ছিলেন। চাকরি জীবনে তিনি স্বরাষ্ট্র, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, জনপ্রশাসন, খাদ্য, বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, স্বাস্থ্য, অর্থ, পাট, মহিলা ও শিশু এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। মাঠপর্যায়েও তিনি বিভিন্ন স্তরে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি সচিব পদ থেকে চাকুরি থেকে অবসরগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি পরামর্শক হিসেবে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে যুক্ত আছেন।
‘চাঁদপুর সরকারি কলেজের ৭৫ বছরপূর্তি : প্রাক্তন শিক্ষার্থীর মুখোমুখি’ শীর্ষক দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার পর্বে আজ ফারুক হোসেনের কথা তুলে ধরা হলো।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চাই।
ফারুক হোসেন : আমার জন্ম হাজীগঞ্জ উপজেলার প্রতাপপুর গ্রামে। এটিই আমার পূর্বপুরুষের ভিটা। যথারীতি প্রতাপপুর প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করি। বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবী। চাকুরিতে তাঁর বদলির কারণে ১৯৭১ সালে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা হাইস্কুলে। শুরু হলো স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্ব এবং মুক্তিযুদ্ধ। সে সময় ফিরে এলাম প্রতাপপুরে। যুদ্ধ শেষ হলো। পেলাম স্বাধীন দেশ-বাংলাদেশ। অটোপ্রমোশনে ক্লাস সেভেনে উঠলাম এবং হাইস্কুল জীবন শুরু করলাম হাজীগঞ্জের বলাখাল জেএন হাইস্কুলে। শৈশবের সময়টা ছিলো কখনও রঙিন কখনও মলিন। মাত্র তিন বছর বয়সে ১৯৬৪ সালের ২৯ নভেম্বর মাতৃহারা হলাম। জীবনের সবচেয়ে মলিন ক্ষণ। আর ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট হারালাম আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ককে। এই দুটি ঘটনা ব্যক্তিজীবন ও জাতীয় জীবনের মধ্যে বার বার টেনে এনেছে অবারিত সংগ্রাম আর সংগ্রাম। জীবন হয়ে ওঠে প্রতিনিয়ত এক যুদ্ধের-সংগ্রামের। ১৯৭৬ সালে এসএসসির পর ১৯৭৬-৭৭-এ চাঁদপুর কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র হলাম। পড়েছি সি (বিজ্ঞান বিভাগ) সেকশনে। ১৯৭৮ সালে অর্জন করলাম এইচএসসি। শৈশবের ঘটনার শেষ নেই। বললে অনেক কথা। তবে এটা বলতে পারি, জন্ম যাই হোক না কেনো, বেড়ে ওঠা নিজের জন্য, পরিবারের জন্য অনেক সংগ্রামের। আবার শৈশবের মধ্যে হাতছানি দেয় অনেক সম্ভাবনা, অনেক স্বপ্ন। কলেজ অব্দি সঠিকভাবে পৌঁছার পেছনে থাকে অনেক অনিশ্চয়তা। এই কলেজই ইঙ্গিত দিতে পারে জীবনের লক্ষ্য কী হবে, কী হতে যাচ্ছে। আমি বেড়ে উঠেছি আদরে, অনুগ্রহে, ভালোবাসায়। বড় হয়ে বড়দের কাছে শুনেছি, আমার শৈশব না কি শান্ত নদীর চাইতেও শান্ত। শান্ত নদীতেও একটু একটু ঢেউ থাকে। আমার মধ্যে তার ছিলো না। এ রকম শান্ত হয়ে থাকা শৈশব অপ্রত্যাশিত। শৈশব হবে দুরন্ত। অফুরন্ত চঞ্চলতার। তার মধ্য দিয়েই হয়ে ওঠে বিকাশ।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কত সালে, কোন্ শ্রেণিতে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন?
ফারুক হোসেন : ১৯৭৬-৭৭ সেশনে চাঁদপুর কলেজে ভর্তি হই। একাদশ (বিজ্ঞান) শ্রেণিতে। সি সেকশনে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : সে সময় কলেজের পরিবেশ কেমন ছিলো?
