প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
এককালের প্রমত্তা ডাকাতিয়া নদী। এপাড় থেকে ওপাড় দেখা যেতো না। এক সময় নদী পার হতে গিয়ে এ পাড়ের মানুষকে স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেতে হতো। কিন্তু কালক্রমে চর পড়ে সঙ্কুচিত হতে হতে অনেকটাই খালে পরিণত হয়েছে নদীটি। তারপরও কিছু স্থানে নদীটি এখনো প্রমত্তা রূপেই কিছুটা দৃশ্যমান রয়েছে।
তেমনি একটি স্থানে ফরিদগঞ্জ ও হাজীগঞ্জ দুই উপজেলার মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত স্বপ্নের সেতু উটতলী ব্রিজের নির্মাণ কাজ শুরু হচ্ছে চলতি সেপ্টেম্বর মাসেই। ৫৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প কর্মকর্তা ও ফরিদগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশল বিভাগ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। দুই উপজেলার ভূমিকে সংযুক্তকারী ১৩টি স্প্যানের ওপর দৃষ্টিনন্দন সেতুটি নির্মিত হলে দুই উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। ফিরবে মানুষের ভাগ্য। যেমনটি শুরু হয়েছে পদ্মাসেতু নির্মাণের পর দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনে।
জানা গেছে, চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার উত্তরাঞ্চল এবং হাজীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিমণ্ডদক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করার লক্ষ্যে ২০২০ সালের জুলাইয়ে একনেক সভায় উটতলী খেয়াঘাটে সাড়ে ৫৫০ মিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণের জন্যে ১০৭ কোটি টাকা বরাদ্দ অনুমোদন হয়। ওই বছর টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে কাজ পায় ঢাকার দোহার উপজেলার মোঃ আইয়ুব আলীর মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সুরমা এন্টারপ্রাইজ। ২০২১-২২ অর্থবছরে কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু গত দুই বছরে কাজ শুরু করেনি প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি সেতুটির অলিপুর অংশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাইট নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সেতুর মালামাল আসা শুরু হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়কের জমি অধিগ্রহণ শুরু না হলেও সম্ভাব্য সড়কের দুই পাশে লাল নিশানা লাগিয়েছে সেতুর প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, চাঁদপুর সেচ প্রকল্প বেড়িবাঁধ (সিআইপি) সড়কে মুন্সীরহাট বাজারের পাশ দিয়ে উটতলী সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়কের জন্যে জমির দুই পাশে লাল নিশানা লাগানো হয়েছে। অন্যদিকে হাজীগঞ্জের অলিপুর অংশেও একইভাবে লাল নিশানা টানানো হয়েছে। নদীর এ পাড়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলার সুবিদপুর পশ্চিম ইউনিয়নের বাজপাড় গ্রাম এবং অপর পাড়ে হাজীগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের অলিপুর গ্রাম।
মুন্সীরহাট বাজারের পাশ দিয়ে অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মিত হবে। ইতোমধ্যেই লাল নিশানা টানিয়ে সম্ভাব্য সড়কের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। অ্যাপ্রোচ সড়কটি যাদের জমির ওপর দিয়ে গেছে তাদের মধ্যে আবিদুর রহমান মুন্সীর ছেলে বাবলু মুন্সী জানান, মাসখানেক পূর্বে কর্তৃপক্ষ তাদের জমির ওপর লাল নিশানা দিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত আমাদের সাথে যোগাযোগ করেনি। সেতুর সংযোগ সড়ক আমার পরিবারের ছাড়াও টিটু মুন্সী, সিরাজ মুন্সী, দেলোয়ার মুন্সীর জমির উপর দিয়ে গেছে। আমরা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করছি এই সেতুর জন্যে।
উটতলী ঘাট এলাকায় দেখা যায়, খেয়াঘাটে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পারাপার হচ্ছে দুই পাড়ের মানুষ। প্রতিবার পার হওয়ার জন্যে ইজারাদারকে ৫ টাকা ও নৌকার মাঝিকে ৫ টাকা করে দিতে হয়। এতে দুই উপজেলার সাধারণ মানুষকে ব্যবসা-বাণিজ্য, বাজারে যাতায়াতের সময় টাকা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশেষ করে হাজীগঞ্জের অলিপুর গ্রামের শিক্ষার্থীদের মুন্সীরহাটে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসায় আসা-যাওয়ার সময় বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। শিক্ষার্থী আলমগীর, লায়লা আক্তার, অলিপুর গ্রামের বাসিন্দা মোস্তফা, নূরজাহানসহ একাধিক ব্যক্তি এ কথা বলেন।
গত ১১ বছর ধরে সিএনজি অটোরিকশা চালান অলিপুর গ্রামের জুয়েল। তিনি জানান, আমরা দীর্ঘদিন ধরে সেতুটির অপেক্ষায় রয়েছি। এই সেতুটি দুই উপজেলার মানুষের জন্যে ভালো কিছু বয়ে আনবে বলে বিশ্বাস করি। এখন গাড়ি চালিয়ে যেটুকু আয় হয়, সেতু নির্মিত হলে আশা করছি আমাদেরও আয় বাড়বে।