ফারুক হোসেন : শিল্প, সংস্কৃতি ও শিক্ষা সবদিক থেকেই ছিলো মনের মতো একটি পরিবেশ। এক দল শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ছিলেন, যাঁরা প্রজ্ঞা, জ্ঞান সব মিলিয়ে ছিলেন আকাশছোঁয়া ব্যক্তিত্ব। তাঁদের ভালোবাসা, স্নেহ ও অভিভাবকত্ব আমাদের প্রতিনিয়ত বিনয়ী করে রেখেছে। একদল বন্ধু ছিলো, যাদের সান্নিধ্য মুগ্ধ করে রেখেছিলো কলেজ জীবনকে। আর ক্যাম্পাস ছাত্রদের পদচারণায় ছিলো মুখর। আমি হোস্টেলে ছিলাম না। এক বছর বলাখাল থেকে ট্রেনে এসে ক্লাস করেছি। তারপর নাজিরপাড়া মেসে থেকেছি। কিন্তু জানি, হোস্টেলও ছিলো মধুর আবাসের একটি জায়গা। কলেজের পুরো পরিবেশটিই ছিলো একটি পরিবারের মতো-ভালোবাসা মায়া-মমতায় ভরা এক নিরাপত্তার চাদরে আবৃত।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার প্রিয় শিক্ষক এবং সহপাঠী ছিলেন কারা? তাদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
ফারুক হোসেন : আমার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন ইংরেজির শিক্ষক এবিএম ওয়ালিউল্লাহ স্যার, পদার্থ বিজ্ঞানের হাসান হায়দার স্যার, বোটানীর শিক্ষক তাজুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক বদিউর রহমান চৌধুরী। রসায়নের শিক্ষক মান্নান স্যারের ফান করা ও ক্লাস জমিয়ে রাখার কৌশল ভোলার নয়।
সহপাঠীদের মধ্যে সাইফুদ্দিন, রতন, ডিউক, জাহাঙ্গীর, মঞ্জু, সাজু, মমিন, তৈমুর, আহমেদ ফারুক হাসান, নয়ন এরাই ছিলো কাছের। জাহাঙ্গীর আমার খুব প্রিয় একজন বন্ধু ছিলো। সে-ই আমাকে কলেজে থাকতে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত করে রাখতো। সে পরে হয়ে উঠলো বড় একজন চারুশিল্পী। তার সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম চাঁদের হাটে। জাহাঙ্গীর আঁকতো, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। কলেজ জীবনে সে ছোটদের জন্য আঁকাআঁকির আয়োজন করতো বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে। জাহাঙ্গীরের উদ্যোগে বেরুতো দেয়ালপত্রিকা। তাতে প্রকাশিত হতো আমার কবিতা, ছড়া। আমরা একদল ছিলাম, চাঁদপুর কলেজ মাঠের একজিবিশনে বিজ্ঞান স্টল চালাতাম। বিজ্ঞানের চমক দেখাতাম সেখানে। চোর ধরার যন্ত্র, ভ্যানিশিং কালার ইত্যাদি নানা কিছু দিয়ে মাতিয়ে রেখেছি দর্শকদের।
নাজিরপাড়া যে মেসে থাকতাম সেখানেও কিছু বন্ধু জুটলো, যারা অন্য সেকশনে/বিভাগে পড়তো। মোশতাক, গিয়াস, আফতাব স্মৃতিতে ওরা এখনও অম্লান। আফতাব পৃথিবী ছেড়ে অনেক আগেই চলে গেছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজ জীবনের উল্লেখযোগ্য কোনো সুখের এবং দুঃখের স্মৃতির কথা জানতে চাই, যা আজও আপনার মনে পড়ে।
ফারুক হোসেন : কলেজ জীবনটি আমার সংগ্রামমুখর। বাবা চাকরি করতেন বিএডিসিতে। ভালো না লাগার কারণে চাকরি তিনি ছেড়ে দিলেন। যুক্ত হলেন চাঁদপুরের লেডি প্রতিমা মিত্র হাইস্কুলের শিক্ষক হিসেবে। বাবা ইসলাম শিক্ষা, ইংরেজি, অংকসহ অনেক বিষয়ে ভালো পড়াতেন। বাবাকেও দেখেছি সারাক্ষণই এক সংগ্রামী মানুষ হিসেবে। জীবন যুদ্ধে তাঁকে সবসময়ই ব্যস্ত দেখেছি। বাবার স্কুলে পড়তো চাঁদপুর সদর থানার ওসির মেয়ে, ক্লাস নাইনে। তাদের বাসা ছিলো আমার মেসের কাছে। মেসের সামনে দিয়েই তাকে অতিক্রম করতে হতো স্কুলে যাওয়া আসার পথে। বাবা জানলেন সেই মেয়েটি আমাদের মেসের কাছেই থাকে। আর তাই বাবা নিজে কষ্ট করে না এসে মেয়েটির কাছে আমাকে টাকা পাঠাতেন। মেয়েটি রাস্তায় মেসের সামনে বরাবর এসে থেমে গেলে আমি বুঝতাম, সে আমাকে কিছু দেবে। আমি টাকা পেয়ে যতটা না খুশি হতাম তার চাইতে বেশি খুশি হতাম যখন মেয়েটি হাত বাড়িয়ে আমাকে খামটা তুলে দিতো। মনে হতো ওটা টাকার খাম নয়, প্রেম পত্র। আজ মেয়েটির নাম এবং চেহারাও মনে পড়ে না। অথচ ঘটনাটি মনে পড়ে গেলো-এই সাক্ষাৎকারের সুবাদে। বলতে পারেন এটি সুখের স্মৃতি।
দুঃখের স্মৃতি আছে, যা আজ মনে পড়ে। ওই সময় আমার কঠিন টাইফয়েড হয়েছিল। গ্রামের বাড়িতে মাসাধিককাল বিছানায় পড়েছিলাম। প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। অনেক ক্লাস ছেড়ে দিতে হলো আমাকে। আমি পড়াশোনায় অনেক পিছিয়ে গিয়েছিলাম।
এর মধ্যে সুখ পেয়েছিলাম, ওয়ালিউল্লাহ স্যার একাধিকবার আমাকে মেসে দেখতে গিয়েছিলেন। নিয়মিত পরামর্শ দিতেন , এখন শরীর ঠিক রাখতে আমার কী করা উচিত এবং কি খাওয়া উচিত। আমার প্রতি স্যারের ওই কেয়ারিং আচরণ আমাকে আনন্দ দিয়েছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজে পড়াবস্থায় নিজেকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখতেন?
ফারুক হোসেন : স্বপ্ন ছিলো চিকিৎসক হবো। সবার যেমন থাকে। স্বপ্ন ছিলো বড় লেখক হবো। এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে আমার ওই সময়ের স্বপ্নগুলো ছিলো খুবই বিক্ষিপ্ত ও অপরিণত। আসলে তেমন করে স্বপ্নই দেখতে পারিনি, যে স্বপ্ন চিন্তাপ্রসূত ও দূরদর্শী। এক কথায় যা বলে, আমার কাছে সেরকম কোনো স্বপ্নই ধরা দেয়নি। ছিলাম কপালে যা আছে তাই হবে-এই নীতি নির্ভর অনেকটা।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজের ক্লাস এবং আড্ডাবাজির স্মৃতি সম্পর্কে কিছু বলুন।
ফারুক হোসেন : চাঁদপুর কলেজের সকল শিক্ষক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা সেই সময় ছিলো প্রাণবন্ত ও মুখর। ছাত্রদের আনাগোনায় ক্লাস ও ক্লাসের বাইরে ছিলো সারাক্ষণই উৎসবের মতো। কোন্টা আড্ডা আর কোন্টা ক্লাস কখনও কখনও গুলিয়ে ফেলেছি। মোটের উপর দুবছরের কলেজ জীবন ছিলো উল্লাসের, উৎসবের, উচ্ছ্বাসের।
চাঁদপুর কণ্ঠ : বর্তমানে কলেজে এলে কোন্ স্মৃতি বেশি মনে পড়ে?
ফারুক হোসেন : মনে পড়ে একদিন ক্লাসরুমের ঘটনা। এবিএম ওয়ালিউল্লাহ স্যার আমাকে একটি সহজ প্রশ্ন করেছিলেন এই প্রত্যাশা নিয়ে যে, আমি তাঁর উত্তর অবশ্যই দিতে পারবো। কিন্তু আমি ভুল উত্তর দিয়েছিলাম। খুব দুঃখ পেলেন ওয়ালিউল্লাহ স্যার। প্রশ্নটি আজ আমার মনে নেই। স্যার আমার দিকে হাতের চক ছুড়ে মেরেছিলেন। চকটি গিয়ে পড়লো আমার পেছনের ছাত্রের গায়ে। এতে স্যার খুব বিব্রত হলেন। দোষ করলো কে আর শাস্তি দিলাম কাকে। এই ঘটনাটি আমার খুউব মনে পড়ে। কলেজের পাশ দিয়ে যখন অতিক্রম করি, মনে পড়ে সেদিনের সেই ক্লাসের কথা। ওয়ালিউল্লাহ স্যারের কথা।
মনে পড়ে হেড ক্লার্ক আমজাদ ভাইয়ের কথা। তার ছিলো কাতুকুতু রোগ। দূর থেকে আঙুল নাড়লেও তিনি হাসতে শুরু করতেন। একবার কাতুকুতুর মতো করে আঙুল নাড়তে নাড়তে আমরা তার কাছে যেতেই তিনি শুয়ে পড়েছিলেন।
আর মনে পড়ে আমার ক্লাসমেট বন্ধু নজরুলের কথা। নজরুল আমার সবচাইতে কাছের বন্ধু ছিলো। তাদের একটি কনফেকশনারি ছিলো চাঁদপুরেই। পলি কনফেকশনারি। আমি আমার এই বন্ধুটিকে হারিয়ে ফেলেছি। কোনো যোগাযোগ নেই। কোথায় আছে তাও জানি না । আমি তাকে খুঁজে পেতে চাই।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজের ৭৫ বছরপূর্তিতে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