সিএনজি অটোরিকশা চালক হানিফ, আরিফ হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, শাহপরান জানান, আমরা এখন অলিপুর থেকে কৈয়ারপুল পর্যন্ত যাত্রী আনা-নেয়া করি। সেতুটি নির্মিত হলে যাত্রীও বাড়বে, আমাদের আয়ও বাড়বে।
উটতলী খেয়াঘাটের মাঝি সুমন মাঝি, অমৃত মাঝি, রঘুনাথ মাঝি এবং ৬০ বছর ধরে এই খেয়াঘাটে নৌকা দিয়ে যাত্রী পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করা জ্ঞানেন্দ্র মাঝি জানান, এতোকাল আমরা নদীর ওপর দিয়ে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছি। তবে সেতু নির্মিত হলে আমাদের ক্ষতি হবে। আশা করছি, কর্তৃপক্ষ আমাদের দিকটা বিবেচনা করবেন। সেতুটি নির্মিত হলে আমাদের আয়ের পথ বন্ধ হলেও আমরা খুশি সেতুটি পেয়ে। কারণ এই অঞ্চলের মানুষের উপকার হবে, এটাই বেশি আনন্দের।
উটতলী খেয়াঘাটের ইজারাদার তাফাজ্জল হোসেন বলেন, একসময় এই ঘাট দিয়ে দৈনিক কয়েক হাজার লোক পারাপার করতো। তখন ১ টাকা করে নিলেও অনেক টাকা হতো। এ বছর ২ লাখ টাকায় ইজারা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি।
মুন্সীরহাট গ্রামের বাসিন্দা মোশারফ হোসেন মিলন বলেন, গত দুই বছর ধরে আমরা অপেক্ষায় রয়েছি। অবশেষে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন এসে কাজ শুরু করেছে দেখে ভালো লাগছে। মূল সেতুর কাজ শুরুর অপেক্ষা। এই সেতুটি অনুমোদনে যার কথা না বললেইও নয়, তিনি আমাদের এই ইউনিয়নের কৃতী সন্তান সাবেক সিনিয়র সচিব ও বর্তমান কর্মসংস্থান ব্যাংকের চেয়ারম্যান নূরুল আমিন মানিক। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় দীর্ঘ এই সেতুটি আলোর মুখ দেখেছে। এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যাকাশে নিশ্চয়ই নতুন কিছু আসবে সেতুর কল্যাণে।
উক্ত ইউনিয়নের বাসিন্দা আওয়ামী লীগ নেতা খাজে আহমদ মজুমদার বলেন, ফরিদগঞ্জ উপজেলার উত্তরাঞ্চলের অবহেলিত মানুষের জন্যে উটতলী সেতুটি আশীর্বাদ হয়ে আসবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। এই সেতুটি অনুমোদনের জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন আমাদের প্রিয় নেতা প্রখ্যাত সাংবাদিক জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য মুহম্মদ শফিকুর রহমান। আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। যদিও সেতুটি অনুমোদন ও টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে আরো আগেই শুরু হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঢিলেমির কারণে এখনো সেতুটির কাজ শুরু হয়নি। নচেৎ এতোদিনে আধুনিক এই সেতুটি যান চলাচলের জন্যে খুলে দেয়ার সময় হতো। তবে এই মাসের মধ্যে আশা করছি সংসদ সদস্য মহোদয় সেতুটির নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করার পর দ্রুতলয়ে কাজ শুরু হবে।
সুরমা এন্টারপ্রাইজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল বলেন, ৬৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৩টি স্প্যানের ৫৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুটি নির্মাণের জন্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে জাহাজযোগে মালামাল আসা শুরু হবে। এরপরই দ্রুত কাজ শুরু হবে বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, সেতুটির সাথে নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় আমরা সিলেট থেকে প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে আসতে পারবো। এছাড়া আমাদের মালামাল আগের মূল্যে ক্রয় করা থাকায় আমরা কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছি।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী আববার আহমেদ জানান, চলতি সেপ্টেম্বর মাসেই উদ্বোধনের মাধ্যমে সেতুর নির্মাণ কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে। সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হলে সংযোগ সড়কের টেন্ডারও দ্রুত করা হবে। এখন সংযোগ সড়কের অ্যালাইনমেন্টের কাজ চলছে।
চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য মুহম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, ত্রিশ বছর প্রচেষ্টার ফসল উটতলী সেতু। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান অযথা ঢিলেমি করছে। এখনো যদি একই ঘটনা ঘটায় তবে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে হবে। সেতুটি নির্মাণ সম্পন্ন হলে দুই উপজেলাসহ এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধিত হবে। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিতে গ্রাম থেকে উন্নয়ন যাত্রা শুরু করতে হবে। সেই লক্ষ্যে আমার প্রচেষ্টা ছিলো উটতলী সেতুটি নির্মাণের। ইতোপূর্বে একবার এটি অনুমোদন হলেও অজ্ঞাত কারণে তা হয়নি। আমি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর আমার পদক্ষেপ ছিলো উটতলী সেতু নির্মাণ। আশা করছি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দ্রুত কাজ শুরু করে এই স্বপ্নযাত্রার সফলতার মুখ দেখাবে।