ফারুক হোসেন : চারপর্বের আমাদের শিক্ষাজীবন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। এদের মধ্যে কলেজ জীবনটি নানা দিক থেকে বিশিষ্ট। কলেজ জীবনে গড়ে ওঠে নিজের উপর নির্ভরতা, আত্মবিশ্বাস, অনেকটাই স্বাধীন সত্তার উপস্থিতি, কিছুটা বন্ধন থেকে মুক্ততা। সময়টা কম, মাত্র দুবছর, কিন্তু মধুর। এই সময়টায় ছিলো নিজেকে প্রস্ফুটিত করার সময়। অল্পসময়ের মধ্যে বন্ধুরা, ক্লাসমেটরা হয়ে উঠেছিলো খুব আপন। কলেজ জীবনের সংস্কৃতি তাই জীবনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। আর জীবনের যে কোনো সময় এই বন্ধুদের, কলেজ ক্যাম্পাসে সম্মিলন, স্মৃতিচারণ, স্মৃতি রোমন্থন, কলেজের সীমানায় উপস্থিত হয়ে পুরানো দিনের উপলব্ধি-এ এক অসাধারণ সময় ও যা আনন্দ সমৃদ্ধ। তাই ৭৫ বছর পূর্তি আমার জন্য এক পরম ও প্রিয় এক্সসাইনমেন্ট।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার দৃষ্টিতে চাঁদপুর সরকারি কলেজ কেনো সেরা?
ফারুক হোসেন : আমার বাবা যেমন আমার কাছে সেরা, আমার মা যেমন আমার কাছে সেরা, আমার শিক্ষাঙ্গনও আমার কাছে সেরা। আর তাই চাঁদপুর সরকারি কলেজ আমার কাছে সেরা।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজটি নিয়ে আপনার প্রত্যাশা/স্বপ্ন কী?
ফারুক হোসেন : আমার স্বপ্ন ও প্রত্যাশা হচ্ছে, চাঁদপুরের ইলিশের মতোই চাঁদপুর কলেজ বিশ্বায়নে খ্যাতিমান হোক। দেশের সেরাদের মধ্যে অন্যতম হোক। বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ুক এই কলেজের নাম।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কলেজ জীবনের উল্লেখযোগ্য অর্জন কী?
ফারুক হোসেন : লেখক হয়ে ওঠা। বলা যায় কলেজই আমাকে লেখালেখির পথ দেখিয়েছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কোন্ কোন্ সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন?
ফারুক হোসেন : চাঁদের হাট, শুধুমাত্র চাঁদের হাট।
চাঁদপুর কণ্ঠ : নতুনদের উদ্দেশ্য কিছু বলুন।
ফারুক হোসেন : পরিবারের পাদপীঠের পরেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কলেজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে স্পর্শকাতর সন্ধিক্ষণ। এই সময় শুদ্ধ হয়ে ওঠা বা নষ্ট হয়ে যাওয়া-দুটোরই সম্ভাবনা থাকে। মনে রাখতে হবে, রেজাল্ট নয়, নৈতিকতা, পরিমিতিবোধ, ভালোবাসার উপলব্ধিই এগিয়ে দিতে পারে শীর্ষে যাবার পথে। আর তাই রেজাল্টের পেছনে দৌড়ের পাশাপাশি মানুষ হয়ে ওঠার জন্য দৌড়াতে হবে। কলেজ সেই দৌড়কে অনেকভাবেই সহজতর করে দেয়।
চাঁদপুর কণ্ঠ : উল্লেখিত প্রশ্নের বাইরে আপনার কোনো কথা থাকলে বলুন।
ফারুক হোসেন : ভবিষ্যতের দিনগুলোতে চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে বেরিয়ে আসবে বহু কিংবদন্তি মানুষ। যারা চাঁদপুরের ইলিশের মতো ছড়িয়ে দেবে রূপালি আলো। রূপালি আলো হচ্ছে শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য, আবিষ্কার, গবেষণা, কূটনীতি, প্রশাসন, রাজনীতি-সব ক্ষেত্রে যারা ছড়িয়ে যাবে এবং ছড়িয়ে দেবে দেশের অগ্রগতির আলো। চাঁদপুর সরকারি কলেজকে সেরকম একটি জায়গায় দেখতে চাই।
উল্লেখ্য, ফারুক হোসেন সরকারি ক্রয় ব্যবস্থাপনা, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ও দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। দেশে সরকারি ক্রয় পদ্ধতি সংস্কারের শুরু থেকেই তিনি এই বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন একজন প্রশিক্ষক হিসেবে। ২০০৭-এ তিনি জাতীয় প্রশিক্ষক ও ২০০৯-এ ইউকেভিত্তিক চ্যার্টাড ইন্সটিটিটিউট ফর সাপ্লাই অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট (CIPS)-এর রিসোর্স পারসন হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০১১ থেকে তিন বছর তিনি পিপিপি ইউনিটের প্রধান হিসেবে অর্থ বিভাগে কাজ করেন এবং পিপিপি লিগ্যাল, ইন্সটিটিটিউশানাল এবং ফাইনেন্সিং ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের সরকারি ক্রয় ব্যবস্থাপনায় নোডাল অফিস হিসেবে কার্যকর সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (CPTU)-এর মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করেন এবং বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক প্রকিউরমেন্ট পদ্ধতি বাস্তবায়ন করেন। তিনি সরকারি ক্রয় বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন আইটিসি-আইএও ও ইটালির তুরিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
বাংলা ছড়া ও শিশু সাহিত্যে ফারুক হোসেন একটি অনিবার্য নাম। ৭০ দশক থেকে তিনি লেখালেখিতে যুক্ত। তিনি প্রধানত ছড়াকার। ছড়াযাপনে তিনি পেয়েছেন স্বতন্ত্র স্বর, পেয়েছেন জনপ্রিয়তা। তার ছড়া, গল্প ও অন্যান্য রচনায় সফল ও কার্যকরভাবে উঠে এসেছে দেশ, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে : শ্রেষ্ঠকণ্ঠ বজ্রকণ্ঠ (ছড়া), মুজিব বাইয়া যাওরে (গল্প), ছড়ায় বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন (ছড়া) ও গল্পে বঙ্গবন্ধু (গল্প)। সম্পাদনা করেছেন বঙ্গবন্ধু : শতবর্ষে শতছড়া। তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে, ছড়ার বই লুটোপুটি। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ৭০-এর অধিক। উল্লেখযোগ্য ছড়াগ্রন্থ : লুটোপুটি, উড়োচিঠি, নাকখপতা, ছড়ার জলে জোসনা জ্বলে, পাতায় পাতায় ছড়া, লম্বা মোটা বেঁটে, জোড়াতালি, ঘুড়ির মত উড়ি, শতরকমের ছড়া। শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ : পানামা রহস্য, পামস্যার, বায়োস্কোপ, কাচপাহাড়ের রাজকন্যে, পাখি এবং পাখি। এছাড়াও তাঁর একাধিক ভ্রমণ, প্রবন্ধ ও সম্পাদনা গ্রন্থ রয়েছে।
বাবা মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের সবশেষ চাকরি ছিলো চাঁদপুরের লেডীপ্রতিমা মিত্র বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে। মা ফিরোজা বেগম পরলোকগমন করেন ১৯৬৪ সালে। স্ত্রী আরিফা হোসেন নিউলিভা দক্ষতা প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের পরিচালক। এছাড়াও সাজাই বিউটি পার্লারের অন্যতম স্বত্বাধিকারী ও পরিচালক।
সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ফারুক হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য পুরস্কার, কাজী কাদের নওয়াজ শিশুসাহিত্য পুরস্কার, চন্দ্রাবতী একাডেমি স্বর্ণপদক, মাইকেল মধুসূদন একাডেমি পুরস্কার, এম নূরুল কাদের ফাউন্ডেশন পুরস্কার, সিটি ব্যাংক আনন্দ আলো শিশু সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশু একাডেমী শিশু সাহিত্য পুরস্কার, শিশু সাহিত্য সংসদ শিশু সাহিত্য পুরস্কার, সিকান্দার আবু জাফর সাহিত্য পুরস্কার, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন পদক, রফিকুল হক দাদুভাই পদক ও লাটাই আজীবন সম্মাননাসহ বহু সম্মাননা অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকার।